ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কাঠঠোকরা

প্রকাশিত: ১১:২৫, ৩১ মে ২০১৯

কাঠঠোকরা

দুপুর থেকেই আজ সে হাঁটছে। গ্রীষ্মের গণগণে রোদ। ধান-গমের মাঠ পেরিয়ে বাবলা গাছের নিচে দাঁড়ালো। পাতাহীন এই গাছটিকে শ্রীহীন আগাছাগুলো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। যেন কয়েক শতাব্দী তেল পড়েনি চুলে। হাঁটছে-দৌড়াচ্ছে-লাফাচ্ছে। গায়ে তার কোথায় এত বন্ধন-জড়তা, আজ সে খুলে ফেলতে চায়। দূর থেকে এক ঝলকা বাতাস এসে ধানক্ষেতকে দুলিয়ে দিয়ে গেল। সেই সঙ্গে শান্তি শান্তি ভাব কিছুক্ষণ অনুভব করল সোহেল। আকাশের দিকে তাকাল। কয়েক খন্ড কালো মেঘ গাঢ় নীল আকাশে অনায়াশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাঠঠোকরার ঠ-র-র ঠ-র-র শব্দ এসে বিঁধছে কানে। কোথায় বসেছে যেন পাখিটা। কাঠকে ঠুকরিয়ে কী আনন্দ পায় ওটা কে জানে! আজ কেন যে মনে এমন ভাব আসছে! বাড়িতে কারা এসেছে। মায়ের দিকের আত্মীয় ওরা। থাকবে কয়েকদিন। মায়ের বকুনিতে মাথায় তেল নিয়েছে সে। সকালে কলেজে গিয়েছিল। ফিরে একদম মাঠে। উর্মি মেয়েটার সাথে কথা বলতে পারত সে। বলতে পারত, তোমার নামটি তো বেশ সুন্দর, বাহ্! এত সুন্দর নাম ! হবেই না বা কেন, তুমি নিজেই তো সুন্দর। কেন যে বলতে পারলো না। ওর মা-ও যে কি না? বলেকি-হাঁরে রোশনারা তোর ছেলেটা তো ভারি লাজুক, মুখচোরা। ওকে আমাদের সঙ্গে ঢাকায় পাঠিয়ে দে। ঘুরে আসুক। চোখ-মুখ খুলুক একটু। সোহেল দাঁড়াতে পারল না। বের হতে গিয়ে শুনল, নিয়ে যাও না আপা। হলে তো ভালই হয়। ওর বাপেরও ইচ্ছে ছিল শহরের কলেজে পড়াবে। কষ্ট করে হলেও পাঠাতাম। ও নিজেই গেল না। বলে কি- এখান থেকেও ভাল রেজাল্ট করে অনেকে। কী পাগল দেখেছ? বোকা ছেলে তো! সোহেলের প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হলো। পারল না। উর্মিটাও যে কি না! নিজের পরিচয়টাও দিল না। বলতে পারত, ভাইয়া আমি উর্মি। আর মা যে কী, ওদের সামনে কিছু না বলে বাইরে এসে বলল, রেবা আপাকে তুই আন্টি ডাকবি। আর ওর মেয়ে উর্মি এবার এসএসসি দেবে। আর শোন, যে কয়দিন ওরা থাকবে তুই মাথায় তেল-টেল দিবি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবি। বুঝলি? সোহেল ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির উল্টোদিক দিয়ে বাম চোখ কচলিয়ে বলল, মা, তুমি চুপ কর তো। ওরা এসেছে আমাদের বাড়িতে। আমরা কি ওদের বাড়িতে গেছি যে ওদের মতো চলতে হবে? এই ছোরা তুই বেশ পটর পটর বকছিস। দিন দিন বেয়াদব হচ্ছিস। জানিস ওরা কত বড়লোক! ঢাকায় বিশাল বাড়ি। তোর বিচারক মামার যে গাড়ি তার চেয়েও সুন্দর গাড়ি ওদের। ওর ভাই