ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারীর পতন!

প্রকাশিত: ০৮:৪৭, ২৮ মে ২০১৯

 কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারীর পতন!

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ২৮ মে দিনটি ছিল শুক্রবার। দেশে দেশে পাকিস্তানী সামরিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত হয়েছে। ব্রিটেনের শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য মাইকেল বার্নস মুক্তি সংগ্রামের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নিরস্ত্র অসহায় জনগণের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরতা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে যে কোন রকম সাহায্য দান বন্ধ রাখুন। এই দিন বীর মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাস্তায় জঙ্গলবাড়ি যাওয়ার পথে পাকবাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্যকে মনোহরপুর এলাকায় এ্যামবুশ করেন। এ এ্যামবুশে পাকবাহিনীর ২৫ জন সৈন্য হতাহত হয়। এতে পাকসেনারা পিছু হটে পুনরায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের চেষ্টা চালায়। কিন্তু তার আগেই এ্যামবুশ দল তাদের অবস্থান ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। পরে পাক বর্বররা মাগুরা ও মনোহরপুর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। সকালে মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার দক্ষিণে রাজারমারদীঘিতে পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করেন এবং বাঙ্কার উড়িয়ে দেন। এ অভিযানে ৪ জন পাকসেনা নিহত এবং বেশ কিছু অস্ত্র-গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। পাটেশ্বরীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা যাত্রাপুরের দিকে সরে পড়েন, তারপর নদী পার হয়ে মাদারগঞ্জ দিয়ে সোনাহাট চলে যান। সুবেদার আরব আলী ও অন্য মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চিম দিকে সরে গিয়ে ফুলবাড়িতে আশ্রয় নেন। সিআর চৌধুরী তার বিশেষ গেরিলা বাহিনীসহ দুধকুমার নদীর ওপারে চর-ভূরুঙ্গামারীতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তুমুল যুদ্ধের পর ভূরুঙ্গমারী পাকসেনাদের দখলে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা ভূরুঙ্গমারীর পূর্ব দিকে অসম সীমান্তের গোলকগঞ্জের সোনাহাট সীমান্ত সংলগ্নমুক্ত এলাকা সোনাহাট এবং পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার সাহেবগঞ্জ সীমান্তে আশ্রয় নেন। কুষ্টিয়া সফর শেষে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি হেমডিক ফ্যানডং কুষ্টিয়ার ধ্বংসলীলা সম্পর্কে এক রিপোর্টে উল্লেখ করেন, ‘শহরটি দেখতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বোমায় ধ্বংসপ্রাপ্ত জার্মানির শহরগুলোর মতো।’ ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলেন, ‘ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি রক্ষা পাবে।’ তিনি বাঙালী ও বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তানের নীতি সমর্থন করেন। শর্ষিনার পীর সাহেব মাওলানা শাহ আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ এক বিবৃতিতে যথাসময়ে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসার জন্য সেনাবাহিনীর প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন জানান। তিনি রাষ্ট্রবিরোধীদের নির্মূল করতে সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করার জন্য দেশপ্রেমিক জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির আহ্বায়ক খাজা খয়রুদ্দিন ঢাকায় এক সভায় বলেন, পাকিস্তানকে ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলকে নির্মূলে নিয়োজিত সশস্ত্র বাহিনীকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করা আমাদের ফরজ কাজ। স্বাধীনতাবিরোধী সাইদুল হককে আহ্বায়ক করে নোয়াখালী জেলা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এইদিন ইউএনআইএর বরাতে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের সফল সংঘর্ষ’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন রণক্ষেত্রে মুক্তিফৌজ তিন দিন ধরে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সফল সংঘর্ষ চালাচ্ছে। সীমান্তের ওপার থেকে জানা গেছে, রাজশাহী খ-ে আহত পাকসেনা বোঝাই দুটি নৌকা আক্রমণ করে চারজন শত্রুসেনাকে খতম করেছে। মহেরপুর, বগুড়া, মোগলহাট এবং বরিশালেও সংঘর্ষ বাধে। পাকসেনা খতমের হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। খুলনা জেলায় পাকবাহিনী তাঁবেদার লাগিয়ে ফসল কাটাচ্ছে। গ্রামে গ্রামে পাকসেনাদের অত্যাচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি ত্রিশ হাজার সাঁওতাল বাংলাদেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ আজ বিকেলে শ্রীহট্টের শ্রীপুর চা বাগান থেকে পশ্চিমা পাকহানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করেছে। এই সংঘর্ষে বেশ কিছু সংখ্যক পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী দুই ট্রাক ভর্তি অস্ত্রশস্ত্র দখল করেছে বলে বাংলাদেশ সূত্রে জানা গেছে। শ্রীপুর চা বাগান বাংলাদেশের তামাবিলের চার কিলোমিটার দক্ষিণে। গতকাল মুক্তিফৌজ তামাবিল সীমান্ত ফাঁড়িটি দখল করার সময় বিপুল সংখ্যক পাকফৌজ নিহত হয়। শিলিগুড়ি নিজস্ব সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, গতকাল দিনাজপুর জেলার পাঁচগড় থানা এলাকার অমরখানা সীমান্ত চৌকির দিকে আগুয়ান একদল পাকসেনার ওপর মুক্তিফৌজের কমান্ডোরা প্রচ- আক্রমণ চালায়। ভারতীয় সীমান্ডের গ্রাম চাউলহাটির বিপরীত দিকে এখান থেকে প্রায় পনেরো মাইল দূরে এই অমরখানা অবস্থিত। মুক্তিফৌজের আঘাতে চারজন পাকসেনা মারা পড়ে। ফ্রান্সের পত্রিকা ‘লা ফিগারোর মতে যুদ্ধের প্রথম মাসে অর্থাৎ প্রথম ত্রিশ দিনে বাংলাদেশ থেকে রফতানি-বাণিজ্যের ক্ষেত্রের পশ্চিম পাকিস্তান এক শ’ কোটি টাকা হারিয়েছে। এ বছরের জানুয়ারি মাসের শেষে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা জমা ছিল ১২৭ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৯০ কোটি টাকা। যুদ্ধের দরুন এপ্রিলের শেষে সেই অঙ্ক কমে ৮২ মিলিয়ন ডলারে, অর্থাৎ প্রায় ষাট কোটি টাকায় এবং বর্তমানে সেটা এসে ঠেকেছে ২০ কোটি টাকার কাছে। পাশ্চাত্যের অর্থ-বিশেষজ্ঞদের মতে, কোন দেশের সংরক্ষিত তহবিলে বিশ কোটি ডলার অর্থাৎ এক শ’ কোটি টাকা জমা থাকা উচিত। এর কম হলে সে দেশকে অর্থনৈতিক দেউলিয়া দেশ বলা হয়। পাকিস্তানের সংরক্ষিত তহবিলে এখন জমা আছে মাত্র ২০ কোটি টাকা। এদিক থেকে পাকিস্তান এখন দেউলিয়া দেশ। ফলে পাকিস্তানী টাকার মূল্যমান কমানো অনিবার্য হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান সরকার পাকিস্তানী মুদ্রার মূল্যমান কমাতে সম্মতও হয়েছে। কারণ এখন আর উপায় নেই। ফ্রান্সের ‘লা ফিগারো’ পত্রিকার এক খবরে বলা হয়েছে যে, মার্কিন সরকার পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে এ বছর ষাট কোটি টাকার সাহায্য দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু এখন আর তা দেয়া হচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২৫ মার্চ অর্থাৎ বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা যুদ্ধ শুরু করার দিন থেকে পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়া স্থগিত রেখেছে। ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুত সাড়ে একত্রিশ কোটি টাকার সাহায্য বন্ধ রয়েছে। এদিকে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট উপদেষ্টা মি. এম এম আহমদকে বাংলাদেশে যুদ্ধ বন্ধ না করা পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোন ঋণ দেবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে। জার্মান পত্রিকা ‘আলগেমাইনে জাইটুংয়ে’ এই মর্মে সংবাদ ছাপা হয়েছে যে, বাংলাদেশের যুদ্ধ চালাতে গিয়ে পাকিস্তানের রফতানি এখন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ এবং যুদ্ধ খাতে প্রচুর ব্যয়ের জন্য পাকিস্তান এখন আর্থিক দেউলিয়া দেশে পরিণত হয়েছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×