১৯৭১ সালের ৩০ মে দিনটি ছিল রবিবার। এই দিন সুইডেনের সকল রাজনৈতিক দল যুক্তভাবে ঘোষণা করেছে বাংলাদেশে ইসলামাবাদের লেলিয়ে দেয়া জল্লাদদের নির্বিচার হত্যালীলা বন্ধ করতেই হবে। বাংলার নির্যাতিত জনগণের সকল গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনে জানিয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন। সুইডেনের ইতিহাসে এই প্রথমবার দলমত নির্বিশেষে সবাই এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বের শুভ বিবেকের এই কণ্ঠস্বরকে জানাচ্ছে অকুণ্ঠ অভিনন্দন। লাখ লাখ স্বাধীনতাকামী জনতা উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে। বাঙালীর লড়াই আজ তাই সুনিশ্চিত বিজয়ের পথে। ইন্দোনেশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও ইন্দোনেশীয় পার্লামেন্টের স্পীকার মিঃ জাইচেক বিশ্ব মুসলিম সমাজের কাছে বাংলাদেশকে সহায়তার আবেদন জানিয়েছেন। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার হানাদার সেনারা বর্বরতা ও নৃশংসতার যে বীভৎস ইতিহাস রচনা করছে তার তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীর ওপর অকারণে ইয়াহিয়ার সেনারা যে নির্যাতন চালাচ্ছে তার প্রতিবাদে আওয়াজ তোলার জন্যে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্বের সকল মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি। তিনি বলেছেন, বিশ্বের অন্যতম প্রধান মুসলিম রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীর স্বাধীনতার দাবি উপেক্ষা করতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের অধিকাংশ সদস্য দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বাংলার জনগণের প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণা করেছেন। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, সিনেটর জেমস উইলিয়াম ফুলব্রাইট এবং আরও কয়েক প্রভাবশালী সিনেটর দৃঢ়কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছেন- পাকিস্তানের জঙ্গী সরকার বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালাচ্ছে তাকে সমর্থন করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। সিনেটের বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কিত কমিটি পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য দেবার প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে। এইদিন মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল ইকবালের নেতৃত্বে গোমতী বাঁধের ওপর থেকে পাকবাহিনীর বিবিবাজারস্থ অবস্থানে আঘাত হানে। এতে পাকবাহিনীর ১০ সৈন্য হতাহত হয়। কুমিল্লার সিঙ্গারবিলে পাকসেনাদের অবস্থানের ওপর মুক্তিবাহিনী মর্টারের সাহায্যে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ৬ সৈন্য নিহত ও ৭ জন আহত হয়। চৌদ্দগ্রামের আধা মাইল উত্তরে চৌদ্দগ্রাম-মিয়ারবাজার সড়কের ওপর ৪র্থ বেঙ্গল-এর ‘বি’ কোম্পানির এক প্লাটুন যোদ্ধা পাকবাহিনীর ২৭ জনের একটি দলকে এ্যামবুশ করে। মুক্তিবাহিনীর এ তৎপরতায় ৩ পাকসেনা নিহত হয়। এইদিন নগরকান্দা উপজেলার কোদালিয়া গ্রামে গণহত্যা চালায় স্থানীয় দোসর ও পাকিস্তানী সেনারা। মুকসুদপুর, ভাঙ্গা, নগরকান্দা, কাশিয়ানীসহ চতুর্দিক থেকে শত শত পাকিস্তানি সেনা গুলি করতে করতে গ্রামে প্রবেশ করে। যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করে হত্যা করেছে। সেদিন ১৮ নারীসহ ৩৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মধুখালী উপজেলার গাজনা এলাকায় ১৩ জনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানী সেনারা। বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের ছোট একটি গ্রাম কাঠিরা। সেদিন দুপুর আড়াইটা নাগাদ ৪০টি রিক্সায় খুব ভোরে মিলিটারিরা গৌরনদী থেকে কাঠিরা গ্রামে আসে। এদিন কাঠিরার পূর্ব-উত্তর কোণ বরাবর অবস্থিত ঘোড়ারপাড় গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে কাঠিরা গ্রামে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায় পাকিস্তানী মিলিটারি, যাদের প্রধান সহযোগী ছিল প্রফুল আরিন্দা। আসার পথে তরুণ সেনপাড়ার অনেক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ও অসংখ্য গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এই দিন পঞ্চাশ জনের বেশি মানুষকে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক বিবৃতি প্রসঙ্গে বলেন, ইয়াহিয়া মিথ্যাবাদী ও প্রতারক। তার কোন কথাই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
এদিন ঢাকায় সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেন, জাতীয় পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে পাকিস্তানের অখ-তার প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। এইদিন পিটিআইর বরাতে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় ‘মুক্তিফৌজের অতর্কিত আক্রমণে শত্রুসৈন্য অতিষ্ঠ’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, মুক্তিফৌজের গেরিলা ও কমান্ডোরাও শ্রীহট্ট, কুমিল্লা ও নোয়াখালী সেক্টরে পাকসেনাদের ঘাঁটিগুলোর ওপর প্রচন্ড আঘাত হেনেছেন। আজ এখানে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় যে, শ্রীহট্টে মুক্তিফৌজের আচমকা আক্রমণে ৪০ পাকসেনা খতম হয়, তিনটি মোটরযান বিধ্বস্ত হয় এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ মুক্তিফৌজের হস্তগত হয়। এদিন মুক্তিফৌজের কমান্ডোরা যশোর এলাকার উথালীতে দুটি রেলসেতু এবং রংপুর সেক্টরে হিলি ও সান্তাহারের মধ্যে ১টি রেলসেতু উড়িয়ে দেন। রংপুর জেলার তাজপুরে পাকিস্তানীদের সঙ্গে মুক্তিসেনাদের সংঘর্ষ হয়। মুজিবনগর থেকে ইউএনআই জানাচ্ছে: মুক্তিফৌজের গেরিলা সৈন্যরা উত্তর ও পশ্চিম রণাঙ্গনে গত ৪ দিনে কয়েকটি সড়কপথ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ায় কয়েকটি স্থানে পাকসৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কয়েকবার আচমকা আক্রমণে তারা অন্ততপক্ষে ৮১ পাকসৈন্যকে খতম করেন। মুক্তিসেনারা বিরণ ও কাঞ্চনপাড়া স্টেশনের মধ্যে রেললাইন বিধ্বস্ত করে দেন। পশ্চিম রণাঙ্গনের তুলাই ও কিশোরীপুরের মধ্যেও তারা রেলপথ অকেজো করে ফেলেন। রংপুর সেক্টরে পাকসৈন্যবাহিনীর একখানি ট্রেন আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ট্রেনটি স্বর্ণমতির দিকে যাচ্ছিল। এই ঘটনায় অনন্ত ১০ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
[email protected]