বিদেশে পড়তে গেছে। পড়া শেষ হয়ে এলো। বাড়িভর্তি কত সুন্দর সুন্দর জিনিস। ওদের আছে তাতে আমার কি? বিচারক মামা অনেক ভাল। এদের মত চ্যাটাং চ্যাটাং আমাকে বোকা বলেত না। সোহেল জোরেই বলে ফেলল। ওরা শুনে ফেলতে পারে ভেবে রোশনারা আর কোন কথা বাড়াল না। নাসরিন, নাসরিন ডেকে বললো, তোর উর্মি আপুকে গোসলের পানি চেপে দে তো, যা। উর্মি আহলাদি ঢঙে বলল, আম্মু আমি কি গোসল করব, আম্মি? আমি কোথায় গোসল করব আম্মু। ও আম্মি, ও আম্মু বলো না। সোহেলের ইচ্ছে হচ্ছিল বলে, চল না, এখান থেকে পাগলা নদী তো বেশিদূর নয়। তোমার দেখাও হবে, গোসলও হবে। লজ্জা কোথা থেকে যে শরীরকে অসাড় করে দিল। এখানে এমন ঘুর ঘুর করাও ঠিক নয়। নাসরিন পাজিটা কখন কী বলে ফেলে। বলে বলুক, আমি কাউকে ডরাই না। সোহেল রান্নাঘরে ঢুকে সরষের তেল দু’হাতে মাখতে মাখতে মাথায় বুলিয়ে নিল। দরজার উপরে রাখা গামছা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মাঠের দিকে। সারস পাখিগুলো ধানগাছের সামান্য উঁচু দিয়ে উড়ছে। সোহেলেরও এমন উড়তে ইচ্ছে করে। একা আইলের ওপর বসে পড়ে সোহেল। শহরে পড়াশোনা সে করতে চায়। কিন্তু তার বাবার যে চাকুরি। শুধু শুধু কষ্ট দেয়া হবে। সাইকেল নিয়ে সকালে বের হয়ে যায়। ফিরে আসে রাতে। বাবার সাথে দেখাই হয় না আজকাল। শুধু ছুটির দিনে। তবু শুয়ে শুয়ে কেটে যায় সময়। একটু বাজারে যায়। পড়াশোনার খবরাখবর সামান্যই নিতে পারে। ব্যস্ততার কারণে আত্মীয়স্বজনদের সাথে সম্পর্কটাও ফিকে হয়ে গেছে। রোশনারা একাই আর কি করবে? যা সম্পর্ক রাখার তবু তো সে-ই রাখে। অথচ ওদের আত্মীয়দের সোহেল চিনতেই পারে না। গত বছর আমের সময় বিচারপতি মামা এসেছিল। সে সময়েও একই অবস্থা হয়েছিল সোহেলের। চিনতে পারছিল না। চেনার পরও মিশতে পারছিল না। ওই মামা অবশ্য অন্য রকম মানুষ। নাসরিন সহজেই মানিয়ে নেয়। সোহেল দূরে দূরে থাকত। পরে একদম আপনজনের মতো। একসঙ্গে ঘুরে বেড়ানো। বিচারপতি মামা আর মামি এসেছিলেন। মামিটাও কত অমায়িক। গাড়িতে করে ঘোরাফেরা, কত জায়গায় যাওয়া। মামা বলেছিলেন, বড় হয়ে তুইও এ রকম একটা গাড়ি কিনবি। আমি আগে তোর চেয়েও হ্যাংলা ছিলাম। হ্যাংলা বলল কত সুন্দর করে। যেন আরও বলুক। আর এই আন্টি উর্মিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। উর্মিকে কেমন যেন লাগে। একটু অহঙ্কারি টাইপ। সোহেলদের ক্লাসের রিপা অনেকটা এমন। তবে উর্মি অনেক সুন্দরী। আহ্লাদি। রিপা উর্মিকে দেখলে চমকে যাবে। ওকে একবার নিয়ে গেলে হয় কলেজে। বলবে, আমার কাজিন। তা কি হয়? মা কী মনে করে। নাসরিন যেতেই দেবে না হয়ত। সে কি সত্যি নিয়ে যেতে পারবে? কী মনে