ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাপানে ২২ হাজার কোটি টাকার সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে

প্রকাশিত: ০৯:২৮, ২৮ মে ২০১৯

 জাপানে ২২ হাজার কোটি টাকার সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে

রহিম শেখ ॥ জাপান। পৃথিবীর পরিশ্রমী জাতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি-সব দিক দিয়েই জাপান খুব দ্রুত এগোচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আগে থেকেই ভাল। সম্প্রতি বাংলাদেশে বিনিয়োগে জাপানী কোম্পানিগুলোর আগ্রহ বেড়েছে। এক দশক আগে এ দেশে কর্মরত জাপানী কোম্পানির যে সংখ্যা ছিল, এখন তা প্রায় চার গুণ বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সালে বাংলাদেশে জাপানী কোম্পানি ছিল ৭০, ২০০৯ সালে ছিল ৮২, ২০১১ সালে ১১৩, ২০১৩ সালে ১৬৭, ২০১৫ সালে ২৩২, ২০১৭ সালে ২৬৯, সর্বশেষ ২০১৮ সালে উন্নীত হয়েছে ২৭৮। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে আজ মঙ্গলবার টোকিওর উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল সফরসঙ্গী হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর । এই সফর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে বড় ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সূত্র জানায়, বর্তমানে না.গঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় জাপানী অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ এগিয়ে চলছে। এর প্রথম ধাপ হবে প্রায় ৫শ’ একর জায়গাজুড়ে। পরবর্তীতে আরও ৫শ’ একর যোগ হবে। এ বিষয়ে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী ২০২০-২১ সালে জাপানী অর্থনৈতিক অঞ্চল কার্যক্রম শুরু করবে। তখন এ দেশে জাপানী কোম্পানির সংখ্যা ৫শ’ ছাড়িয়ে যাবে। এখন প্রতিনিয়ত জাপানী কোম্পানি বিনিয়োগের খোঁজখবর নিচ্ছে। জাপান তাদের বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে আরেকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সরকারের কাছে তারা এ আগ্রহের কথা জানিয়েছে। নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলটির জন্য তারা প্রায় এক হাজার একর জমি চেয়েছে কক্সবাজারের মহেশখালীতে। সূত্র মতে, সম্প্রতি বাংলাদেশে বড় বেশ কিছু জাপানী কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে। আবার কেউ কেউ নতুন বিনিয়োগের প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী হোন্ডা মোটর কর্পোরেশন। তারা মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় আবদুল মোনেম ইকোনমিক জোনে ২৫ একর জমিতে মোটরসাইকেল সংযোজন ও যন্ত্রাংশ উৎপাদনের কারখানা করেছে। তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ৪ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৩৬৯ কোটি টাকার মতো (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ধরে)। এছাড়া তামাকজাত পণ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান জাপান টোব্যাকো গত বছরের জুনে বাংলাদেশের আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কিনে নেয়। এতে জাপানী কোম্পানিটি বিনিয়োগ করছে ১৪৭ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১২ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ইস্পাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নিপ্পন স্টিল এ্যান্ড সুমিতমো মেটাল দেশীয় প্রতিষ্ঠান ম্যাকডোনাল্ড স্টিল বিল্ডিং প্রোডাক্টসের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইস্পাত কারখানা করছে। সম্প্রতি একশ’ একর জমি বরাদ্দের বিষয়ে বেজার সঙ্গে চুক্তিও করেছে তারা। এছাড়া দেশের বিদ্যুত খাতের সবচেয়ে বড় বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সামিট কর্পোরেশন ২৪ হাজার কোটি টাকার একটি বিদ্যুত প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সেখানে বিনিয়োগ করছে মিতসুবিশি কর্পোরেশন। সম্প্রতি এ বিষয়ে চুক্তি সই হয়েছে। জাপানের বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি সজিত কর্পোরেশনও মিরসরাইয়ে এক হাজার একর জমি বরাদ্দের জন্য আবেদন জানিয়েছে। তারা সেখানে একটি শিল্পপার্ক প্রতিষ্ঠা করতে চায়। জাপানের আরেক মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইয়ামাহাও বাংলাদেশে মোটরসাইকেল কারখানা করতে চায়। এ জন্য তারা মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি চেয়েছে এর বাইরে জাপানের আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম ইকোনমিক জোনে বিনিয়োগের বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছে। দেশে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) আনার কাজে নিয়োজিত সংস্থাগুলো আশা করছে, আগামী বছরগুলোতে দেশে জাপানী বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে। কারণ জাপান তাদের বিনিয়োগকারীদের জন্য এ দেশে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে। আরও একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জমি চেয়েছে তারা। বাংলাদেশে জাপানী কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ, ব্যবসা সম্প্রসারণ ও মুনাফা পরিস্থিতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব ফুটে উঠছে দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্য সংস্থা জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) জরিপ প্রতিবেদনেও। এফডিআই পরিস্থিতি নিয়ে জাপানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৈরি প্রতিবেদন ধরে জেট্রো বিভিন্ন দেশে কর্মরত সে দেশের কোম্পানির সংখ্যা উল্লেখ করে। তাদের হিসাবে, ২০০৮ সালে বাংলাদেশে জাপানী কোম্পানির সংখ্যা ছিল ৭০, যা ’১৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৪৫টিতে। এই সংখ্যা ’১৭ সালে আরও বেড়ে ২৬৯ হয়। জাপানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিনিয়োগ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে জাপানী কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ১ হাজার ১৩০ কোটি জাপানী ইয়েন বিনিয়োগ করেছে, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৮৪০ কোটি টাকার সমান। এই অর্থের ৮৭ শতাংশই মূলধন। অবশ্য অর্থের হিসাবে বিনিয়োগের পরিমাণ ২০১৬ সালে আরও বেশি ছিল। সেই বছর বাংলাদেশে জাপানী কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করেছিল ১ হাজার ৫৯০ কোটি ইয়েন, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ’১৮ সালে জাপানী কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ১ হাজার ৭৩০ কোটি জাপানী ইয়েন বিনিয়োগ করেছে, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৪৪০ কোটি টাকার সমান। জেট্রোর জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ’১৯ সালে তাদের যে পরিচালন মুনাফা বাড়বে তা হবে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ২০ দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের ওপরে আছে শুধুমাত্র লাওস। প্রতিবেশী মিয়ানমার, ভারত ও পাকিস্তান বাংলাদেশের পরে। এ ছাড়া বাংলাদেশে ব্যবসা করছে এমন ৭৩ শতাংশ জাপানী কোম্পানি সূত্র বলেছে, তারা আগামী দু-এক বছরে এ দেশে ব্যবসা বাড়াবে। বাংলাদেশে জাপানী কোম্পানির সংখ্যাও বাড়ছে। ২০০৮ সালে এ দেশে জাপানী কোম্পানি ছিল মাত্র ৭০, যা ’১৮ সালে বেড়ে হয়েছে ২৭৮। সম্প্রতি এ জরিপটি প্রকাশ উপলক্ষে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলন জেট্রোর কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ (প্রতিনিধি) দাইসুকি আরাই বলেছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার বড় হওয়া এবং উৎপাদন খরচ কম হওয়াই বিনিয়োগের অনেক আগ্রহের কারণ। অবশ্য এ দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক বাধাও রয়েছে। বাংলাদেশে পণ্যের মান ঠিক রাখা কঠিন, শ্রমিকের দক্ষতা কম, কর প্রদান জটিল, পণ্য খালাসে দীর্ঘ সময় লাগে। তিনি বলেন, বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ খুবই সম্ভাবনাময়। তবে এ আত্মতৃপ্তি নিয়ে বসে থাকলে হবে না। অনেক বাধা আছে, সেগুলো দূর করতে হবে। এদিকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে আজ মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টোকিওর উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বেন। আগামীকাল বুধবার জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে সরকার প্রধানের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হওয়ার কথা। ওই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার অংশ হিসাবে বাংলাদেশকে জাপানের অতিরিক্ত আড়াই বিলিয়ন ডলার বা ২২ হাজার কোটি টাকা দেয়ার বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। দ্বিপক্ষীয় ওই বৈঠক ছাড়াও টোকিওতে আগামী মে অনুষ্ঠেয় দু’দিনব্যাপী ‘ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনের সমাপনীতে অংশগ্রহণ করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সেশনে রোহিঙ্গা সঙ্কটসহ দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখবেন তিনি। এছাড়া সরকার প্রধান পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক বৈঠকেও রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে জাপানের আরও সক্রিয় সহযোগিতা চাইবে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর এবারের জাপান সফরের সময় উচ্চ পর্যায়ের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলও সঙ্গে থাকছে। এফবিসিসিআইয়র নবনির্বাচিত সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিমের নেতৃত্বে ব্যবসায়ীরা জাপান সফর করবেন। দুদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কিভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়েও এবারের সফরে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (বিড) কাজী আমিনুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, জাপান বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন অংশীদার। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের সময় বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগের বিষয়ে আলোচনা করা হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে জাপান বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। তিনি বলেন, জাপান-বাংলাদেশ ডায়লগে বিনিয়োগ ও সহযোগিতার বিষয়ে আলাপ আলোচনা হবে।
×