ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তিস্তার তীরে বাঁধ সংস্কার শুরু

প্রকাশিত: ০৯:১৮, ৩০ মে ২০১৯

তিস্তার তীরে বাঁধ সংস্কার শুরু

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর, ২৯ মে ॥ দখলে এবং অযত্নে অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছে তিস্তা নদীর ডান তীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। নদী ভাঙ্গনকবলিত শত শত মানুষ এ বাঁধে বসতি গেড়েছে। বাঁধের অধিকাংশ স্থান কেটে সমতল করে স্থানীয় কিছু মানুষ দোকান-পাট ও বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলেছে। ফলে রংপুর শহর এবং এ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকাকে তিস্তার করাল গ্রাস থেকে বাঁচানোর জন্য নির্মিত এ বাঁধটি এখন বিলীন হতে বসেছে। এটি নির্মাণ করা হয় ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর সময়ে। নির্মাণের পর ৪৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ গুরুত্বপূর্ণ বাঁধটির সর্বশেষ সংস্কার হয় ১৯৮৫ সালে। এরপর ১৯৮৮ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি বাঁধের ওপর গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক অবৈধ বসতি। বাঁধের ওপর থেকে অবৈধ বসতি উচ্ছেদ করে বাঁধ সংস্কারের জন্য অনেকবার উদ্যোগ নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ এবং দখলদারদের আন্দোলনের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। আশার কথা হচ্ছে, সরকারের দৃঢ় অবস্থানের কারণে সম্প্রতি এর পুনরাকৃতিকরণ ও সংস্কারের কাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। পাউবো সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন অরক্ষিত থাকায় নীলফামারীর জলঢাকার শোলমারী ও নোহালী সীমান্ত থেকে রংপুরের কাউনিয়ার নিচপাড়া পর্যন্ত এ বাঁধের বেশির ভাগই অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে যায়। গড়ে ওঠে অন্তত দুই হাজার বসতঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা। হুমকির মুখে পড়ে পুরো বাঁধ। এ পরিস্থিতিতে সর্বশেষ সংস্কারের প্রায় ৩৪ বছর পর গত বছরের ১৯ নবেম্বর বাঁধটির পুনরাকৃতিকরণ ও সংস্কারের কাজ শুরু করা হয়। ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচটি প্যাকেজে চলমান এ কাজ শেষ হওয়ার কথা আগামী ২৮ জুন। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে বাঁধের ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল ও তিস্তা নদী ড্রেজিং করে দুই পাড় সংরক্ষণে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না পাওয়ারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে পাউবো রংপুর উপবিভাগ-১-এর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ) মোঃ গোলাম যাকারিয়া বলেন, বাঁধটি নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল রংপুর নগরী, গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া উপজেলাকে তিস্তার ভাঙ্গন থেকে রক্ষা করা। কিন্তু অবৈধ দখলদারদের পাশাপাশি ১৯৮৮ সালের বন্যার কারণে বাঁধটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাঁধের প্রস্থ কমপক্ষে ১৪ ফুট থাকার কথা থাকলেও অবৈধ দখলের কারণে অনেক স্থানেই তা নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাঁধের নীলফামারীর শোলমারী ও গঙ্গাচড়ার নোহালী এলাকায় এখনও অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে তেমন অগ্রগতি হয়নি। তবে কাউনিয়া, হারাগাছ পৌর এলাকা ও গঙ্গাচড়ায় বাঁধের অধিকাংশ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বাঁধ সংস্কারের কাজ এগিয়ে চলছে। এক্ষেত্রে বসবাসকারী দখলদারদের সরিয়ে নিতে সাহায্য করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। এ বিষয়ে হারাগাছ উপজেলার পৌর মেয়র মোঃ হাকিবুর রহমান বলেন, বাঁধ সংস্কারের কাজ শুরু হওয়ায় আমরা আনন্দিত। বাঁধে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে পাউবো কর্তৃপক্ষকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হচ্ছে। এ সংস্কার কাজ শেষ হলে এলাকাটি নদীভাঙ্গন থেকে সুরক্ষিত থাকবে। তবে তিনি স্থানীয়দের চলাচলের সুবিধার্থে বাঁধসংলগ্ন রাস্তা উঁচু করে দেয়ার জন্য পাউবো কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সার্বিক বিষয়ে পাউবো রংপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বলেন, বাঁধটির বেশকিছু স্থান এখনও বেশ ভাল আছে। ফলে বাঁধের প্রায় নয় কিলোমিটার সংস্কারের প্রয়োজন পড়বে না। বাকি ৩৫ কিলোমিটার সংস্কারে কাজ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে কাউনিয়া ও গঙ্গাচড়ায় বাঁধে বসবাসকারীদের উচ্ছেদের পর সংস্কারের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। কিন্তু নীলফামারীতে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে পুরো কাজ শেষ করা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, বড় বাঁধ নির্মাণের সময় বাঁধের পাশে বড় গর্ত করে মাটি তুলতে হয়। এ মাটি দিয়েই বাঁধ উঁচু করা হয়। তিস্তার ডান তীর সংস্কারেও একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে শুধু মাটি বহনের টাকা দেয়া হচ্ছে। পরে এসব গর্ত স্থানীয়দের মাছ চাষের জন্য লিজ দেয়া হবে। তাছাড়া এখন বাঁধে ঘাস লাগানোর পরিকল্পনা থাকলেও পরবর্তী সময়ে বনায়নের চিন্তা রয়েছে। একই সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে বাঁধ দিয়ে যানবাহন চলাচলসহ তিস্তা নদীর ড্রেজিং ও তীর সংরক্ষণে চায়না পাওয়ারের সঙ্গে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। রংপুর মেট্রোপিলটন চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট রেজাউল ইসলাম মিলন বলেন, উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি। এ বাঁধ দিয়ে যানবাহন চলাচলের পরিকল্পনা গাইবান্ধা হয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত বৃদ্ধি করা গেলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নীলফামারীতে বাঁধটি শুরু হয়ে রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া হয়ে গাইবান্ধার সুন্দগঞ্জে প্রবেশ করেছে। তারপর এটি গাইবান্ধা সদরে প্রবেশ করেছে। তিস্তার পাড় ঘেঁষে নির্মিত বিশাল এ বাঁধটি সংস্কার করে এর দু’পাশে বনায়ন করা গেলে তা নদী ভাঙ্গন রক্ষার পাশাপাশি যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। অপরদিকে, বাঁধের উপর থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষগুলোকে অন্য কোন চরে পুনর্বাসন করার কথা থাকলেও এখনও তা করা হয়নি। বাঁধ থেকে উচ্ছেদ হওয়া হারাগাছ পৌরসভার বাসিন্দা দিনমজুর আবদুল হামিদ জানান, তিস্তা নদীর চরে আমাদের জমিজমা হাল গেরস্তি সবই ছিল। নদী ভাঙ্গনের পর সব হারিয়ে আমরা বাঁধের উপর আশ্রয় নিয়ে প্রায় ১৫ বছর থেকে বসবাস করছি। আমাদের মাথা গোঁজার কোন ঠাঁই নেই। তার মতো অসংখ্য মানুষ উচ্ছেদ হওয়ার পর গৃহহীন হয়ে পড়েছে। তাদের দাবি, আমরা বাঁধের জায়গা ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমাদের অন্য কোন জায়গায় পুনর্বাসন করা হোক। হারাগাছ পৌর মেয়র হাকিবুর রহমান জানান, উচ্ছেদ হওয়া প্রকৃত ভূমিহীনদের তালিকা করা হচ্ছে। তাদের সকলকে তিস্তা চরের খাস জমিতে পুনর্বাসন করা হবে।
×