ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ;###;অজয় দাশগুপ্ত

ভারতের নির্বাচন ॥ বাংলাদেশ তার প্রাপ্য বুঝে পাক

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ২৯ মে ২০১৯

ভারতের নির্বাচন ॥ বাংলাদেশ তার প্রাপ্য বুঝে পাক

মোদি ও বিজেপি আবার দেশ শাসনে আসায় বাংলাদেশের লাভ ছাড়া লোকসান হবে না। সাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতি মন্দ মানলেও বলতে হবে আওয়ামী লীগের সরকারের সঙ্গে মোদি সরকারের সমঝোতা চমৎকার। মাঝখানে তিস্তা চুক্তির কাঁটা মমতা ব্যানার্জীর শক্তি কমায় বরং লাভ আরও বেশি হওয়ার কথা। কারণ, তিনি বড় দুবোর্ধ্য। মানুষ বুঝতে পারে ভারতের সঙ্গে আমাদের বৈরিতায় লাভ নেই। কিন্তু কে-না মানে নানা কারণে বৈরিতা তৈরি হয়। সব দোষ কেবল বাংলাদেশের ওপর চাপালে চলবে? ক’দিন আগে বিদ্যুত ক্রয় নিয়ে যে ভিডিও কনফারেন্স তা সারাদেশের মিডিয়ায় বড় খবর হয়ে এসেছে। ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এই আমলের সম্পর্ক যে আগের চেয়ে মজবুত সেটা আমরা সবাই মানি। এটাও মানি ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক যত কাছাকাছি আসবে তত দু’দেশের জনগণের মঙ্গল। তাছাড়া এতবড় এক প্রতিবেশী যেÑ আমাদের তিন দিক থেকে ঘিরে আছে তার সঙ্গে অকারণ দুশমনি কোনদিন ভাল ফল বয়ে আনবে না। তবে এটাও বলতে হয় বড়র পীরিতি বালির বাধ কথাটা এমনি এমনি চালু হয়নি। ভারত বলতে আমাদের সাধারণ জনতা যা বোঝে বা যে ইমেজ তাদের মনে আছে তার আলোকেই এর বিশ্লেষণ জরুরী। আগে একটা মজার গল্প বলি, চট্টগ্রামের এক সওদাগর গিয়েছিলেন সে দেশে। ফেরার পর গল্প করে বলছিলেন : তিনি আগ্রা জয়পুর দিল্লী মুম্বাই দেখে ইন্ডিয়া হয়ে ফিরেছেন। শ্রোতাদের তো চোখ কপালে। বলে কি? সবাই প্রশ্ন করছিল ইন্ডিয়া মানে? ভদ্রলোক খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন : মানে কলকাতা আরি ওয়া। বেশিরভাগ মানুষ চোখে পশ্চিমবঙ্গ হলো ইন্ডিয়া। কারণ, বাকিদের আকার আকৃতি গঠন বা খাবার পোশাক বিদেশীদের মতো। এই গল্পটা আমাদের জিয়নে বাস্তবও বটে। প্রশ্ন করে দেখুন যারা কলকাতা যায় তারা ইন্ডিয়া বলার চাইতে কলকাতা যাচ্ছি বলতেই স্বাছন্দ্য বোধ করে। আমার ধারণা ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যতটা ভাল পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ততটাই নাজুক। এর একটা বড় কারণ সীমান্ত। কারণ তার সঙ্গে লাগোয়া সীমান্তে প্রায়ই আমরা নানা দুর্ঘটনার শিকার হই। এদেশের মানুষের মনে কাঁটাতারে ঝুলতে থাকা ফেলানী এক প্রতিবাদ আর ঘৃণার বিষয়। সেটা মুছতে যে পরিমাণ ভালবাসা ও আন্তরিকতার প্রয়োজন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি তা দেখায়নি। বলছিলাম উভয় দেশের সম্পর্কের কথা। বাণিজ্যিক ও আর্থিক সম্পর্ক নির্ধারণ হয় পারস্পরিক চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে। সেটা বুঝবেন অর্থনীতিবিদরা। এটা মানতেই হবে বিশাল দেশ ভারত আমাদের চাইতে অনেক এগিয়ে। তার অবস্থান দুনিয়ায় বহু জায়গায় অনেক বেশি অগ্রগামী। অত বড় দেশের নানা প্রোডাক্ট থাকবে এবং তা সবদেশে যাবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা এই সিডনিতেও মূলত ভারতীয়দের ওপর নির্ভর করি। তাদের রেস্তরাঁ বাণিজ্য দুনিয়াব্যাপী। তাদের মসলা আনাজসহ নানা ধরনের প্রডাক্টে বাজার সয়লাব। পোশাক ও বিনোদনেও তারা এগিয়ে। এত কিছু মেনেও বলি বাংলাদেশ আজ আর আগের জায়গায় নাই। তার শরীরে যে নতুন হাওয়া যে নতুন সুগন্ধ তাতে বিশ্ব আমোদিত। সিডনির প্রধান প্রধান বিপণিতে সুপারস্টোরে আপনি পোশাকের গায়ে হাত দিলেই দেখবেন মেইড ইন বাংলাদেশ। আমাদের অগ্রগতির আরেক নাম মেধা। এত সমস্যা সঙ্কুুল দেশে মেধার এই অঢেল ও বিপুলতা আমাকে মুগ্ধ করে। যে প্রজন্ম এখন বড় বা হাল ধরবে তাদের সঙ্গে ভারতীয় নতুন প্রজন্মের খুব বেশি তফাত নেই। তফাত আমাদের রাজনীতিতে। ভারতের রাজনীতি কিছু বিষয়ে সমঝোতা করে নিয়েছে। তাদের দেশে রাজনৈতিক কলহ থাকলেও মূল বিষয়ে ঝগড়া নেই। আমরা এত বছর পরও মৌল বিষয়ে বিবাদ ভুলতে পারিনি আর আর পারিনি বলেই ভারত বা মিয়ানমার আমাদের অনৈক্যের কারণে মাথায় হাত বুলাতে সাহস পায়। সরকারী দলের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ তারা যখন ই গদিতে আসে তারা নাকি ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেয়। এটা একটা ডাহা মিথ্যা ও মনভোলানের জন্য অপবাদ। কিন্তু এর বিরুদ্ধে যে মতামত বা যে প্রচার হওয়া প্রয়োজন তা কি হয়? বরং যত ভোট এগিয়ে আসে তত এটাই প্রভাব ফেলতে শুরু করে। আমরা সবাই জানি আমাদের রাজনীতি অতীতমুখী। সে কারণে ভারত আর পাকিস্তান এখনও ফ্যাক্টর। পিছিয়ে পড়া পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আর সমস্যায় জর্জরিত না থাকলে কি হতো ভাবুন। এ দুই দেশের বোঝা মাথায় নিয়ে চলা দুই বড় দল দেশে ঝগড়া করতে করতেই শেষ। তারপরও শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থান আর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে নতুন এক মাত্রা দিতে পেরেছে। যেটা হয়নি তা হলো জনমন থেকে সংশয় ও বিদ্বেষ দূর করা। আমাদের মনোজাগতিক অবসহান দেখুন। যেসব মানুষ চিকিৎসা ও বিনোদনের জন্য ভারত যায় তারা সেখানকার সবকিছু সরেজমিন দেখে আসার পরও ভারত বিরোধী প্রচারণায় পড়ে ভোটের বাক্সে মত বদল করে। এই মনস্তত্ত্ব¡ কি কেবল সাম্প্রদায়িকতা কিংবা জাতিগত ও ধর্মীয় বিবেচনায়? আমি এমনও দেখেছি প্রাণে বেঁচে আসা সুস্থ হয়ে আসা মানুষ ডা. শেঠী বা তেমন কাউকে ভগবান জ্ঞান করলেও ভোটের বেলায় কট্টর ভারতবিরোধী। এই মনোজাগতিক ধারণা দূর না হলে সম্পর্ক কিভাবে স্বাভাবিক হবে? মানুষকে দোষারোপ করার আগে যে ঘটনাগুলো এর পেছনে কাজ করে সেগুলোর বিহিত করা দরকার। আমাদের রিজার্ভ চুরি থেকে রাজনৈতিক গুমে পরিণত মানুষের বেলায় ভারতের নাম আছে। যেসব নেতা বা রাজনৈতিক মানুষ হঠাৎ উধাও হয়ে যায় জনগণ দেখে তারা সে দেশের কোন রাজ্যে আছে বা সেখান থেকে কথা বলছে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে এ নিয়ে প্রশ্ন জাগে। কিন্তু জনগণকে এটা কেউ বোঝায় না তা হলে তো লন্ডনের বেলাতেই আপত্তিটা প্রবল হওয়া উচিত। কারণ, ইংল্যান্ডই হচ্ছে রাজনৈতিক অপরাধী বা পালিয়ে থাকা মানুষদের অভয়ারণ্য। কেন তারা সেখানে পালায় বা কেন তাদের আশ্রয় দেয়া হয় আর কোন রাজনীতি এই সব কিছুর সুবিধা ভোগ করে এটা পরিষ্কার না বলেই বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা যায় না। আমাদের দেশের রাজনীতির আর এক সমস্যা পরনির্ভরতা। মানুষকে দোষারোপ করার আগে এটা বুঝতে হবে আওয়ামী বিএনপি জাতীয় পার্টি সবাই প্রমাণ করতে চায় ভারত তাদের সঙ্গে আছে। সঙ্গে না থাকলে যে কি হয় সেটা তো আমরা খালেদা জিয়াতেই দেখতে পাই। তার কথিত আপোসহীনতার কারণে দলতো দল তিনি ও আজ ভুগছেন। এই যে মুরব্বিয়ানা বা মুরব্বি মানা এটা যতদিন থাকবে ততদিন তো সম্পর্ক নিয়ে মানুষ দ্বিধান্বিত হবেই। মোদি আসার পর যে ভয় বা বিরোধিতা তার আমলে গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে যত কথা সব বেমালুম ভুলে সব দল এখন তার আনুকূল্য পাবার জন্য মরিয়া। মোদি নিঃসন্দেহে ক্যারিশমেটিক লিডার। অসাধারণ বলেন। কিন্তু তার ভেতর যে ভারতীয় জাতীয়তাবোধ বা দেশপ্রেম সেটা কি আমরা নেই? না খেয়াল করি? মোদি যেবার প্রথম এলেন সাকিব আল হাসানের কথা বলে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনের আয়োজনে সেখানে পড়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠা বাংলাদেশীদের নাম মুখস্থ বলে আবারও দেখিয়ে দিলেন তিনি কতটা খবরাখবর রাখেন। এটা বললাম এই কারণে আর পাশাপাশি আমরা থাকি অতীত নিয়ে ব্যস্ত। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সঠিক ও মজবুত করতে হলে সীমান্ত সমস্যা সমাধান আর বাণিজ্যিক ও সামাজিক সমস্যার বেলায় একটা সহাবস্থান জরুরী। বাংলাদেশের যে অগ্রগতি তার পার্টনার মানে কেবল দেয়া নয় নিতেও হবে। আমাদের দ্রব্য আমাদের বিনোদন আমাদের সংস্কৃতি থেকেও তাদের নিতে হবে। আমরা জিটিভি দেখব সিনেমা দেখব তারা বন্ধ করে রাখবেন এটা চলবে না। মূলত সম্পর্কের গলার কাঁটা পশ্চিমবঙ্গের নেতৃত্ব। মমতা ব্যানার্জী। তিনি আমাদের এখনও তিস্তার পানির বেলায় তেমন কিছু বলেননি যাতে আমরা নিশ্চিত হতে পারি। তার দ্বিমুখী আচরণে বাংলাদেশের মানুষ ও সুশীল সমাজ স্বস্তি পায়? তিনি যে বললেন আপনি জিতুন আমরা আসব। এর মানে কি? এটা যদি আশাবাদ ও হব এমন বলাটা তো মূলত দেশের ভেতর যে আওয়ামী বিরোধী প্রচারণা বা ভারত আওয়ামী সম্পর্ককে জিম্মি করে আমজনতার ভোট টানা তাকে উস্কে দেয়া নয়? কে না জানে রাজনীতিতে ভুল বলে কিছু নেই। সে যুদ্ধে যারা ভারতের সেবাদাস অন্তরে তাদের মুচলেকা দিতে রাজি মুখে মুখে বিরোধী তারাই কি হালে পানি পাবে না। তাছাড়া আমন আবেগের মানুষ ও মমতা নন। সবাই জানেন তিনি কতটা রূঢ়। ফলে তাঁর কথা ও কাজে বাংলাদেশের রাজনীতির যে লাভ লোকসান সেটা বিবেচনায় রেখে সম্পর্কের ওঠানামা ঠিক করাটা জরুরী। একজন মুখ্যমন্ত্রী আর প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই সমান গুরুত্ব বহন করেন না। তারপরও আমরা সেটা গুলিয়ে ফেলি মাঝে মাঝে। এটা মানতেই হবে ভারতকে অস্বীকার বা তার সঙ্গে শত্রুতা করে আমরা এগুতে পারব না। ভৌগোলিক ও বাস্তবভাবে এটাই সত্য। তাই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে নতজানু বা মাথা নিচু করে নয়। শেখ হাসিনা যেভাবে এগুচ্ছেন তার দল ও নেতারা সেভাবেই এগুবেন। রোহিঙ্গা থেকে তিস্তা বা সীমান্ত থকে টিভি বাক্স বিনোদন থেকে সংস্কৃতি সবকিছুতেই আমাদের ভূমিকা ও আমাদের অর্জনকে মানতে হবে। বন্ধুত্ব হবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কারণ, প্রভুত্ব বা মাস্টারি করার মতো আচরণ ছিলো বলেই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান মিত্র ও ত্যাগ স্বীকার করা দেশটি মানুষের মনে তার সেই অবস্থান হারিয়ে ফেলেছিল। যেটুকু আছে বা যা থাকবে তার নাম যেন না হয় নির্ভরতা। মনে রাখা দরকার ভারত বিরোধিতার অকারণ বলি কিন্তু নিরীহ সংখ্যালঘু আর প্রগতিশীল সংখ্যাগুরুরাই। তাদের কল্যানের জন্য ও দু’দেশের মৈত্রী থাকা জরুরী। আগের চেয়ে অনেক ভাল একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে। অন্তত বহিরাঙ্গিকে। কিন্তু খেলার মাঠে কিংবা অন্তরে কিংবা নানা আচরণে তা এখনও প্রকাশ নয়। আশা করব, সে ক্য়ুাশা দূর হবে। গান্ধীজীর অহিংস বুদ্ধের শান্তি আর রবীন্দ্রনাথের জনগণ মন নায়কের দেশ আমাদের সত্যি বন্ধু ভাববে যা ছাড়া কোন দিন আসলে সখ্যতা হয় না। দু’দেশের সম্পর্ক যে কতটা জরুরী আর গুরুত্বপূর্ণ সেটা ইতিহাস বর্তমান আর ভবিষ্যত খুব ভাল জানে। নতুন সরকারকে শুভেচ্ছা আর উপমহাদেশের শান্তিই দেশে-বিদেশে বাঙালীর কামনা। [email protected]
×