ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ নৌবাহিনী

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ২৯ মে ২০১৯

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ নৌবাহিনী

বাংলাদেশ নৌবাহিনী ১৯৯৩ সাল থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে আসছে। এ যাবত ৩০টি দেশে সর্বমোট পাঁচ হাজার ৪২৩ জন শান্তিরক্ষী তাদের মিশন সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। নৌবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা যেসব দেশে শান্তিরক্ষায় কাজ করেছেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মোজাম্বিক, রুয়ান্ডা, হাইতি, ইরাক-কুয়েত, জর্জিয়া, আইভরি কোস্ট, মধ্য আফ্রিকা, দক্ষিণ সুদান, সিয়েরা লিওন, কঙ্গো, সোমালিয়া মালি এবং পূর্ব তিমুর। বর্তমানে নৌবাহিনীর ৩৪৮ জন সদস্য বিশ্বের সাতটি দেশে কর্মরত আছে। এগুলো হলোÑ পশ্চিম সাহারা, মালি, কঙ্গো, মধ্য আফ্রিকা, দক্ষিণ সুদান, দারফুর এবং জাতিসংঘ সদর দফতর (আমেরিকা)। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্যগণ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আন্তরিকতা, দক্ষতা, উন্নত শৃঙ্খলা, পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছে। তারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের জন্য সুনাম ও মর্যাদা বয়ে আনছেন ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। তাছাড়া বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখছেন। বাংলাদেশ নৌবাহিনী সর্বপ্রথম ১৫ সদস্যে একটি সামরিক পর্যবেক্ষণ প্রেরণ করে জাতিসংঘ মিশন মোজাম্বিকে ১৯৯৩ সালে। এরপর ১৯৯৭ সালে ইরাক-কুয়েতের জলসীমায় নিরাপত্তা বিধানের জন্য প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্বতন্ত্র নৌ কন্টিনজেন্ট প্রেরণ করে (টঘওকঙগ)। এ ধারা অব্যাহত রেখে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী শান্তিরক্ষা মিশন সুদানে প্রথমবারের মতো স্বতন্ত্র রিভারাইন ইউনিট মোতায়েন করে। এখানে এই ইউনিট ২০১২ সাল পর্যন্ত নিয়োজিত থাকে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নৌ-সদস্যদের পেশাদারিত্ব, কর্তব্যনিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ, গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও সফলতার ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘ সদর দফতরের চাহিদাক্রমে দক্ষিণ সুদানে ২০১৫ সালের জুন মাসে ২০০ জন মেরিন জনবল ও ১২টি লাইট পেট্রল ক্রাফট সমন্বয়ে ফোর্স মেরিটাইম ইউনিট মোতায়েন করা হয়। এখানে জাতিসংঘের ম্যানডেট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নৌসদস্যরা নিত্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি, খাদ্য সামগ্রী, ওষুধপত্র ও মানবিক সাহায্য বহনকারী বার্জসমূহের নিরাপত্তা বিধান, নৌপথের জলদস্যুতা দমন, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, অগ্নিনির্বাপণে স্থানীয় জনগণকে সহায়তা, আহত সামরিক ও বেসামরিক জনগণকে উদ্ধার ও ডুবুরি সহায়তা এবং স্থানীয় জনগণকে চিকিৎসা সহায়তাসহ মিশনে নিয়োজিত সেনা ও বেসামরিক সদস্যদের জন্য রসদ সামগ্রী দুর্গম স্থানে পৌঁছে দিয়ে থাকে। উল্লেখ্য, এই মেরিটাইম ইউনিট হোয়াইট নীল নদীর দীর্ঘ ৯৩৬ কি.