ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পের জন্য আমদানি লবণ ‘খাদ্য লবণ’ হিসেবে বাজারে

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ৩০ মে ২০১৯

 শিল্পের জন্য আমদানি লবণ ‘খাদ্য লবণ’ হিসেবে বাজারে

এম শাহজাহান ॥ শিল্পের জন্য আমদানিকৃত বিষাক্ত সোডিয়াম সালফেট খাদ্য লবণ হিসেবে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। স্বাদ ও বর্ণ এক হওয়ার কারণে খাদ্য লবণের বিকল্প হিসেবে খুব সহজে সোডিয়াম সালফেট কারসাজিতে জড়িয়ে পড়ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। বাজারের এই লবণ খাওয়ার উপযোগী কিনা- তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তদন্ত করে বিসিককে দ্রুত প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে লবণের ঘাটতি পূরণ করছে বিষাক্ত সোডিয়াম সালফেট দিয়ে। বিষাক্ত এই লবণের পরিমাণ প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন। শিল্পের জন্য আমদানিকৃত বিষাক্ত লবণ ঢুকছে মানবদেহে। মানুষের শরীরে তৈরি হচ্ছে ক্যান্সার, ক্রনিক লিভার ডিজিস, গ্যাস্ট্রিক, আলসার ও ডায়াবেটিসসহ নানাবিধ অসুখ। এদিকে, নিম্নমান ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কায় বিএসটিআইয়ের কালো তালিকাভুক্ত ৫২টি পণ্য বাজার থেকে তুলে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে মহামান্য আদালত। খাদ্য লবণ নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে নিত্যপণ্যের বাজারে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে প্রকৃত লবণ উৎপাদন এবং চাহিদার তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে খোদ বিসিকের মধ্যেই। লবণের প্রকৃত উৎপাদনের চেয়ে বেশি দেখিয়ে কারসাজির চেষ্টা চলছে। আর এ কারণে ঘাটতি থাকার পরও খাদ্য লবণের পরিবর্তে বিনাশুল্কে অবাধে আসছে সোডিয়াম সালফেট। বর্ণ ও স্বাদ এক হওয়ার কারণে দ্রুত এসব লবণ প্যাকেটজাত করে খাবার লবণ হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। অবৈধ কারবারি চলছে লবণের বাজারে। জানা গেছে, লবণের উৎপাদনে আবহাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জলবায়ুজনিত ঝুঁকি, জমির পরিমাণ হ্রাস পাওয়া, বন্যা ও জ্বলোচ্ছাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কয়েক বছর ধরে লবণের উৎপাদন ধারাবাহিতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এ কারণে গত ২০১২ সালে লবণের চাহিদা পূরণে আমদানি উন্মুক্ত করে দেয় সরকার। এরপর থেকে ঘাটতি পূরণে প্রতিবছরই ৩ থেকে ৫ লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দিয়ে আসছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু সোডিয়াম সালফেট আমদানিকারকদের দৌরাত্ম্য ও কারসাজির কারণে খাদ্য লবণ এখন আর আমদানি হয় না। এতে করে দেশীয় লবণ শিল্প প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। মিলগুলো কাঁচা লবণ বা বোল্ডার না পেয়ে সারাবছর বন্ধ থাকছে। একই সঙ্গে চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে দেশের স্বাস্থ্য খাত। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, অভিযোগ রয়েছে খাদ্য লবণের পরিবর্তে বাজারে সোডিয়াম সালফেট বিক্রি হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি মাথায় রেখে ইতোমধ্যে বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তিনি বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত বিসিক এ বিষয়টি বিএসটিআইয়ের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। শুধু তাই নয়, সোডিয়াম সালফেট এনে যারা এটি বাজারে খাদ্য লবণ হিসেবে বিক্রি করছে তাদের ব্যাপারেও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। যারাই লবণ নিয়ে কারসাজি করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। জানা গেছে, দেশে প্রতিবছর লবণের চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিক টনের বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ১৬ লাখ মেট্রিক টন। ফলে খাদ্য লবণের ঘাটতি রয়েছে ৭/৮ লাখ মেট্রিক টন। বিপুল পরিমাণ এই ঘাটতি গত দু’বছর ধরে সোডিয়াম সালফেট দিয়ে পূরণ করা হচ্ছে। এছাড়া সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে আবার কিছু ব্যবসায়ী সোডিয়াম ক্লোরাইড বা খাদ্য লবণও আনছে। সেক্ষেত্রে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বাজারে আনা হচ্ছে এসব লবণ। এতে লবণ শিল্পের প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নূরুল কবির জনকণ্ঠকে বলেন, লবণের প্রকৃত উৎপাদনের চেয়ে বেশি দেখিয়ে কারসাজির চেষ্টা চলছে। দেশীয় লবণের চাহিদার ব্যাপারে বিসিকের কাছ থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য আসছে। আর এ কারণে অবাধে আমদানি হচ্ছে সোডিয়াম সালফেট যা পরবর্তীতে বাজারজাত করছে ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, কাঁচামালের অভাবে দেশের প্রায় ২০০ লবণ মিল বন্ধ রয়েছে। সময়মতো কাঁচামাল পাওয়া যাচ্ছে না। এ শিল্প আজ ধ্বংসের মুখে পড়েছে। জানা গেছে, উৎপাদনের জমি প্রতিবছর ব্যাপকহারে হ্রাস পাচ্ছে। লবণ উৎপাদর এলাকা মহেশখালী-মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল এবং অন্যান্য শিল্প গড়ে ওঠার কারণে লবণ উৎপাদনের জমি সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। তাদের মতে, দেশে বর্তমান ৪৫ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন করা হচ্ছে। যদিও বিসিকের তথ্যমতে লবণ উৎপাদন হচ্ছে ৬০ হাজার একর জমিতে। বাংলাদেশ লবণ মিল সমিতির তথ্যমতে, দেশে লবণের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান শিল্প উন্নয়ন বিশেষ করে চামড়া শিল্প, ডিটারজেন্ট শিল্প, ডাইং-প্রিন্টিং, হোটেল শিল্প, ওষুধ শিল্প, বেভারেজ- শিল্প আচার, মুড়ি, চানাচুর, বেকারি ও পাওয়ার প্লান্ট প্রভৃতি খাতে লবণের প্রয়োজন প্রায় ৭ লাখ মেট্রিক টন। প্রাণিসম্পদ ও হরটিকালচার খাতে ৩ লাখ মেট্রিক টন, মৎস্য ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে ৫০ হাজার মেট্রিক টন, ভোজ্য লবণ ৯ লাখ মেট্রিক টন এবং বরফ, পোল্ট্রি ফিড ও অন্যান্য খাতে ৫০ হাজার মেট্রিক টন লবণের চাহিদা রয়েছে। এ হিসেবে বছরে লবণের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ মেট্রিক টন। এদিকে বিসিকের তথ্যমতে দেশে লবণের চাহিদা ১৪ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে শিল্প খাতে পৌনে চার লাখ এবং ৮ লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন ভোজ্য লবণের চাহিদা দেশে রয়েছে। তাদের এই তথ্য সঠিক নয় বলে মনে করে বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতি ও ট্যারিফ কমিশন। ফলে দেশে লবণের চাহিদা ও ঘাটতির তথ্য নিয়েও এক ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে।
×