ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা-ময়মনসিংহ ফোর লেনের সুফল ব্যর্থ করছে আট পয়েন্ট

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ২৮ মে ২০১৯

 ঢাকা-ময়মনসিংহ ফোর  লেনের সুফল ব্যর্থ করছে আট পয়েন্ট

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডের টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ১০ পয়েন্ট যানজটের বিষফোঁড়া হিসেবে চিহ্নিত। বছরের প্রায় পুরো সময়ই এসব পয়েন্টে যানজটের কারণে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে যাত্রীদের। ঢাকার মহাখালী থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ১১২ কিলোমিটার। এরমধ্যে মহাখালী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত মাত্র ৩০কিলোমিটার সড়ক অতিক্রম করতে সময় লাগে চার ঘণ্টারও বেশি। টঙ্গী ব্রিজ থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত যেতে সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটারের বেশি সড়ক অতিক্রম করতে সময় লাগে সর্বোচ্চ দেড় ঘণ্টা! তবে এ বছর এই সড়কে ভোগান্তির নতুন মাত্রা যোগ করেছে বিআরটি প্রকল্প ও বছরের পর বছর সড়কের দু’পাশে ড্রেনের প্রকল্পের সংস্কার কাজ শেষ না না হওয়া। তাই এখন ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ দুই ঘণ্টার রাস্তা যেতে আগের চেয়ে তিনগুণ সময় লাগছে। অর্থাৎ ছয় ঘণ্টা। এমন বাস্তবতায় জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ ফোর লেন প্রকল্পের সুফল পাচ্ছেন না যাত্রীরা। এবারের ঈদেও ঢাকা-ময়মনসিংহ ও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের যাত্রীদের এই রুটে যানজটের কারণে ভোগান্তির আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, ১৫ রোজার পর থেকে টঙ্গী-গাজীপুর পর্যন্ত যানজট মাত্রা ছাড়িয়েছে। আগামী কয়েকদিনে তা আরও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। এসব পয়েন্ট ঘিরে যানজট নিরসনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হলে ঘরমুখো মানুষকে খুব একটা বিড়ম্বনার শিকার হতে হবে না। তাছাড়া জয়দেবপুর চৌরাস্তা ঘিরে লেগুনা স্ট্যান্ড ও বাস পার্কিং করে রাখার দৃশ্য চোখে পড়ে। সড়কের মাঝখানে যাত্রী ওঠানামা তো এই পয়েন্টে নিয়মিত বিষয়। পাশাপাশি সিটি সার্ভিসগুলোও চৌরাস্তায় ইচ্ছেমতো যাত্রী ওঠানামা করানো ও দাঁড়িয়ে থাকে। তাই এই পয়েন্টে বিশেষ নজরদারির দাবি সব পক্ষেরই। এবারের ঈদ উপলক্ষে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চার লেনের তিনটি সেতু ইতোমধ্যে খুলে দেয়া হয়েছে। এতে এই মহাসড়কে কোন যানজট নেই। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বেশ কয়েকটি সেতু, আন্ডারপাস খুলে দেয়ায় এই মহাসড়কেও যানজটের আশঙ্কা করছেন না সংশ্লিষ্টরা। সায়েদাবাদ থেকে ঢাকা-সিলেট রুটে চলা গাড়িগুলোও এবার নানামুখী উদ্যোগের কারণে যানজটে পড়তে হবে না। যানজটের আশঙ্কা শুধুমাত্র টঙ্গী-জয়দেবপুর পয়েন্টে। সড়ক পরিবহন সেতুমন্ত্রীও ওবায়দুল কাদের এইটুকু সড়ক নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। গত কয়েকদিনের ঈদ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত একাধিক বৈঠকে মন্ত্রী এই সড়কে যানজট নিরসনে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে। পাশাপাশি যানজট নিরসনে বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও জানিয়েছেন তিনি। সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এবারের ঈদযাত্রা বিগত সময়ের চেয়ে অনেক সহজ ও স্বস্তিদায়ক হবে বলে আশাবাদী। তিনি বলেছেন, মহাসড়ক এবার ইতিহাসের সবচেয়ে ভাল আবস্থায় আছে। সড়ক পথে স্বস্তিদায়ক যাত্রার নিশ্চয়তা দিতে পারব- এমন একটা অবস্থানে আমরা পৌঁছেছি। ঈদের আগেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দ্বিতীয় মেঘনা ও গোমতী সেতু খুলে দেয়া হয়েছে। এখন ঢাকা থেকে চার ঘণ্টায় চট্টগ্রাম পৌঁছে যাওয়া যাবে বলেই আশা করছি। তাছাড়া সেতু খুলে দেয়ার পর যাতায়াত সহজ হয়েছে বলছেন পরিবহন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিসহ সাধারণ যাত্রীরা। এদিকে টঙ্গী-গাজীপুর সড়কের যানজটের ব্যাপারে ওবায়দুল কাদের