ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সংস্কৃতি সংবাদ

প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী সুবীর নন্দী স্মরণানুষ্ঠান

প্রকাশিত: ০৯:৪৮, ৩০ মে ২০১৯

 প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী সুবীর  নন্দী স্মরণানুষ্ঠান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সুবীর নন্দী শুধু যে একজন কালজয়ী সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন তা নয়, একজন অত্যন্ত ভালমনের মানুষও ছিলেন। একজন ভাল মানুষের সমস্ত গুণ তার মধ্যে ছিল। তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছরের সঙ্গীত জীবনে আড়াই হাজারের বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। বাংলা গান ও বাঙালী সংস্কৃতিকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। বহুদিন ধরেই কিডনিসহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে তাকে দেখে কখনও এসব বোঝার উপায় ছিল না। তিনি রোগাক্রান্ত অবস্থায়ও যেভাবে সঙ্গীত সাধনা করে গেছেন এটি সত্যি অনুকরণীয়। জাতীয় প্রেসক্লাবে বুধবার সকালে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী সুবীর নন্দী স্মরণানুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’, ‘কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’সহ অসংখ্য কালজয়ী গানে শ্রোতার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন নন্দিত এ সঙ্গীতশিল্পী। সবাইকে শোকে ভাসিয়ে গত ৭ মে চিরবিদায় নেন একুশে পদকপ্রাপ্ত আধুনিক বাংলা গানের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী। তার প্রয়াণে কেঁদেছে অগণন ভক্তের অন্তর। সদ্যপ্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী সুবীর নন্দীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে আয়োজিত স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের উপদফতর সম্পাদক প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক কামাল চৌধুরী, এ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার, সঙ্গীতশিল্পী রফিকুল আলম, সঙ্গীতশিল্পী এসডি রুবেল, অভিনয় শিল্পী তারিন জাহান, সুবির নন্দীর মেয়ে ফাল্গুনী নন্দী, দিনার জাহান মুন্নি, সাংবাদিক মানিক লাল ঘোষ, আবদুল মতিন প্রধান ও মোতাসিম বিল্লাহ। অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অরুণ সরকার রানা। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ বলেন, আমার বক্তব্যের শুরুতে সুবীর নন্দীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। আমাদের দেশে এ বছর অনেক শিল্পীকে হারিয়েছি। সুবীর নন্দীকে হারিয়েছি, আয়ুব বাচ্চুকে হারিয়েছি, অভিনেতা টেলিসামাদকে হারিয়েছি, সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহসহ অনেককে হারিয়েছি। এ বছর এত শিল্পীকে আমরা হারিয়েছি এটা সত্যি খুবই দুঃখজনক। মন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে তরুণ সমাজের এক অংশ নানাভাবে বিপথগামী হচ্ছে, অনেকে নানাভাবে জঙ্গী মতাদর্শে উৎসাহিত হচ্ছে, এর থেকে তরুণ সমাজকে বারিত করার ক্ষেত্রে সঙ্গীতচর্চা তথা সংস্কৃতিচর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে আগে পাড়ায় পাড়ায় ব্যাপক সাংস্কৃতিকচর্চা হতো, অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল, এখন কিন্তু সেগুলো নেই। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সংস্কৃতিকে লালন করার চেষ্টা করছে। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটসহ দেশের সমস্ত সাংস্কৃতিক সংগঠনকে আমি অনুরোধ জানাই দেশের সাংস্কৃতিক চর্চাকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। সরকার কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনেক পদক্ষেপ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে। দুস্থ শিল্পীদের সহায়তা করার জন্য অনেক তহবিল গঠন করা হয়েছে। যখন কোন বরেণ্য শিল্পী অসুস্থ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের সাহায্যর্থে এগিয়ে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা একজন মানুষ। তার পরিবারেও সাংস্কৃতিক চর্চা