ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সত্যিকার অধস্তন বা নিম্নবর্গ!

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ৩১ মে ২০১৯

 সত্যিকার অধস্তন বা নিম্নবর্গ!

নারীর অধিকার এবং ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বেশ পুরনো। নানা আলোকের আশ্রয়ে এই আশার প্রদীপের সন্ধান নতুন কিছু নয়। তবে এত অজস্র সন্ধানকারীর মাঝেও একমাত্র একজন গায়েত্রি চক্রবর্তী স্পিভাকই এই নিম্নবর্গী (নারীর) স্তরের সর্বোচ্চ অব্যক্ত কণ্ঠস্বরের সন্ধান পেয়েছেন। ‘দলিতরা কি কথা বলতে পারে’, এই শিরোনামে লেখা প্রবন্ধটি তারই প্রামাণ্য দলিল। একটু পেছন থেকে বললে রণজিৎ গুহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে একালের অনেকেই নিম্নবর্গ নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। তবে বোধ করি গায়েত্রি চক্রবর্তী স্পিভাকই মূল সুর-মালাটা গাঁথতে পেরেছেন। নানা শ্রেণীর মাঝে নারীই যে নিম্নবর্গীয় স্তরের সর্বোচ্চ এর পক্ষে তিনি যুক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করে গেছেন বেশ সাবলীলভাবে। তাছাড়া তার যুক্তি-তর্কের সঙ্গে দেয়া নিজের উপলব্ধিগত উদাহরণও বেশ শক্ত একটা অবস্থানের জানান দেয়। এক্ষেত্রে যদি শহুরে সমাজব্যবস্থার একজন রিকশাওয়ালাকে নিম্নবর্গের প্রতিনিধি ধরে এগোই। তবে দেখা যায়, প্রায়শই স্যুট-টাই পরিহিতরা রিকশাওয়ালার সঙ্গে দরকষাকষি ছাড়াই রিকশাযোগে তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে চান এবং সেটা করেও থাকেন। কিন্তু নেমেই বাধে ভাড়া নিয়ে ঝামেলা। ভদ্রবেশি মানুষেরা অনেক সময় মানসিক হিসাব কষা ছাড়াই তাদের শরীরে হাতও উঠিয়ে ফেলেন। সামাজিক অবস্থানগত কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা এর প্রতিবাদ করতে চেয়েও করতে পারেন না। সামাজিক চোখ হিসেবে এখানে রিক্সাওয়ালাকে আপাতভাবে একজন নিম্নবর্গ মনে হলেও আদতে সত্যিকার অধঃস্তন বা নিম্নবর্গ সে নয়! মানুষ বাঁচে তার স্মৃতিতে। অর্থাৎ অতীতে ভাল কিছু করলে সেটা যেমন তাকে অনুপ্রাণিত করে। তেমনি খারাপ কিছু থাকলে তা পীড়িতও করে। রিক্সাওয়ালা সাহেব তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ভাড়া সংক্রান্ত ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া না জানাতে পারলেও বাড়ি ফিরে স্ত্রীর ওপর কিন্তু ঠিকই তার বিস্ফোরণ ঘটান। অর্থাৎ আপাতভাবে রিক্সাওয়ালাকে একজন নিম্নবর্গের প্রতিনিধি মনে হলেও সত্যিকার অর্থে নিম্নবর্গের জ্বলন্ত প্রতিনিধি ঘরে থাকা তার ‘নারী’! গায়েত্রি চক্রবর্তী স্পিভাক এ ধরনের উদাহরণগত জায়গায় যাননি। তবে তিনি দেখিয়েছেন