আসছে এসব? সূর্যটা হেলে পড়েছে মাঠের ওপাশে আমগাছের সারির ওপারে। ক্ষিধেয় পেটটা চড়–ইয়ের মতো কিচিরমিচির করছে। দুপুরে খাওয়া হয়নি তার। উঠে পড়ে সোহেল। বাসার কাছে আসতেই পা ভারি হয়ে আসে সোহেলের। কাকে আগে দেখবে সে? আন্টি না উর্মি ? মা হলে তো বকুনি শুরু হবে। ধীরে ধীরে বকে তবু হয়, আন্টি-উর্মির সামনেও বকুনি দেবে। এটা মায়ের ঠিক নায়। ঢুকতেই বাবাকে পেল সে। আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে এসেছে। সোহেল শান্তশিষ্ট বালকের মতো মুখে হাসি নিয়ে তাকাল বাবার মুখের দিকে। নাকের বাম পাশে কালো একটা তিল। কিছুটা উঁচু। এটাই ছুঁয়ে দেখত সে ছোটবেলায়। মুখটা এখন অনেক শুকনো। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত একজন মানুষ। এই মানুষটি তাকে পড়ানোর জন্য শহরে পাঠাতে চেয়েছিল। সামান্য বেতনের জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয় তাকে। অফিসের কাজে প্রায় সারাদিন সাইকেলের ওপর কাটাতে হয়। অফিস থেকে কিস্তিতে মোটরসাইকেল দিতে চেয়েছিল। এতে হয়ত তার ইনকামও কিছুটা বাড়ত। কিন্তু মোশারফ মিয়া তো চালাতে জানে না। দিন দিন যে হারে এক্সিডেন্ট হচ্ছে! কম ইনকাম। বেশি পরিশ্রম। তবু ভাল। সপ্তাহে কয়েকবার দেখা হয় মানুষটির সঙ্গে তার। অথচ কী নির্ভরতার সেই মুখ। এই বাবাকে বেশি কষ্ট দিতে চায় না সে। সোহেল কোথায় ছিলে? মাঠে ছিলাম বাবা। সোহেল কাঁচুমাচু উত্তর দেয় তড়িঘড়ি। পালাতে পারলে বাঁচে যেন। কিন্তু কথা দিয়েছিলে ভাল রেজাল্ট করবে। আমি কিন্তু বিশ্বাস করি তুমি পারবে। সোহেল নিশ্চুপ থাকে। বাবাকে দেয়া এ কথাটি স্মরণে এলেই সবকিছু ওলট পালট হয়ে যায় তার। এখনও তাই। কিছু মনে থাকে না। পড়ার ঘরে যায়। বইগুলো তার খোলা পড়ে আছে। নিশ্চয় নাসরিন আর উর্মির কাজ এটা। সোহেল পড়তে বসে। পড়াগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। অণু-পরমাণু জীবন্ত হয়ে তার চারদিকে ঘুরতে থাকে। ঘুরতে থাকে ইলেক্ট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, সবকিছু। একসময় বিকট শব্দে বিষ্ফোরিত হয়। ঢুলুনিটা কেটে যায় তার। ঘুঙুরের শব্দ তুলে ঘরে আসে নাসরিন আর উর্মি। ভাইয়া কোথায় ছিলিরে? তোর জন্য বিকেলের নাশতা রেখে রেখে খেয়ে ফেলেছি আমি। সোহেল সোজা হয়ে বসে বলে, ভাল করেছিস। উর্মির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসার চেষ্টা করে বলে, আপনি বসুন। আমি! আমাকে বলছেন? না না আপনি বরং পড়াশোনা করুন। আমরা তো শুধু হাসি লাফালাফি করি। আপনার ডিস্টার্ব হবে। না না। কি যে বলেন। সে কিরে ভাইয়া, তুই তো উর্মিকে আপনি আপনি করছিস। তোর চেয়ে ও