হতো। কামাল ভাই গান গাইতেন, সেতার বাজাতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও একজন সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেও একজন সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ। তাই এমন একজন প্রধানমন্ত্রী যখন আমাদের আছে, আমি মনে করি যে সমগ্র বাংলাদেশে সংস্কৃতিচর্চা যদি আমরা ব্যাপকতর করতে পারি সেটি আমাদের তরুণ সমাজকে পরিশীলিত করার ক্ষেত্রে এবং একই সঙ্গে তারা অনেকে নানাভাবে যে জঙ্গী মতাদর্শে বিপথগামী হচ্ছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে, তাদেরকে সঠিক পথে রাখার ক্ষেত্রে এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমি বিশ্বাস করি, সঙ্গীতচর্চা মানুষকে পরিশীলিত করে। বিশেষ করে বাংলাদেশে সংস্কৃতিচর্চা নতুন প্রজন্মকে বিপথগামী হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার বলেন, বাংলা আধুনিক গানের কিংবদন্তি সুবীর নন্দী একজন নিরহঙ্কার মানুষ ছিলেন। অনেকেই জানেন তিনি একজন শিল্পী। এর বাইরে তিনি একজন ব্যাংকার ছিলেন। জনতা ব্যাংকের তিনি প্রিন্সিপাল অফিসার ছিলেন। আমার প্রথম তার সঙ্গে পরিচয় হয় ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। তখন আমি জনতা ব্যাংকের ডিরেক্টর। সঙ্গীত জগতে তার যে অবদান, তিনি কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে আজীবন বেঁচে থাকবেন। তাকে সুস্থ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সুবীর নন্দীর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক কামাল চৌধুরী বলেন, আমি সুবীর নন্দীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, আধুনিক বাংলা গানের কিংবদন্তিসম সুবীর নন্দী আমাদের মাঝে নেই, উনার শূন্যতা পূরণ হবার নয়। বাঙালীর মনে সুবীর নন্দীর গান বেঁচে থাকবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। আমার সুবীর দার অসুস্থতার শেষদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কিছু কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভাব্য যা কিছু করা যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাই করেছেন। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী সুবীর নন্দীর প্রতি আমার অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। সুবীর নন্দীর প্রয়াণে বাংলাদেশ একজন গুণী মানুষকে হারাল। সংগঠনের সহসভাপতি শিল্পী রফিকুল আলম বলেন, সুবীর দা শেষের দিকে এসে নিজেই গানে সুর করেন। অবশ্য আগেও কম-বেশি করতেন তবে শেষদিকে অনেক গানে সুর করেছেন। অনেকেই তার সুর করা গান করতেন। সঙ্গীতশিল্পী এসডি রুবেল বলেন, শয়নে-স্বপনে জীবনে-মরণে সুবীর নন্দী প্রত্যেকটি শিল্পী ও সচেতন নাগরিকের কাছে একটি উদাহরণ। কিভাবে একজন শিল্পী পৃথিবীতে অমর হয় তিনি এটার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশে। এ রকম গুণী শিল্পীরা যুগে যুগে খুব কম আসে। জোটের যুগ্ম সম্পাদক তারিন জাহান বলেন, তিনি যত বড় একজন শিল্পী ছিলেন তার চেয়ে বড় মাপের একজন মানুষ ছিলেন। শিল্পী হওয়ার থেকে ভাল মনের মানুষ হওয়াটা জরুরী। তার ছিল অমায়িক ব্যবহার। আমি মনে করি, কিংবদন্তির কোন মৃত্যু হয় না। একজন জাতশিল্পী কখনও মরে না। তিনি বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে, তার কর্মগুণে। সভাপতির বক্তব্যে সারা বেগম কবরী বলেন, সুবীর নন্দী শুধুমাত্র আধুনিক বাংলা গান নয়, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও তার দখলদারিত্ব ছিল। সব ধরনের গান তিনি গাইতেন। তিনি আপাদমস্তক একজন বাঙালী। শহর থেকে শুরু করে গ্রামবাংলা পর্যন্ত তার গান শোনেনি এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। তিনি এত জনপ্রিয় ছিলেন যে বলে শেষ করা যাবে না। তিনি আমার আত্মার পরম আত্মীয় ছিলেন। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের হৃদয় জয় করা একজন শিল্পী ছিলেন তিনি। আমি তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি, তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। সমগ্র অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন জোটের সাধারণ সম্পাদক অরুণ সরকার রানা।
×