মি. নৌপথে এখন পর্যন্ত ৩৩টি সফল অভিযান পরিচালনা করেছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী ২০০৫ সালে আইভরি কোস্টে বোট ডিটাসমেন্ট মোতায়েন করে যা ১১ বছর পর্যন্ত দায়িত্বরত থাকে। দুইটি মিশনই সফলতার সঙ্গে তাদের মিশন সম্পন্ন করে। আইভরি কোস্টে নৌবাহিনীর বোটগুলো নাইজার নদীপথে বাণিজ্যিক নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা বিধান করত। নৌবাহিনীর বোট নিয়োগের পূর্বে দীর্ঘদিন ধরে নাইজার নদীপথে বাণিজ্যিক নৌযান জলদস্যুর ভয়ে বন্ধ ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে জাতিসংঘ মিশন লেবাননে প্রথমবারের মতো ২০১০ সালে দুইটি যুদ্ধজাহাজ বিএনএস ওসমান ও বিএনএস মধুমতি মোতায়েন করা হয়। নিজস্ব সমুদ্রবন্দর থেকে প্রায় ১২০০০ কিলোমিটার দূরত্বে ভূমধ্যসাগরে এ ধরনের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সক্ষমতা ও বিশ্বমানের দক্ষতারই প্রমাণ বহন করে। এরপর এ জাহাজ দুইটি স্থলাভিসিক্ত হিসাবে মে-জুলাই ২০১৪ সালে অন্য দুইটি যুদ্ধজাহাজ বিএনএস আলী হায়দার ও বিএনএস নির্মূলকে লেবাননে প্রেরণ করা হয়। ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে লেবাননে ১১০ জন নৌশান্তিসেনাসহ করভেট টাইপ যুদ্ধজাহাজ বিএনএস বিজয় মোতায়েন রয়েছে। বিএনএস বিজয় সফলতা ও দক্ষতার সঙ্গে ভূমধ্যসাগরে লেবাননের জলসীমার দায়িত্বপালন করে আসছে। লেবাননে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিএনএস বিজয়ের প্রশংসনীয় ভূমিকার বিষয়টি লেবাননে ফোর্স কমান্ডার মেজর জেনারেল মাইকেল বিয়ারীও স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি ২০১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বিএনএস বিজয় পরিদর্শনকালে বিএনএস বিজয়ের কর্মদক্ষতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এই যুদ্ধজাহাজটি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন লেবাননে দায়িত্ব পালনের জন্য বছরে ৫৩ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী রিইমবার্সমেন্ট হিসাবে বছরে গড়ে ৬৪ কোটি ৫৭ লাখ ৬০ হাজার টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে এবং এ যাবত মোট প্রায় ৯০৪ কোটি ছয় লাখ ৪০ হাজার টাকা আয় করেছে। নৌবাহিনী জাতিসংঘ মিশন ভাতা হিসাবে বছরে গড়ে চার কোটি ১৩ লাখ ৫৭ হাজার টাকা আয় করে। তাছাড়া এ যাবত সর্বমোট ৫৭ কোটি ৮৯ লাখ ৯৮ হাজার টাকা মিশন ভাতা হিসাবে আয় করেছে। এ যাবত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একজন অফিসারসহ মোট চারজন শান্তিরক্ষী জাতিসংঘ মিশনে কর্তব্যরত অবস্থায় শহীদ হয়েছেন। তারা সবাই জাতিসংঘ কর্তৃক দাগ হামার সোল্ড পদক পেয়েছেন। বর্তমানে নৌবাহিনীর চারজন মহিলা অফিসার জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত আছেন এবং এ যাবত মোট ১৪ জন মহিলা অফিসার শান্তিরক্ষা মিশন সম্পন্ন করেছেন। নৌবাহিনীর কর্মকর্তা কমান্ডার এএনএম ইশতিয়াক জাহান ফারুকী, উপ-পরিচালক নেভাল প্লানস কিছু দিন আগে জাতিসংঘ মিশন সম্পন্ন করেছেন। তিনি লেবাননে বিএনএস নির্মূলের কমান্ডিং অফিসার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, লেবাননে