ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক (ডাঃ) কামরুল হাসান খান

ফেরদৌস আলম রঞ্জু ॥ ব্যালাড অব এ সোলজার

প্রকাশিত: ০৯:১০, ২৯ মে ২০১৯

ফেরদৌস আলম রঞ্জু ॥ ব্যালাড  অব এ সোলজার

১৯৫৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাড়া জাগানো চলচ্চিত্রের নাম ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’। ছবিতে ১৯ বছর বয়সের একজন সাধারণ সৈনিক আলিওশার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অংশগ্রহণ নিয়ে রূপায়িত। আলিওশা যুদ্ধক্ষেত্রে দুটি নাৎসি ট্যাংক ধ্বংস করে। এ জন্য তার কমান্ডার তাকে পুরস্কৃত করতে চায় কিন্তু সে তার মাকে দেখার জন্য ছুটি দাবি করে। তাকে ছয় দিনের ছুটি মঞ্জুর করে। পথে সে রাশিয়ার অনেক ধ্বংস স্তূপের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে এবং নানা ধরনের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। অসহায় যুদ্ধাহত নানা মানুষকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে তার সময় চলে যায়। এর মধ্যে এক মেয়ের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে উঠে। যখন সে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে মায়ের কাছে পৌঁছে তখন তার হাতে সময় ছিল কয়েক মিনিট। মাকে দেখে সে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে তার ইউনিটে ফিরে যায়। ছবিটির হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য হলো সন্তানের জন্য মায়ের অপেক্ষা। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় এ রকম একটি দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। জুলাই মাস- বর্ষাকাল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ খুঁজছিলাম। টাঙ্গাইলের বাসাইল থানার ফুফুর বাড়ি ঝনঝনিয়ায় আছি। একদিন সকাল নাগাদ চানু মামাদের বাহির বাড়ি যাই। দেখি হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য, বাবা-মা বাড়ির বাহির উঠানে দাঁড়িয়ে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে, দুজনেরই দু’চোখ ভরা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে নীরবে। সামনেই ঘাটে একটি ছোট নৌকায় উঠছে তার একমাত্র পুত্র রঞ্জু। ছোট নৌকায় দুই দিকে মাঝি আর মাঝখানে একা রঞ্জু দাঁড়িয়ে। ঘাট থেকে নৌকা ছাড়ল- রঞ্জু অশ্রুসজল নৌকায়, বাবা-মা পাড়ে- যতক্ষণ না চোখের আড়াল হলো দূরের বাড়িঘর-গাছ-গাছালির আড়ালে। অতি সম্প্রতি কাদেরিয়া বাহিনীর হিরো কোম্পানির কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌস আলম রঞ্জু হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেছেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। অনেকটা নীরবেই চলে গেল এই মহান মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭০-এ বিশ বছরের সুদর্শন যুবক ফেরদৌস আলম রঞ্জু টাঙ্গাইল শহরের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী। টাঙ্গাইলের যে কোন গানের অনুষ্ঠানে রঞ্জুর উপস্থিতি অপরিহার্য। তখন জনপ্রিয় শিল্পী আব্দুল জব্বারের ‘তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়’ গানটি তুমুল জনপ্রিয়। রঞ্জুর কণ্ঠেও টাঙ্গাইলে তখন এ গানটি ছিল প্রধান আকর্ষণ। রঞ্জুকে কখনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে, মিছিলে, স্লোগানে দেখেনি। অতি সহজ, সরল, বিনয়ী একজন মানুষ, পিতা-মাতার একমাত্র পুত্র। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে কি এমন যাদু ছিল যে- সমাজের সর্বস্তরের কিশোর, তরুণ, যুবক মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে। কাদেরিয়া বাহিনীর গেরিলা যুদ্ধের বিজয় কাহিনী শিহরিত করেছে তরুণ সমাজকে। প্রতিরাতে মর্টার, এলএমজি, এসএলআরের শব্দ না শুনলে ঘুমই হতো না। কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগদান করার জন্য দলে দলে কিশোর-যুবকরা হারিয়ে যেতে থাকল শহর থেকে। জীবন দানের জন্য সে কি এক উন্মাদনাÑ মহোৎসব সে অনুভূতি কোনভাবেই বোঝানো যাবে না। পরের সপ্তাহেই পেয়ে গেলাম আমাদের আকুর টাকুর পাড়ার মুসা ভাইকে (খন্দকার মুসা চৌধুরী)। ঝনঝনিয়ায় চেয়ারম্যান বাড়িতে উঠেছেন। বিকেলে রওনা হবেন বহেরাতৈলের দিকে নৌবহর নিয়ে। ফুফুকে বলে আমি সহযাত্রী হলাম মুসা ভাইয়ের বাহিনীর সঙ্গে। সারারাত নৌকায় পাড়ি দিলাম দীর্ঘপথ। শেষরাতে পৌঁছলাম নকুল বিল পেরিয়ে কাদেরিয়া বাহিনীর দ্বিতীয় ক্যাম্প বহেরাতৈল যেখানকার কমান্ডার খন্দকার মুসা চৌধুরী। সকালে উঠে দেখলাম মনোমুগ্ধকর জায়গা- রেঞ্জার সাহেবের বাংলো, অফিস, পাশেই বাজার আর সামনে সমুদ্রের মতো নকুল বিল, ঘন গজারির বন তো আছেই। এ ক্যাম্পে প্রায় শ’তিনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুসা ভাই ছাড়া কাউকে চিনতে পারিনি। অতি সাধারণ মানুষÑ বেশির ভাগ শ্রমিক কৃষক। কিছু পুলিশ, ইপিআরের সৈন্য, কিছু ছাত্র, আমার বয়সই একজনই- এসএসসি পরীক্ষার্র্থী। ট্রেনিং চলছে। একদিন হঠাৎই দেখলাম কাদেরিয়া বাহিনীর হেড কোয়ার্টার মহানন্দপুর থেকে ফিরছেন আমাদের বিন্দুবাসিনী স্কুলের মেধাবী ছাত্র সালাউদ্দীন ভাই, সবুর ভাই, হেলালী ভাই আর খয়ের। উনারা গ্রেনেট নিয়ে যাচ্ছেন টাঙ্গাইল শহরে। উনারা তিনজন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র আর খয়ের আমার নিচের ক্লাসে। সেবার টাঙ্গাইলে এসেই অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিশীল মেধাবী ছাত্র সালাহউদ্দীন ভাই রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লেন। শুনেছি তাকে দু’টুকরো করে হত্যা করা হয়েছিল। প্রতি সন্ধ্যায় গ্রেনেড হামলা করে এই তরুণ কিশোররাই কাঁপিয়ে তুলত শহর আর অস্থির হয়ে পড়ত পাক বাহিনী। কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী জানিয়েছিলেন সর্বমোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা হবে প্রায় পৌনে দু’লাখ। আমার বিশ্বাস এদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ যাদের কোন রাজনৈতিক দায়দ্ধতা কতটা ছিল তা জানা নেই। যুদ্ধ শেষে সবাই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে ফিরে গেছেন। যুদ্ধের বিনিময়ে তারা কোন কিছু রাষ্ট্রের কাছে, জাতির কাছে দাবি করেনি। এরা প্রত্যেকেই দেশের জন্য জীবন দিতে গিয়েছিল। অনেকই জীবন দিয়ে অমর হয়েছে, অনেকে বীরের বেশে ফিরে এসেছেন। এদের জন্য রাষ্ট্রের, জাতির তো দায় রয়েছে, দায়িত্ব রয়েছে। এদের অসম সাহসের যুদ্ধের জন্যই তো দেশ স্বাধীন। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্ত হয়নি। এর মধ্যে তালিকা নিয়ে অনেক কথাই শোনা যায়- ইতোমধ্যে অনেক নাম বিতর্কিত হয়েছে, যুদ্ধের পরে জন্ম এমন নামও পাওয়া গেছে। আমার বিশ^াস প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই তালিকা সম্পর্কে কোন ধারণা নেই বা খোঁজও রাখে না। রাষ্ট্রের, সরকারের দায়িত্ব প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সঠিক পদ্ধতির মাধ্যমে প্রণয়ন করা। আলোচনার মূল বিষয় হলো- কেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রের কাছে যথাযথ সম্মান বা মর্যাদা পাবে না? বিভিন্ন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক নানা ধরনের সম্মান, মর্যাদা নির্দিষ্ট করা আছে। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়িয়েছেনÑ এজন্য ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই দেখা যায় মুক্তিযোদ্ধাদের করুণ কাহিনী, মানবেতর জীবনযাপন। এটি জাতির জন্য লজ্জাজনক। অনেক সময়ে মনে হয় মুক্তিযোদ্ধারা যেন করুণার পাত্র। আমি জানি না বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌস আলম রঞ্জু কতটা সামাজিক মর্যাদা, রাষ্ট্রীয় সম্মান নিয়ে জীবনযাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি উন্নত কল্যাণ রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করে চলেছেন, যিনি গভীরভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয়ে ধারণ করেনÑ তাঁর কাছেই আমাদের যত প্রত্যাশা। বঙ্গবন্ধুকন্যা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন। তেমনিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক সম্মান এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবেনÑ এটা আমাদের প্রত্যাশা। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে যেন কারও দ্বারে দ্বারে ঘুরতে না হয়, একজন মুক্তিযোদ্ধাও যেন কোনকালেই অবহেলিত বা অসম্মানিত না হয়। তা না হলে জাতি পুরোপুরি কালিমামুক্ত হবে না। ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’Ñ এর মতো ঘটনা একাত্তরে আমাদের ঘরে ঘরে আছে। মায়েরা অকাতরে তাঁর সন্তানদের যুদ্ধে পাঠিয়েছেন দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য। কেউ ফিরেছেন, কেউ ফেরেনি। স্বাধীনতা পেয়ে মায়েরা সান্ত¡না খুঁজেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে রূপকথার চেয়ে বিস্ময়কর সত্য অনেক ঘটনা আছে যা ইতিহাসের পাতায় খুব একটা ঠাঁই পায়নি। কমান্ডার কখনো ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধের পাঠানোর জন্য যখন যোদ্ধা খুঁজেছেন যেখান থেকে ফিরে আসা অনিশ্চিত, বলেছেন পাঁচজন হয়ত লাগবে। কারা কারা যাবে স্বেচ্ছায় জানতে চেয়েছেন তখন পাঁচজনের জায়গায় বিশজন দাঁড়িয়ে গেছেন। দেশের জন্য জীবনদানকে তুচ্ছ মনে করেছে মুক্তিযোদ্ধারা। কমান্ডার তখন দ্বিধায় পড়ে গিয়েছে কাকে রেখে কাকে পাঠাবে। এমনই অসংখ্য ঘটনা রয়েছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। আমরা যেন এ গৌরবের, অহঙ্কারের, প্রেরণার ইতিহাস অবিকৃতি রাখি, সদা জাগ্রত রাখি। মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় বা সামাজিকভাবে যেন আমরা বিশেষ- সম্মানের ব্যবস্থা করি- ১. যে কোন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে শুধু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নয় সকল মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ আসনের ব্যবস্থা। ২. বাস, ট্রেন, লঞ্চে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ আসনের ব্যবস্থা। ৩. সরকারী/বেসরকারী সকল হাসপাতালে চিকিৎসার বিশেষ ব্যবস্থা। ৪. দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা। ৫. মুক্তিযোদ্ধাদের যাবতীয় সুবিধা/সুবিধা তদারকি করার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি সেল থাকতে হবে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা অতি সহজেই যোগাযোগ করতে পারবেন এবং দ্রুত সমাধান পাবেন। রাষ্ট্র যখন মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদার আসন দেবে তখন গোটা জাতিও অনুভব করবে তাঁদের মর্যাদা। বিভিন্ন সময়ে বলা হয়ে থাকে ‘মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান’। আমাদের সকলকে তা যথাযথ বাস্তবায়ন করে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশ মাতৃকাকে উর্ধে তুলে ধরে রাখতে হবে। যে মহান যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ হয়েছেন, ২ লাখ মাÑবোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন, কোটি কোটি মানুষ নির্যাতিত হয়েছেন, এক কোটি মানুষ দেশ ছাড়া হয়েছেন, গুটিকয়েক দালালÑরাজাকার বাদে সাড়ে সাত কোটি মানুষ কোন না কোনভাবে সম্পৃক্তি হয়েছেন, সে মহান মুক্তিযুদ্ধকে আমরা কোনভাবেই যেন খাটো না করি। মুক্তিযোদ্ধাদেরও সতর্ক থাকতে হবে তাদের কারও কারণে যেন মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না হয়, শ্রেষ্ঠত্ব যেন খর্ব না হয়। হাজার ছালাম ফেরদৌস আলম রঞ্জুসহ সকল মুক্তিযোদ্ধাদের। লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×