ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সমঝোতার পথে তালেবান ও আমেরিকা

প্রকাশিত: ১২:২১, ২৯ মে ২০১৯

সমঝোতার পথে তালেবান ও আমেরিকা

আফগানিস্তান প্রায় ৪০ বছর ধরে যুদ্ধ ও সংঘাতে বিক্ষত। নাইন ইলেভেনের পর আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে তালেবান উৎখাতের প্রায় ১৮ বছর হয়ে গেছে। গত অক্টোবর থেকে দুই শত্রু আমেরিকা ও তালেবান সরাসরি আলোচনায় বসেছে। আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে নেবে। তবে তার বিনিময়ে তালেবানকে অঙ্গীকার করতে হবে যে তারা সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয় দেবে না। সর্বশেষ দফা আলোচনা গত ৯ মে কাতারে সম্পন্ন হয় এবং তাতে কিছু অগ্রগতি ঘটেছে বলে তালেবানরা উল্লেখ করেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে কাতারে তালেবানরা এক ধরনের দূতাবাস চালু রেখেছে। দু’পক্ষের মধ্যে যখন আলোচনা চলছে তখন যুদ্ধও তীব্রতর আকার ধারণ করেছে। সিভিলিয়ান হতাহতের দিক থেকে গত বছরটি ছিল ভয়াবহতম বছর। ১৮ বছরের যুদ্ধের যে কোন সময়ের তুলনায় গত বছর আমেরিকা সে দেশে বোমাবর্ষণ করেছে বেশি। কিন্তু আমেরিকার এই সমর্থন সত্ত্বে¡ও আফগান সরকারী বাহিনী কিছুতেই তালেবানদের সঙ্গে পেরে উঠছে না বরং ভূখ-ের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। দেশটির মাত্র অর্ধেক এলাকা এবং জনগোষ্ঠীর দুই-তৃতীয়াংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে। তালেবানরা নিয়মিতই পুলিশ ও সেনা চৌকিতে হামলা চালিয়ে তাদের পর্যুদস্ত করছে। কখনও কখনও গোটা শহর দখল করে নিচ্ছে। আফগানিস্তানের কোন জায়গাই এখন পরিপূর্ণরূপে নিরাপদ নয়। এমন কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে যে কাবুলের দোর গোড়ায় তালেবানদের উপস্থিতি অত্যাসন্ন। তালেবানরা যে জিততে চলেছে তার একটা কারণ আফগান সরকারের ওপর জনগণের ক্ষোভ ও অসন্তোষ। পাশ্চাত্যের সমর্থনপুষ্ট আফগান সরকার গঠিত হওয়ার ১৮ বছর পরও জনগণকে মৌলিক পরিসেবা প্রদানে সক্ষম নয়। এই সরকারের বিশাল নিরাপত্তাবাহিনী, সুবিশাল আমলাতন্ত্র ও বিপুল সংখ্যক স্মার্ট টেকনোক্র্যাট রয়েছে। তার পরও এই সরকারের পরিচালিত রাষ্ট্রটি বহুলাংশেই অরাজক, দুর্বল ও অকার্যকর। কোন কোন স্থানে স্কুল ও ক্লিনিক আছে। কিন্তু শিক্ষকরা ঠিকমতো বেতন পায় না বলে কাজেও উপস্থিত হয় কদাচিৎ। অন্যান্য জনসেবা ব্যবস্থার অস্তিত্ব নেই। সরকারের সবচেয়ে দৃশ্যমান অংশটা হলো পুলিশ। বেশিরভাগ চুরি তাদের দ্বারাই হয়। একটা কার্যকর রাষ্ট্র গড়ে তোলা যে কঠিন কান্দাহারেই তা পরিষ্কার। এই কান্দাহার ও তার পার্শ্ববর্তী হেলমন্দ প্রদেশ দেশকে অন্ন যোগায়। এসব এলাকার বেশিরভাগ মানুষ আফগানিস্তানের প্রধান জাতি পশতু। কান্দাহার প্রদেশেই তালেবান আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। এখানেই তারা ন্যাটোর দখলদারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নতুন করে সংগঠিত হয়। বলা হয় কান্দাহার নিরাপদ থাকলে আফগানিস্তানও নিরাপদ। কিন্তু কান্দাহার মোটেই নিরাপদ নয়। কান্দাহার থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরের এলাকা তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে। মাঝে মাঝেই তাদের হামলা হচ্ছে। প্রদেশের প্রান্তভাগের গ্রামাঞ্চল তারা নিয়ন্ত্রণ করলেও তাদের প্রভাব অনেক বেশি ব্যাপক প্রসারিত। নিজেদের এলাকায় তারা টোল ও কর আদায় করে। আফিমের ব্যবসা করে। তারা আফিম তৈরির কারখানা চালায়, চোরাচালানের রুট নিয়ন্ত্রণ করে, আফিম চাষীদের কাছ থেকে ফসলের কর আদায় করে। সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তালেবানদের জনসমর্থন আদায় করা সহজ হয়েছে। কারণ ওরা এমন সব প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণ চালায় যেগুলো ঘোরতর অজনপ্রিয়। সরকারী বাহিনী জনগণের কাছে টাকা চায়। তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের অসন্তোষ প্রকাশের উপায় নেই। অতি সামান্য কয়েকটি যে উপায় আছে তার মধ্যে একটি হলো তালেবানদের পক্ষাবলম্বন করা। সরকারের চাইতে তালেবানদের জনগণের কাছে জবাবদিহিতা বেশি সেটাও নয়। শহরে সিভিলিয়ানদের ওপর হামলা তাদের দারুণ অজনপ্রিয় করে তুলেছে। তবে গ্রামাঞ্চলে তাদের জনপ্রিয়তা আছে। তারা দক্ষ প্রশাসক। সরকারের স্বৈরাচারী শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা রাখে। গ্রামাঞ্চলে জমি নিয়ে বিরোধ ৭০ শতাংশ সহিংস অপরাধের জন্য দায়ী। তালেবানরা তাদের এলাকায় এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিচারক নিয়োগ করেছে যারা নির্মমভাবে এসব বিরোধ মিটিয়ে থাকে। তালেবানদের সঙ্গে এখন আমেরিকার আলোচনা চলছে। ট্রাম্প চাইছেন আগামী নির্বাচনের আগে আফগানিস্তানে অর্থ ব্যয় ও প্রাণহানি হ্রাস করতে। সম্প্রতি তিনি বলেছেন আফগানিস্তানে মার্কিন উপস্থিতি হাস্যকর। এর একটা অবসান ঘটানো দরকার। দুই পক্ষই একটা সমঝোতায় পৌঁছার জন্য পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে যেখানে আমেরিকা সন্ত্রাসী ধরার জন্য অল্প কিছু সৈন্য ছাড়া বেশিরভাগ সৈন্যই দেশে ফিরিয়ে নেবে। আর তালেবানরা যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেবে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×