কত ছোট জানিস? তা হোক। ও তো কিছুই বলছে না। ও না বলুক আমি বলছি, এখন থেকে ‘তুমি’ বলবি ওকে। হ্যাঁ হ্যাঁ অসুবিধা নেই। ওড়না গলার সাথে পেঁচিয়ে নেয় উর্মি। সোহেল তুমি করে কথা বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। ‘যাই’ বলে নাসরিনের হাত ধরে উর্মি বেরিয়ে গেল। আর সেই মুহূর্তে অনেক কথা খুঁজে পেলো সোহেল। আচ্ছা, তুমি কোন্ স্কুলে পড়? আমি তো স্কুলে পড়ি না। সে কি! তাহলে তুমি কোথায় পড়? আমি কলেজে পড়ি। তোমার কলেজে। আমার আরেকটি নাম আছে, তুমি কি জানো? রিপা। রিপা! তাই ? ওটা তো জানতাম না। জানো জানো। তুমি নিশ্চয় জানো। তোমাকে একটি মেয়ে ভালবাসে, সেটা কি জানো? না তো! কেউ তো আমাকে বলেনি। ও তো ভয়ে তোমাকে বলতে পারছে না। যদি তুমি ‘না’ বলে দাও। তোমার বিশ্বাস নেই। তুমি অহঙ্কারি। অহঙ্কারি আমি? আমি অহঙ্কারি না। হতেই পারে না। বানিয়ে বানিয়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছিল সে। কিন্তু উত্তরগুলো ও দেয়নি। কে দিল তবে? একা একা সোহেল বিড় বিড় করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর রোশনারা এসে ঘুমন্ত সোহেলের কপালে হাত দিতেই ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ে সোহেল। মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিলম্বিত দৃষ্টি তার। তোর যে ভীষণ জ্বর। কোথায় ছিলি দুপুরে? খেয়েছিস কিছু? সোহেল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। কিছুই উত্তর দিল না। রাতের খাবার খেয়ে তারপর শুবি। আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে আসি। ঘুমাবি না। সোহেল হাই তুলতে থাকল। উর্মিরা আজ চলে যাচ্ছে ঢাকায়। আমের ঝুড়ি, বস্তা ইত্যাদি সব তোলা হচ্ছে মাইক্রোতে। সোহেলের জ্বর অনেকটা সেরেছে। জড়তাও কিছুটা কমেছে মনে হয়। উর্মি সাদা খাতা চাইতেই সোহেল নিজের খাতা এনে দিল। উর্মি তাতে ঢাকার ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর লিখে সোহেলকে দিল। মুখে বলল, আসবেন অবশ্যই। তারপর খুব সুন্দর করে হাসল। শৈল্পিকভাবে হাত উঠিয়ে ‘বাই’ বলে উঠে পড়ল মাইক্রোতে। উর্মির মা আরও কিছুক্ষণ সোহেলের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে উঠে পড়ল। মাইক্রো চলে গেল। সোহেল দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। হাতে তার উর্মির ঠিকানা লিখা খাতাটি। আজও গেল সোহেল মাঠে। আমবাগান পেরিয়ে, মাঠ পেরিয়ে ধানক্ষেতে। হালকা বাতাসে কসকসে সবুজ লম্বা পাতাগুলো শিরশিরানি শব্দ তুলে দুলে যাচ্ছে। চারদিকে ম ম গন্ধ। আমোদিত উৎসব যেন। ঘন নীল আকাশের মাঝে শুভ্র সাদা মেঘ। কোন্ দেশের