ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

গেরিলা আক্রমণে নাজেহাল পাকবাহিনী ॥ ৩১ মে, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ৩১ মে ২০১৯

 গেরিলা আক্রমণে নাজেহাল পাকবাহিনী ॥ ৩১ মে, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ৩১ মে দিনটি ছিল সোমবার। বাঙালী ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্যই শেখ মুজিবুর রহমানকে ভোট দিয়েছিল। শেখ মুজিব আশা করেছিলেন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জনাসাধারণের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেশবাসী সেই আশাই করেছিল। দেশের মানুষ বুঝতে পারেনি যে, ধীরে ধীরে তারা এক চরম বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হতে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে ৫ মাস আগের জোয়ারে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রায় ১০ লাখ বাঙালী প্রাণ হারিয়েছে। পৃথিবীর কোন শক্তিই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে রুখতে পারে না, কিন্তু ত্রাণসামগ্রী বিতরণ কার্যক্রমে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি ক্ষমার অযোগ্য। সাম্প্রতিককালে ঢাকায় এক পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, ‘যদি সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে তার শুরুটা হবে এই বাংলায়ই।’ উপকূলীয় বাঁধটিই কেবল পারে এই ধ্বংস ঠেকাতে। আর কিছুই পারবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বারবারই বাঙালীদের বলে থাকে যে, এই বার্ষিক বন্যা, এর ধ্বংসাত্মক জোয়ার এবং খরা সবই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা, অথচ পশ্চিমের সাম্প্রতিক ইন্দো অববাহিকা প্রকল্প ওই মরুভূমি এলাকাকে উর্বর এক জমিতে পরিণত করেছে জলাবদ্ধতার সঙ্গে সংগ্রাম করে ও। এই দিন লে. মাহবুবের নেতৃত্বে এক প্লাটুন যোদ্ধা কুমিল্লার দক্ষিণে জগমোহনপুরে পাকসেনাঘাঁটির ওপর অকস্মাৎ আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকবাহিনীর ১২ জন সৈন্য হতাহত হয়। পাকবাহিনী ঝালকাঠি জেলার সুগন্ধা নদীর পাড়ে ১০৮ জন বাঙালীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্থানটি এক পর্যায়ে সুগন্ধা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও বর্তমানে সে স্থানটিতে চর জেগে উঠছে। মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার সিঙ্গারবিলে পাকসেনাদের ওপর এ্যামবুশ করে। এ আক্রমণে পাকবাহিনীর ১৩ জন সৈন্য নিহত হয়। পাকসেনাদের দখলকৃত শালদা রেলওয়ে স্টেশনে সুবেদার আবদুল হক ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল হানা দেয়। এ অভিযানে ২জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকবাহিনীর একটি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কুটি নামক গ্রামে হামলা চালায়। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর একজন ড্রাইভার নিহত হয় এবং একটি জীপ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারের নীতি নির্ধারণী রাজনৈতিক কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিষয়াদি ও তার ফলে ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতির বিষয় পর্যালোচনা করা হয়। কৃষক শ্রমিক পার্টির প্রধান এ.এস.এম সোলায়মান পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জেনেভা যাত্রা করেন। কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রাদেশিক সাধারণ সম্পাদক এ.এন.এম. ইউসুফ বলেন, ভারতীয় আক্রমণ থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানীরা প্রস্তুত। তারা আওয়ামী লীগের দেশভাগের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে পেরে এখন দলটি ফ্যাসিবাদী কাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তান জমিয়াতুল ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মওলানা হাজারভী ভারতীয় প্রচারণা মোকাবেলার উদ্দেশ্যে বিদেশে প্রতিনিধি পাঠানোর আহ্বান জানান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের অধিকাংশ সদস্যও বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কিত কমিটি পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য দেবার প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে। এই দিন আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘আমরা ক্ষান্ত হব না’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বুধবার হঠাৎ যখন তাদের সঙ্গে দেখা হলো, তখন বেলা সাড়ে চারটা; গরমে গলগল করে ঘামছি; ওরা মুক্তিফৌজের শ্রান্ত সৈনিকেরা খোলা জীপে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে আসছেন, সারারাত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে নাজেহাল করে। আগের রাতে আমার পৌঁছাতে দেরি হয়েছিল, তাই ওদের সঙ্গে নিতে পারেনি। দেখে আশ্চর্য লাগে, পাকিস্তান সরকারের এত সোচ্চার প্রচারের পরও বেনাপোলে পাকিস্তান ঘাঁটির শীর্ষে এখনও বাংলাদেশের জয়বাংলা পতাকা পতপত করে উড়ছে। দিনের বেলা এলে ছবি নিতে পারতেন। মুক্তিফৌজের ঘাঁটিতে একজন বললেন, যারা মনে করছেন আমরা শেষ হয়ে গেছি, আমরা এখনও শেষ হইনি। মাতৃভূমির দখল নেবার আগে আমরা ক্ষান্ত হব না। একই দিনে দৈনিক হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় ‘মুক্তিফৌজের আক্রমণে ১০০ পাকসেনা নিহত’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেনীর ও আশুগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিফৌজের তীব্র কমান্ডো হামলায় পাক বাহিনীকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে বিগত ৪৮ ঘণ্টা যাবত। পাকিস্তানী বাহিনীর ওপর হানা দিয়ে ব্যাপক হতাহত ঘটাচ্ছে মুক্তিফৌজ। সীমান্তে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ৪০ জন অফিসারসহ ১০০ এর উপরে পাকসেনা এ্যামবুশ করে হত্যা করেছে মুক্তিফৌজ। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি রেল ও একটি সড়ক সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। নষ্ট করা হয়েছে রেলের ইঞ্জিন, ধ্বংস করা হয়েছে ২টি মোটর ও বিভিন্ন যানবাহন। বিভিন্ন স্থানে রেলসেতু ধ্বংস করার সফল অভিযানের পর কুমিল্লা ও আশুগঞ্জের রেল যোগাযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×