ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আইএসের দায় স্বীকারে মালিবাগ হামলা নিয়ে তোলপাড়

প্রকাশিত: ০৯:২৭, ২৮ মে ২০১৯

 আইএসের দায় স্বীকারে মালিবাগ হামলা নিয়ে তোলপাড়

গাফফার খান চৌধুরী ॥ আবারও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর বোমা হামলা এবং আইএস কর্তৃক সেই হামলার দায় স্বীকারের ঘটনা নতুন করে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। গত রবিবার রাতে মালিবাগে পুলিশের গাড়িতে বোমা হামলায় কর্মকর্তাসহ তিন পুলিশ আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএস (ইসলামিক স্টেট) হামলার দায় স্বীকার করার পর তা নিয়ে সরকারের ভেতরে বাইরে রীতিমতো তোলপাড় চলছে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ প্রধান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা জঙ্গীদের হামলার টার্গেট বলে আশঙ্কার কথা বারবারই বলেছেন। এমন আশঙ্কার পর হামলার ঘটনা নতুন করে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি আইএস পাকিস্তানে তাদের হিন্দ প্রভিন্স স্থাপন করেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশিত হয়েছে। সেই হিন্দ প্রভিন্স থেকে বাংলাদেশ ও ভারতসহ আশপাশের দেশগুলোতে আইএস হামলা চালানোর কথাও এসেছে। মালিবাগে হামলার সঙ্গে আইএসের হিন্দ প্রভিন্সের কোন যোগসূত্র আছে তা কিনা খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। যদিও সরকারের তরফ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে কোন আইএসের তৎপরতা নেই। তবে বাংলাদেশে কোন কোন গোষ্ঠী বা জঙ্গী আইএসের অনুসারী থাকতে পারে। সেটি তাদের ব্যক্তিগত বা দলীয় বিষয়। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র বলছে, সরকারবিরোধী একটি গোষ্ঠী আচমকা দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তারই ধারাবাহিকতায় তারা পুলিশের গাড়িতে রাতের আধারে বোমা হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে। দেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলতে কিছুই নেই বোঝাতে, এসব হামলার দায় চাপাচ্ছে আইএসের ঘাড়ে। এতে করে দেশবাসীর মধ্যে যেমন বাড়তি আতঙ্কের সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি সরকারের কর্মকা- সম্পর্কে মানুষের মধ্যে দিনকে দিন নেতিবাচক ধারণার জন্ম হচ্ছে। ঈদ পরবর্তীতে সরকারবিরোধীদের নানা ইস্যুতে যে আন্দোলনের ডাক দেয়ার কথা আছে, তা যেন দেশবাসীর মধ্যে গ্রহণযোগ্য হয় এবং তাতে যেন মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই কৌশলের অংশ হিসেবে এসব বিচ্ছিন্ন হামলার ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। গত রবিবার রাত নয়টার দিকে মালিবাগ মোড়ে পাম্পের উল্টো দিকে ফ্লাইওভারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পুলিশের গাড়িতে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। বোমা হামলায় গাড়িতে আগুন ধরে যায়। হামলার সময় গাড়িতে থাকা সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) রাশেদা খাতুন, পাশ দিয়ে যাওয়া রিক্সাচালক লাল মিয়া ও এক পথচারী আহত হন। প্রথমে তাদের রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। আহতরা আশঙ্কামুক্ত। এ ঘটনায় সোমবার পল্টন মডেল থানায় পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের পক্ষ থেকে কয়েক জনকে অজ্ঞাত আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিস্ফোরক ও সন্ত্রাস দমন আইনে দায়েরকৃত ওই মামলাটির তদন্ত করছেন পল্টন থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সৈয়দ আলী। মামলাটির তদন্তে সোমবার বিকেল ছয়টা নাগাদ এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার বা শনাক্ত হয়নি। এদিকে পুলিশ, ডিবি পুলিশ, সিআইডিসহ বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে। সংগৃহীত আলামতের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এদিকে মালিবাগ মোড়ে পুলিশের গাড়িতে বিস্ফোরণের ঘটনায় দায় স্বীকার করেছে জঙ্গীগোষ্ঠী আইএস। টুইটারে দেয়া এক পোস্টে হামলার দায় স্বীকারের তথ্য জানিয়েছে জঙ্গী তৎপরতা বিষয়ক খবরের মুনাফাভিত্তিক ওয়েবসাইট সাইট ইন্টেলিজেন্স। এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশে সংঘটিত কোন হামলার দায় স্বীকার করল আইএস। এর আগে ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের গুলশান লেক লাগোয়া হলি আর্টিজান রেস্তুরাঁ ও বেকারিতে জঙ্গী হামলায় বনানী থানার ওসি সালাহ উদ্দিন খান ও গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম ছাড়াও ১৭ বিদেশী ও তিন বাংলাদেশী নিহত হন। সেই হামলার দায় স্বীকার করেছিল আইএস। এর আগে গত ২৯ এপ্রিল ঢাকার গুলিস্তানে পুলিশের গাড়িতে বোমা হামলার ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হওয়ার ঘটনার দায় স্বীকার করেছিল আইএস। যদিও লেখক, প্রকাশক ও ব্লগারসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষদের হত্যার বিষয়েও আইএস দায় স্বীকার করেছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম বলেন, পুলিশের গাড়িতে বিস্ফোরক ছুড়ে মারা হয়েছিল, না কি পরিকল্পিত হামলা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ওই ঘটনায় বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। ঘটনার সঙ্গে কোন গোষ্ঠী জড়িত কি-না তা নিশ্চিত নয়। তা জানার চেষ্টা চলছে। সোমবার ডিএমপি কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে আহত রিক্সাচালক লাল মিয়াকে দেখতে যান। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল জনমনে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য এ ধরনের অপতৎপরতা চালাচ্ছে। যে বোমার বিস্ফোরণ ঘটেছে এটি সাধারণ ককটেলের চাইতে শক্তিশালী। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বোমাটি গাড়িতে পেতে রাখা হয়েছিল। বোমায় কি ধরনের বিস্ফোরক ছিল তা কাউন্টার টেররিজমের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট খতিয়ে দেখছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, গুলিস্তানে জঙ্গীদের বোমা হামলার খবর পেয়ে আহতদের দেখার জন্য ওই রাতেই পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী উত্তরার দিক থেকে গাড়ি ঘুুরিয়ে রাজারবাগ হাসপাতালে যাওয়ার উদ্যোগ নেন। রাস্তায় পুলিশের নিরাপত্তা প্রটোকল ভেঙ্গে দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে চার যুবক ঢুকে পড়েছিল। পরে তাদের আটক করা হয়। তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যদিও এমন তথ্যের সত্যতা দায়িত্বশীল কোন স্বীকার করেছে না। এমন ঘটনার পর পরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা জঙ্গীদের টার্গেট বলে বিভিন্ন সময় প্রকাশ্যেই আশঙ্কার কথা জানান। প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ১০ নবেম্বর সকাল সাড়ে দশটার দিকে কচুক্ষেত এলাকায় কর্তব্যরত মিলিটারি পুলিশ সদস্য সামিদুল ইসলামকে শত শত মানুষের সামনে মানিক নামে একজন উগ্র যুবক ধারালো ছুরি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে। মানিক কোন জঙ্গী বা উগ্র মতাদর্র্শে বিশ্বাসী ব্যক্তি বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের জানিয়েছিলেন। এমন ঘটনার পর কয়েক দিন পরই শুক্রবার জুমার নামাজের পর চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ঈশা খাঁ ঘাঁটির মসজিদে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। বোমা হামলায় জড়িত দুই জন গ্রেফতার হয়। যার মধ্যে একজন নৌবাহিনীর ব্যাটম্যান। অপরজন নৌবাহিনীর লন টেনিসের কোর্টে বল কুড়িয়ে এনে দেয়ার সঙ্গে জড়িত। তবে তারা নৌবাহিনীর স্থায়ী সদস্য ছিলেন না। হামলায় ছয় জন আহত হন বলে জানিয়েছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এছাড়া ২০১৭ সালে র‌্যাব সদর দফতরে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার পর পরই খিলগাঁওয়ে র‌্যাবের চেকপোস্টে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলার চেষ্টা হয়। আত্মঘাতী হওয়ার আগেই আত্মঘাতী ওই জঙ্গী র‌্যাবের গুলিতে নিহত হয়। ওই জঙ্গীর শরীর ও ব্যাগ থেকে উদ্ধার হয় শক্তিশালী একাধিক বোমা। যদিও বাংলাদেশী জেএমবি জঙ্গীরা সবচেয়ে বড় হামলা চালায় ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। ওইদিন তারা ময়মনসিংহের ত্রিশাল থেকে প্রিজনভ্যানে হামলা করে পুলিশ হত্যা করে দুর্ধর্ষ তিন জঙ্গী রাকিব হাসান, বোমারু মিজান ও সালেহীনকে ছিনিয়ে নেয়। পালানোর সময় পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে রাকিব হাসান মারা যায়। বোমারু মিজান ও সালেহীনের আজও কোন হদিস নেই।
×