মানচিত্র। কবুতর, ঘুঘু দোয়েল, ফিঙে কত পাখি এখানে চরে বেড়ায়। গান করে সুর দিয়ে। আহা! আমি যদি এমন গাইতে পারতাম। পারব না কেন, সোহেল গাইবার চেষ্টা করে। আইল ধরে ধরে হাঁটতে হাঁটতে সেই বাবলা গাছের নিচে এসে বসে। এখানে এলেই ওই কাঠঠোকরার শব্দটা পাওয়া যায়। আর কত ঠোকরাতে হবে তাকে। শক্ত কাঠের গায়ে ঠোঁট দিয়ে কী করতে চায় পাখিগুলো। আচ্ছা উর্মি এখন কী করছে? ওর সঙ্গে কথা বললে হয়। কেমন আছো উর্মি? তুমি গিয়ে তো খবরই নিলে না। খবর নেব কীভাবে? একটা মাত্র মোবাইল তোমাদের। সেটিও তোমার বাবার কাছে থাকে। ওটা আমার বাবার অফিসের মোবাইল। তুমি কি আমার কোন খবর জানো উর্মি? তোমার রেজাল্ট তো! শুনেছি। ভর্তি হবে কোথায় এবার? ঢাকায় ভর্তি হও। ডাক্তার না হয় ইঞ্জিনিয়ার। আমার মতো কতজনেরই তো ভাল রেজাল্ট। সবাই কি মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পারবে? তুমি আমাকে এত সাহস দিচ্ছ কেন? আমি যে তোমাকে ভালবাসি। ভালবাসো মানে লাভ! ভালবাসা? তুমি তো বোকা। তুমি কিছুই বোঝ না। সত্যি আমি বোকা। আচ্ছা তুমি কি রিপাকে চেনো? ও এ কথাই বলে। রিপা তোমাকে হিংসে করে। রিপা হিংসে করে কেন? সোহেল ভাবতে শুরু করে। হিংসে কি সত্যি করে? করে হয়ত। নইলে কলেজ থেকে সোহেলের এ প্লাস প্রাপ্তিতে সবাই অভিনন্দন জানালো রিপা শুধু কিছুই বলেনি। কেন বলেনি? ও পায়নি, তাইকি? কে জানে। সাতভাইয়া পাখির দল বড্ড কিচিরমিচির শুরু করেছে। কি জন্য এত ঝগড়া করিস তোরা? তোদের কি অনেক সমস্যা? তোদের বাবা কি অনেক কষ্ট করে? তোদের মা কি মাঝে মাঝে কাঁদে। বোন কি সব সময় তোদের খুব ভালবাসে না? ও তোদের তো বোনই নেই। সোহেল সাতভাইয়াগুলোকে আলাদা করে চিনতে চেষ্টা করল। কিছুতেই আলাদা করা যাচ্ছে না। এবার তাহলে উঠি উর্মি। না হয় আমার সঙ্গে চলো। কী যাবে নাকি? সোহেলের হালকা হালকা লাগে। উর্মির সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলা হয়েছে। ও এখন নিজে নিজেই কথা বলে। নিজে নিজেই উত্তর দেয়। আকাশ কালো করে মেঘ উঠেছে। বৃষ্টি নামবে বোধ হয় এখনই। ভাবতে ভাবতেই বৃষ্টি নামল। সোহেল বৃষ্টিতে ভিজতে থাকল। বাবা বললেন, সোহেল এবার সত্যি সত্যি ঢাকা চলে যাও। তোমার মায়ের সঙ্গে তোমার রেবা আন্টির কথা হয়েছে। তোমাকে যেতে বলেছে। কালই চলে যাও। কালই? হ্যাঁ। আর মাত্র কয়েকদিন পরেই মেডিক্যাল কলেজ এডমিশন। তোমাকে পরীক্ষা দিতে হবে। মাত্র কয়েকদিন। আমি তো কোন কোচিং করছি না। বইও নেই। তবু তোমার হবে। কি বলো? তুমি এসএসসি, এইচএসসি ভাল করেছ। এখানেও করবা। কি বলো? সোহেল কিছুই বলল না। মেইন গেটের দারোয়ান পার হয়ে ফাঁকা জায়গা। অতঃপর অভ্যর্থনা