জাতিসংঘ মিশনে বহুজাতিক পরিবেশে আমাদের যুদ্ধ জাহাজের অংশগ্রহণ খুবই গৌরবের। তাছাড়া জাতিসংঘ মিশনে কর্তব্যরত অবস্থায় নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ অন্যান্য অংশগ্রহণকারী দেশের সঙ্গে অনেকগুলো মহড়ায় অংশ নেয়। যার ফলে আমরা পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষ অর্জনের সুযোগ পেয়েছি। তিনি আরও বলেন, আমাদের যুদ্ধজাহাজ শান্তিরক্ষার পাশাপাশি লেবানন নৌবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণও দিয়ে যাচ্ছে। ফলে বন্ধুপ্রতিম দুইটি মুসলিম দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পূর্বের তুলনায় অনেক গভীর হয়েছে। লেবাননে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজসমূহের প্রধান কাজ দুইটি। যেমন- ভূমধ্যসাগরে লেবানিজ জলসীমার নিরাপত্তা বিধান করা ও অবৈধ অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ চলাচল রোধ করা এবং লেবানিজ নৌসদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা। বর্তমানে লেবানিজ নৌবাহিনী তাদের সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। কমান্ডার ইশতিয়াক লেবাননে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, লেবাননে কোন ডকইয়ার্ড না থাকায় বাংলাদেশ যুদ্ধজাহাজ সার্বক্ষণিকভাবে কার্যকর রাখা খুই কঠিন। তাছাড়া শীতকালে ভূমধ্যসাগর খুবই উত্তাল থাকে যা সুষ্ঠু দায়িত্ব পালনের অন্তরায়। লেবাননে মোতায়েনকৃত জাহাজগুলোর সুষ্ঠু রক্ষণাক্ষেণের জন্য প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশ লেবাননে পাওয়া যায় না। এসব যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করতে হয় তুরস্ক অথবা ইউরোপের কোন দেশ থেকে। কখনও কখনও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করতে হয়। কমান্ডার ইশতিয়াকের মতে, লেবাননে দায়িত্ব পালনে এটাও একটি চ্যালেঞ্জ। কমান্ডার ফারহানা শারমিন মধ্য আফ্রিকায় এক বছরের শান্তিরক্ষা মিশন সম্পন্ন করেছেন। তিনি সেখানে ১৩ নবেম্বর ২০১৬ থেকে ১২ নবেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মধ্য আফ্রিকার রাজধানী বাঙ্গুইতে অবস্থিত ফোর্সেস সদর দফতরে স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, ‘বহুজাতিক পরিবেশে কাজ করতে পারা আমার জন্য এক বিরাট অভিজ্ঞতা।’ তিনি প্রায় ৭০টি দেশের শান্তিরক্ষীদের সঙ্গে কাজ করেছেন যা তাকে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি ও আচরণ সম্পর্কে তার জানার সুযোগ হয়েছে। তিনি পুরুষপ্রধান পরিবেশে কাজ করা সত্ত্বেও নারী-পুরুষের মধ্যে কোন বৈষম্য দেখতে পাননি বলে জানান। কমান্ডার ফারহানা বলেন, মধ্য আফ্রিকা খুবই ঝঁকিপূর্ণ এলাকা এবং এখানে স্বাভাবিক চলাচল ছিল বিপজ্জনক। এ অবস্থায় দীর্ঘ এক বছর দায়িত্ব পালন খুবই কঠিন। তিনি বলেন, বহুজাতিক পরিবেশে কাজ করতে পারা তার জন্য খুবই আনন্দের ছিল। তবে দীর্ঘ এক বছর তার সন্তান ও পরিবার ফেলে অনেক দূরে অবস্থান করাটা তার জন্য কিছুটা কষ্টের ছিল। ‘এর পরেও জাতিসংঘ বাহিনীতে নীল হেলমেটের অধীনে কাজ করতে পারা আমার জন্য খুবই সম্মানের। আমি এজন্য অবশ্যই গর্ব বোধ করি’ অভিমত কমান্ডার ফারহানার। লেখক : সহকারী পরিচালক, আইএসপিআর
×