ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা

প্রকাশিত: ০৮:৫৮, ৩০ মে ২০১৯

 কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা

সারাদেশে ধান-চালের বাম্পার ফলন হওয়ায় যে সময়ে এর ন্যায্যমূল্য না পাওয়া নিয়ে কৃষক দিশেহারা এবং বিভিন্ন স্থানে ক্ষোভ-দুঃখ-অভিমানে পাকা ধানক্ষেতে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটছে, ঠিক তখনই কৃষকদের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা দায়েরসহ গ্রেফতারি পরোয়ানা খবরের বিষয়টি শুধু পরিহাস নয়, দুঃখজনকও বটে। অথচ দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপীদের দ্বিতীয় দফায় মাত্র ২ শতাংশ সুদে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অবশ্য আপাতত এটি স্থগিত রয়েছে হাইকোর্টের নির্দেশে। দেশ ও জাতির জন্য উদ্বেগজনক এই তথ্য উঠে এসেছে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন আয়োজিত ‘ধান ও কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য : সঙ্কট ও প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এক সেমিনার। কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা করার বিষয়টি অমানবিক, দুঃখজনক ও অগ্রহণযোগ্য। কৃষকের নামে মামলা করার বিষয়ে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৫ সালে কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা না করে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়ে সার্কুলার জারি করে। তার পরও সেই নির্দেশ মানছে না সরকারী ব্যাংকগুলো। কিছু মামলার নিষ্পত্তি হলেও আবার নতুন করে জারি করা হয়েছে সার্টিফিকেট মামলা। বর্তমানে জনপ্রতি গড়ে ৩০ হাজার টাকা ঋণ আদায়ের জন্য সারাদেশের প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার ৪৮৫ কৃষকের বিরুদ্ধে ঝুলছে সার্টিফিকেট মামলা, যার সূত্রপাত ১৯৯১ সালে। জারিকৃত মামলাগুলোর মধ্যে আবার ওয়ারেন্ট তথা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার কৃষকের বিরুদ্ধে, যারা অর্থ পরিশোধ করতে না পেরে জেল-জুলুমের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অধিকাংশ কৃষকই আবার বর্গাচাষী, যাদের নিজস্ব কোন জমি-জিরেত নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খড়া, বন্যা, পোকামাকড় অথবা অন্য কোন কারণে ফসল মার খেয়েছে তাদের। ফলে যথাসময়ে কৃষি ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। আবার মামলা রুজু করায় নতুন করে ব্যাংক ঋণও নিতে পারছেন না। সে অবস্থায় অসহায় একজন কৃষকের দুরবস্থা সহজেই অনুমেয়। পৌনে দু’লাখ কৃষকের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকের পাওনার পরিমাণও বেশি নয়, কয়েক শ’ কোটি টাকা মাত্র। অথচ কত হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপী ঋণ হিসেবে পড়ে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। প্রভাবশালীদের চাপে এবং কিছুটা রাজনৈতিক কারণেও বটে, সরকার তথা ব্যাংকগুলো তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নিতে পারে না। স্বাধীনতাউত্তর বালাদেশ পুনর্গঠনে সার্বিক অবদান যে কৃষকদের তা অস্বীকার করা যাবে না কিছুতেই। দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি এখন পর্যন্ত বাংলার কৃষক। খাদ্য ঘাটতির দেশটিকে তারা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বিরূপ প্রকৃতি উপেক্ষা করে খাদ্যে প্রায় স্বনির্ভর করে তুলেছেন। সময়ে সময়ে সরকারের তথা কৃষি মন্ত্রণালয় তাদের সার-বীজ-সেচ-বিদ্যুত-ডিজেল ইত্যাদি দিয়ে কিছু প্রণোদনা দিলেও উৎপাদিত ফসল অথবা পণ্যের যথার্থ বাজারমূল্য না পেলে কৃষক পরিবার-পরিজনসহ বেঁচে থাকে কি করে? ফলে অভাব-অনটন-দারিদ্র্যের কশাঘাত বাংলার কৃষকের নিত্যসঙ্গী যেন। সে অবস্থায় কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা দায়েরের বিষয়টি অনেকটা অর্থহীনও বটে। এও সত্য যে, যেসব ব্যাংক ম্যানেজার বা কর্মকর্তা মামলা দায়ের করেন কৃষকের বিরুদ্ধে, তাদেরও কিছু দায়বদ্ধতা আছে। ঋণ তামাদি হয়ে গেলে জবাবদিহির মুখে পড়তে হয় তাদেরও। আটকে থাকে পদোন্নতি, বদলি ইত্যাদি। সে ক্ষেত্রে দুই কুলই রক্ষা করা অনিবার্য হয়ে পড়ে। এ থেকে পরিত্রাণের পথ বের করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। সাধারণ অসহায় নিরীহ কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা যেমন কাক্সিক্ষত নয়, তেমনি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বার্থও রক্ষা করতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বোপরি খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের নীতি নির্ধারকরা এক সঙ্গে বসে এই সমস্যায় একটি সুষ্ঠু সমাধান বের করতে পারেন।
×