বিভাগ। অন্য পাশে বিস্তৃত গ্যারেজ। সোহেল অভ্যর্থনা বিভাগে এসে জোবদুল হক নাম বলতেই একজন বলল, দাঁড়ান। ইন্টারকমের রিসিভার কানের কাছে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম আর কোথা থেকে এসেছেন? সোহেল ভ্যাবাচ্যাকা খেল। আমাকে জিজ্ঞেস করছেন? পরক্ষণে বলল, আমি কানসাট থেকে, আমার নাম সোহেল। রিসিভার ধরা ছেলেটি বলল, যান ১৪-এ বলে লিফট দেখিয়ে দিল। কলবেল টিপতেই একটি মেয়ে দরজা খুলে দিল। সোহেল ‘স্লামালাইকুম’ বলে দাঁড়িয়ে থাকল। মেয়েটি সালামের উত্তর না দিয়ে বলল, ভেতরে আসেন। সোহেল ভেতরে গিয়ে বুঝতে পারল না কী করবে এখন। রেবা আন্টি বসতে বলে ভেতরে গেলেন। সোহেল বসেই থাকল সোফায়। সামনে বিশাল এলসিডি টিভি। চাইলে অন করতে পারে। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে তার। আট ঘণ্টার জার্নি ছিল। ভীষণ ক্লান্ত। চোখ বুজে আসছে। পরীক্ষা শুরু হয়েছে। অথচ তার সিটটা খুঁজে পাচ্ছে না সোহেল। টেনশনে কপাল ঘেমে যাচ্ছে। পা ভারি হচ্ছে। কী করবে এখন সে ? আরে রিপাকেও যে দেখা যাচ্ছে। পরীক্ষা কি শেষ? সবাই চলে যাচ্ছে। হায় হায়! কী হবে আমার- বলে চিৎকার দিতে গিয়েই জেগে গেল সোহেল। সোফার ওপর ঢলে গিয়েছিল। রেবা আন্টিকে দেখে সোজা হয়ে বসল। রেবা আন্টি সোহেলকে সোফায় বসতে নিষেধ করলেন। বললেন, টিভির সামনে না আসতে। আর ওরা যখন একসঙ্গে বসে বসে কথা বলে, তখন যেন কোনক্রমেই তাদের সামনে দিয়ে না হাঁটে। বাইরের বাথরুম যেন ব্যবহার করে। ডাইনিংয়ের সামনে না আসতে ইত্যাদি ইত্যাদি। সোহেলকে কিচেনের পাশে ঘুলঘুলির মেঝেতে ঘুমুতে দেয়া হয়েছে। ব্যাগ থেকে বই খাতাগুলো বের করে সে। অনেকদিন পড়া হয়নি তার। সকালের নশতা সেখানেই দিয়ে গেছে রুপালি। কাজের মেয়ে। গায়ের রং ময়লা হলেও মুখে সৌন্দর্যের ছাপ স্পষ্ট। দুটো রুটি, ডিমের অমলেট, মিষ্টি। সোহেলের ক্ষিদেটা বেশ তুঙ্গে ওঠে। কয়েক লোকমায় সাবাড় করে দেয়। আর দুটো রুটি হলে ভাল হতো। রুপালিকে বললে হয়ত দিয়ে যেত। বলাও যাচ্ছে না। যদি কিছু মনে করে। আন্টি বা উর্মি যদি জেনে ফেলে। আন্টির সঙ্গে কথা হয়েছে সোহেলের। কিন্তু উর্মির সঙ্গে দেখা হয়নি এখনও। আন্টির সঙ্গে আর তেমন কথা হয়নি তার। বাড়িতে তোর বাবা-মা কেমন আছে টাইপের কথাবার্তা। এভাবে থাকতে সোহেলের অস্বস্তি লাগে। কেমন খাপছাড়া জীবন। ইচ্ছে হলেই মাঠে ছুটে যাওয়া যায় না। রুপালি কিছু কাঁচা সবজি কিনতে দিল সোহেলকে। সোহেল ব্যাগ হাতে গিয়ে বুঝল, ঘরের চেয়ে বাইরের শ্বাস-প্রশ্বাস বেশ আরামদায়ক। মানুষ এখানে হেঁটে যাচ্ছে জোরে। রিক্সা চলছে জোরে। সবকিছু জোরে-দ্রুত। কিসের এত তাড়া এদের, আল্লাহ জানে। সোহেল