যে নারীই দলিত অর্থাৎ নারীই সর্বোচ্চ মানের উচ্ছিষ্ট বা নিম্নবর্গ! তবে তার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শনের জন্য যথেষ্ট সামাজিক উদাহরণ এবং নৈমিত্তিক যাপন আমাদের সামনেই রয়েছে। পঙ্গু বা প্রতিবন্ধী স্বামী যিনি চলাফেরা থেকে শুরু করে জীবিকা, কোনটাই তার স্ত্রীকে ছাড়া করতে পারেন না তাকেও দেখা যায় গভীর রাতে কিংবা যে কোন সময় স্ত্রীকে ধরে মারছেন। কাজেই স্পষ্টত প্রশ্ন জাগে, নিম্নবর্গীয় কে? শারীরিকভাবে যিনি অক্ষম সেই পুরুষ নাকি যিনি সক্ষম কিন্তু একজন নারী? তবে উপরোক্ত প্রতিবন্ধী স্বামী কি করে তার স্ত্রীকে কর্তৃত্বের লাগাম পরিয়ে রেখেছেন। এটা কি তার জৈবিক সঙ্গমের আকুতিগত(!) পরাজয়ের নিশান নাকি হুমায়ুন আজাদ খ-িত লৈঙ্গিক রাজনীতির ফল? হুমায়ুন আজাদ তার একটি খুনের স্বপ্ন উপন্যাসে পলাশীর (ঢাবি) ফুটপাথে গভীর ঘুমে থাকা স্ত্রীর ওপর পঙ্গু স্বামীর জৈবিক সঙ্গমকে দেখেছেন আওরঙ্গজেবের সাওয়ার হিসেবে। অর্থাৎ শাসন এবং ভোগের পূর্ণ মাদকতায় চূড় পঙ্গু ওই স্বামী! বৈষম্যপূর্ণ আবিষ্কার নারী ও পুরুষ নিয়ে ঈশ্বরের রক্তেও হয়ত এক ধরনের খসখসে অনভূতি উদগিরিত হয়! আর তাছাড়া সামাজিক বাজার আয়োজনে নারী এবং পুরুষকে যতই মানুষ হিসেবে জাহির করতে চাওয়া হোক না কেন, ঈশ্বর কর্তৃক বায়োলজিক্যাল বিভেদ এই দুইকে শেষমেশ দুই শ্রেণীতে নিয়েই দাঁড় করায়। আরেকটি আশ্চর্যজনক সত্য হলো, বিশ্বরাষ্ট্র নিজেও ঈশ্বরকে একতরফা পুরুষ বানিয়ে ফেলেছেন। যার ক্ষুদে প্রমাণ, ইংরেজী ভাষা-সাহিত্যে ঈশ্বরকে ‘হি (ঐব)’ অর্থাৎ পুরুষবাচক সম্বোধন। অর্থাৎ ক্ষমতাধর সবকিছুই যেন পুরুষকেন্দ্রিক। ঈশ্বরকৃত নারী-পুরুষের বায়োলজিক্যাল বা শরীরী বিভেদ খ-ন অসম্ভব। কিন্তু সামাজিক, মানসিক এবং প্রথাগত দুষ্টিভঙ্গিগুলো, যা নারীকে অবরুদ্ধ করে ‘গ্রীন হাউজে’ সেসব ভাঙ্গা সম্ভব। তবে তা যদি সে চান। কারণ, বাজার-অর্থনীতির এই সময়ে নারীকে পণ্যের দরে-মানে উপস্থাপন এবং তাতে মুনাফার লালসা অনুসন্ধান উভয়মুখী আদান-প্রদানের ফসল। আর নারীবাদী আয়োজন নারীর সেই অসহায়ত্বের পোস্টার। কেননা এই ফোরামগুলো থেকে আওয়াজ তোলা হয়, ‘এই অধিকার চাই, সেই অধিকার চাই’। আর এখানেই ‘মৌলিক’ সমস্যা। কারণ, আপনি যখন কারও কাছে কিছু চাইছেন তার অর্থ উনি ওই ব্যবস্থার মালিক আর আপনি তার ভৃত্য। অর্থাৎ, নারী নিজেই প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন সমাজ ব্যবস্থার মালিকানা পুরুষের! যদিও লড়াইটা আরও মধুর হতে পারত! যেমন নারী-পুরুষ উভয়ে মিলে সাম্য-সমতা এবং ভালবাসার মানুষ হয়ে ওঠার অথবা আক্রান্ত হলে আক্রমণের, আত্মসমর্পণের নয়। লেখক : ছাত্রনেতা
×