বলেন, কাঁচপুর-মেঘনা-গোমতী সেতু খুলে দেয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কোন যানজট থাকবে না। উত্তরবঙ্গগামী টাঙ্গাইল সড়কের দু’টি ফ্লাইওভার ও চারটি আন্ডারপাস খুলে দেয়ায় সেখানেও কোন যানজট থাকবে না। তবে টঙ্গী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত রাস্তায় কিছুটা সমস্যা হতে পারে। এ সমস্যা নিরসনে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীকে সভাপতি করে একটি কমিটি করেছি। এ কমিটি যানজট নিরসন করতে পারবে বলে আশা করছি। এছাড়া সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে টঙ্গী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কে ৩শ’ স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত থাকবে বলে জানান সড়ক মন্ত্রী। টঙ্গী-গাজীপুর সড়কের যানজট নিরসন কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন- গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর মেট্রোপলিটনের পুলিশ কমিশনার, বিআরটিএ কর্মকর্তা ও রুট ট্রানজিটের প্রকল্প পরিচালক। পরিবহনগুলো যদি শৃঙ্খলা মেনে চলে তাহলে সড়কে যানজট থাকার কথা নয় একথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, আমি বলে দিয়েছি, গাজীপুরের সড়কে ঈদ পর্যন্ত কোন পাইলিং হবে না। এছাড়া বাকি রাস্তা যান চলাচল উপযোগী রয়েছে। পরিবহনগুলো যদি শৃঙ্খলা মেনে চলে তাহলে সড়কে যানজট থাকার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, সড়ক পথে একটা স্বস্তিদায়ক যাত্রা যেন নিশ্চিত করতে পারি, সে জন্য এসেছি। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সড়ক পরিবহনে বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন শুরু হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টঙ্গী-গাজীপুর রুটে যানজট নিরসনের জন্য গঠিত কমিটির অন্যতম দুই সদস্যই উপস্থিত নেই। এরমধ্যে একজন স্থানীয় সাংসদ জাহিদ আহসান রাসেল ও অন্যজন গাজীপুর পৌর মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। তারা দু’জনেই এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তবে এই সড়কে যানজট নিরসনে মূল উদ্যোগী ভূমিকায় আছে পুলিশ। সমস্যার আট পয়েন্ট ॥ স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত বৃহত্তর ময়মনসিংহের পরিবহন টঙ্গী-জয়দেবপুর হয়ে যাতায়াত করে। এছাড়াও উত্তরাঞ্চল, সিলেট অঞ্চলেরও কিছু যানবাহন এই রুটের অংশবিশেষ ব্যবহার করে। সমস্যার শুরু মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকেই। টঙ্গী সেতু পার হওয়ার পর যানজটের মহাভোগান্তিতে পড়তে হয় পরিবহনগুলোকে। প্রথমেই টঙ্গী বাজার। এরপর স্টেশন রোড, চেরাগআলী মার্কেট, বাটা গেট, গাজীপুরা বাসস্ট্যান্ড, বোর্ড বাজার, ভোগড়া বাইপাস ও সর্বশেষ জয়দেবপুর চৌরাস্তা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এসব পয়েন্টে ইউটার্ন করে এক পাশের গাড়ি অন্যপাশে যাওয়া, সড়কের দু’পাশে পার্কিং, ইচ্ছেমত সড়কের মাঝখানে যাত্রী ওঠানো-নামানো, রং সাইড দিয়ে গাড়ি চলায় মূলত সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া কিছু কিছু পয়েন্টে দূরপাল্লার গাড়ি রাখা হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এতে সড়ক সংকুচিত হয়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। মাঝে মাঝে ভাসমান বাজার, সড়ক দখলেও সমস্যার সৃষ্টি হয়। গাজীপুরের ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার নাসির উদ্দিন মোল্লা জানান, গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার আনোয়ার হোসেন যোগ দেয়ার পর পরই সড়কে দু’পাশ থেকে বাজার, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেন। ফুটপাথ দখলমুক্ত করার পাশাপাশি রাস্তা থেকে ময়লা আবর্জনা সরাতে তিনি ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো ১৫ রোজার পর থেকে এই রুটে যানবাহনের চাপ যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে যানজটের ভোগান্তি। তিনি বলেন, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যানজটের দুর্ভোগ থেকে ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষদের মুক্তি দেয়া সম্ভব। এজন্য বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক মোতায়েন থাকবে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এই রুটে বিআরটি প্রকল্প সংকটের অন্যতম কারণ। প্রকল্পের কারণে চার লেনের সড়ক এক লেন হওয়ায় যানজটের ভোগান্তি বাড়ছে। দিন দিন গাড়ির চাপ বাড়ায় ভোগান্তি মাত্রা ছাড়াচ্ছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এনা পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ আতিকুল আলম বলেন, এখন ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যেতে দুই ঘণ্টার রাস্তা ছয় ঘণ্টা লাগছে। তিনি বলেন, জয়দেরপুর থেকে মহাখালী পর্যন্ত যেতে অথবা আসতে সময় লাগে সাড়ে চার ঘণ্টার বেশি। যানজটের কারণে ৫০টি গাড়ি দিয়ে যাত্রীসেবা দেয়া আমাদের কঠিন হচ্ছে। তিনি বলেন, জয়দেবপুর থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পের জন্য সড়ক সিঙ্গেল লেন হওয়ায় দ্রুত যানজট ছড়ায়। ঈদ উপলক্ষে প্রকল্পের কাজ বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, কাজ বন্ধ না হলে গাড়ির চাপ বাড়ায় ভোগান্তিও বাড়বে সমানতালে। বিআরটি আর ড্রেনেজ সমস্যা পুরনো ॥ পরিবহন সংশ্লিষ্টসহ স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে তিন বছর আগে ড্রেনেজ প্রকল্পের সংস্কার কাজ শুরু হলেও অদৃশ্য কারণে তা দিনের পর দিন বন্ধ রয়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলে রাস্তার এক লেনের বেশি অংশ পানিতে ডুবে থাকে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদি বৃষ্টি হয় তাহলে মোট সড়কের অর্ধেক পানিতে ডুবে থাকায় এক লেনে যানবাহন চলতে পারে। এতে যানজটের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া সড়কের বেশকিছু স্থানে বিভিন্ন মিল কারখানার পানি জমে থাকে। এ সমস্যা চলছে দীর্ঘ সময়। হাউজ বিল্ডিং থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কের মাঝখানে ১৫টির বেশি পয়েন্টে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ চলছে। রাস্তার মাঝখানে খোঁড়াখুঁড়ি করায় এমনিতেই দু’পাশে যানবাহন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। মহাখালী আন্তজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, আমরা ইতোমধ্যে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছি ঈদ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখা। তা না হলে এই সড়কে মহাদুর্ভোগ সৃষ্টি হবে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের কাজ বন্ধে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যদিও সোমবার বেশ কয়েকটি স্থানে বিআরটি প্রকল্পের কাজ চলমান ছিল। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, যেসব পয়েন্টে বিআরটির কাজ চলছে সেখানে চার লেনের সড়ক এক লেন হওয়ায় যানজট বেড়েছে। তারা ঈদের সময় এ প্রকল্পের কাজ বন্ধের দাবি জানান। জানতে চাইলে এনা পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ আতিকুল আলম বলেন, ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ দুই ঘণ্টা রাস্তা যেতে সময় লাগে কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা। এরমধ্যে চৌরাস্তা থেকে মহাখালী আসতে সময় লাগে সাড়ে চার ঘন্টারও বেশি। ঈদ মৌসুম উপলক্ষে গাজীপুর থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পের কাজ বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, যেসব পয়েন্টে বিআরটির কাজ চলছে সেখানে গাড়িগুলোকে এক লেনে চলতে হয়। তাই এখন ঢাকা-ময়মনসিংহ যেতে আগের চেয়ে তিনগুণ সময় লাগছে। ঈদ যত সামনে আসছে বাড়ছে গাড়ির চাপ। তাই এই সময়ে বিআরটি প্রকল্পের কাজ বন্ধ না হলে যানজটের ভোগান্তি থেকে যাত্রীদের মুক্তি দেয়া সম্ভব হবে না। দেড় কিলো সড়ক বন্ধ থাকে সারা বছরই ॥ এ যেন মামা বাড়ির আবদার। গাড়ি নিজের। অথচ পার্কিং করা হচ্ছে না নিরাপদ স্থানে। একটি জনবহুল সড়কের পাশে রাখা হচ্ছে বছরের পর বছর। এতে যানজটের ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে লাখো যাত্রীকে। টঙ্গী মিল গেট থেকে চেরাগআলী পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার সড়কের চিত্র এটি। রাস্তার দু’পাশে হাজারো পণ্যবাহী ট্রাক রাখা হয়।
×