সবজি কিনল ধীরে-সুস্থে। রুপালিকে ব্যাগসহ টাকা বুঝিয়ে দিল। রুপালি মহাখুশি। এতদিনে একজন বিশ্বস্ত ছেলে পেয়েছে। এই ছোটখাটো বাজারগুলো আগে রুপালিকেই করতে হতো। সব সময় কিছু না কিছু প্রয়োজন হয়ই। আর তখনই ছুটে যেতে হয়। বিরক্তি লাগে। সপ্তাহের বাজারগুলো জোবদুল হক সাহেব ড্রাইভারের সঙ্গে গাড়িতে করে নিয়ে আসেন। তবুও কিছু প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তখন রুপালিকেই কিনতে হয়। এ জন্য কিছু টাকা দেয়া থাকে তাকে। রুপালি মাঝে মাঝে ড্রাইভারকে বাজার করতে দিয়ে দেখেছে ও ব্যাটা বড় ঠক। সিগারেটের দাম নিয়ে নেয়, রিক্সা ভাড়াও নেয়। আবার জিনিসপত্রের দামও বলে বেশি করে। আজ সোহেল বেশ তাড়াতাড়িই এসেছে। ওর সিগারেট লাগে না। রিক্সা লাগে না। রুপালি হেসে বলল, এখন থাইকা তুমি বাজার কইরবা। সোহেলও বেশ মজা পেয়েছে। কিছুটা স্বাধীনতা। বাইরের খোলা বাতাস। লোকজনের ছোটাছুটি। সবাই যেন দৌড়াচ্ছে। ছুটছে সবাই, ট্রেন যেন এখনই ছাড়বে। সে কোন ট্রেন! সোহেলের কোন ট্রেন নেই। সে ধীরে ধীরে যায়। বাজার করে। ফিরে আসে। কোন তাড়া নেই। তবে একদিন সিগারেট খেয়েছে সোহেল। মোড়ের চায়ের দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে। চা খেলো, সিগারেট কিনে ধরাল, তারপর শহরের লোকেরা যেভাবে খায় ঠিক সেভাবে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে। উদাস দৃষ্টি। শহরের স্কুলের মেয়েরা রাস্তা পার হচ্ছে। তাদের দিকে দু’-একবার দেখেছে। উর্মির মতো মনে হয় সবাইকে। উর্মি তার সঙ্গে কোন কথাই বলে না। দেখা হয়েছে, যেন চেনেই না। অথচ কয়েক মাস আগেই যখন ওরা কানসাটে ওদের বাড়িতে গিয়েছিল, তখন ওরা ওদের সবচেয়ে ভাল রুমটা ছেড়ে দিয়েছিল। ওদের খুশি করার জন্য মায়ের সেকি পরিশ্রম আর উদ্বেগ। কোনদিন ছুটি নিত না যে বাবা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় এসে বসেছিল। ওরাই তো তাকে ডেকেছিল তখন। উর্মি তাকে ঠিকানা লিখে দিয়েছিল। আসতে বলেছিল। এখন কেন কথা বলে না। সোহেল নিজ থেকে কথা বলতে চায়নি কখনও। সেই ঠিকানা লেখা খাতাটি সোহেলের কাছে রয়েছে এখনও সযত্নে। মাঝে মাঝে বুকে জড়িয়ে রাখে সে। সুন্দর মুক্তার মতো হাতের লেখাগুলো। তার লিখার মতোই কিছুটা। তবু বেশি সুন্দর মনে হয়। সোহেল তাকিয়ে থাকতে থাকতে চুমু খেয়েছে কয়েকবার। বুকে জড়িয়ে ধরেছে। মনে মনে কথাও বলতে চেয়েছে। কিন্তু এখন মনে মনে কথা বলা যায় না। সামনে এক মস্ত হাতির শুঁড় যেন আগলে দাঁড়ায়। সেখানে উর্মির মুখটা নজরে আসে না। মাঠের মধ্যে সোহেল দৌড়াচ্ছে যেন। হারিয়ে যাচ্ছে সে কোন অন্ধকারে। এবার বাবার কথা রাখতে পারেনি সোহেল। মেডিক্যালে চান্স হয়নি তার। অন্য কোথাও পরীক্ষাও দেয়নি সে। এতসব নিয়ম-কানুন তার জানা নেই। তার বাবার আদেশ ছিল মেডিক্যালে চান্স পেতে হবে। এ জন্যই ঢাকা যাচ্ছ তুমি। বাবার কথা মনে হলেই সোহেলের বুকের ভেতর থেকে কান্না যেন উথলে ওঠে। বাবা কেন এত উচ্চাশা করে তাকে নিয়ে। অযথাই। আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। সোহেল মুসড়ে পড়ে। রেবা আন্টি বললেন, তুমি এখানে ডিগ্রি ভর্তি হও। আমাদেরও সাহায্যের একটি ছেলে প্রয়োজন। তুমি থাকলে বিল-টিল দেয়া, ভারি কাজ-টাজ, বাজার-টাজার করার সুবিধা। কিংবা কাপড় কাঁচা, থালা-টালা মাজা এই যেদিন বেশি কাজ হলো, বুয়াকে সহযোগিতা করা, কিংবা এটা ওটা এগুলো তো পারবাই। সোহেল মাথা চুল কালো বেশ দরকারি কথা শোনার ভঙ্গিতে। মায়ের কথা মনে হয় সোহেলের। মা তাকে পাঠানোর সময় বলেছিলেন, ওরা তোকে শহুরে বানিয়ে ফেলবে দেখিস। নাসরিন বলেছিল, ভাইয়া ওখানে বড়লোকদের দেখে আমাদের ভুলে যাবি না কিন্তু। উর্মিকে আপনি আপনি বলবি না যেন। সোহেলের হাসি পায়। ওকে আপনি বলতে যাব কেন? ও-ই তো বলতে দেবে না। সকালে সোহেল বাসার উদ্দেশে রওনা দেয়ার জন্য ব্যাগ নিয়ে রেবা আন্টির ঘুম থেকে ওঠার অপেক্ষায় বসে রইল। বুয়া রুপালি বললো, তুমি চলে যাও ভাই। আর এসো না। এরা মানুষ না। সবারই কাজের লোক ভাবে। এদের টাকা পোকায় খাবে। বুঝছ। তুমি শিক্ষিত মানুষ। সব বুঝবার পারবা। তবু কইলাম। ডিগ্রী শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে সোহেল। এখানে অনেক চেনা জানা তার। মন্টু, রাজিব, সুমন, রাকেশ, শিহাব সবাই সোহেলকে জিজ্ঞেস করে, ঢাকা কেমন লাগলরে, বল না? তুই নাকি একটা খাসসা লাভার জুটিয়েছিলে ওখানে। কি নাম রে তোর ওই বোনটার? সোহেল উত্তর দেয় না। মুচকি হাসে। বল নারে। সবাই সোহেলকে জেঁকে ধরে। সোহেল অবশেষে মুখ খোলে। হ্যাঁরে, ওর জন্য আমার সত্যি মন কাঁদে। মেয়েটা বাঁচবে নারে। আমাকে এতই ভালবাসত। ওর বাবা-মাতো আমাকে ছাড়বেই না। বলে কিনা ওখান থেকে আর আমাকে আসতেই দেবে না। আমি কি ওদের উদ্দেশ্য বুঝি না বলছিস? ওই উর্মির জন্যই ওরা আমাকে পছন্দ করে ফেলেছে। আমি কি এতই সোজা বল? সোহেল বিকেলে মাঠের উদ্দেশে বের হয়। বাবলা গাছটিকে আগাছাগুলো একদম ঢেকে ফেলেছে। কাঠঠোকরার ঠ-র-র ঠ-র-র শব্দ মাঠময় প্রতিধ্বনি করছে। আকাশের গায়ে অনেক মেঘ। সাত ভাইয়েরা সম্ভবত আর আসে না এখানে। সোহেল উর্মির সঙ্গে কথা বলবে আজ। তার সাথে বোঝা পড়া করা দরকার। কিন্তু কোথায় উর্মি। উর্মি তো আসছে না। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সোহেল ভিজে চলেছে। আজ সে বৃষ্টিতে ভিজতে চায়।
×