ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিশ্চিত হোক মায়ের অধিকার

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ২৮ মে ২০১৯

নিশ্চিত হোক মায়ের অধিকার

যে কোন নারীর চিরন্তন পরিচয় ‘মা’ এবং মা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম শব্দ। মাতৃত্বের মধ্য দিয়ে বংশানুক্রম ধারা টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব বর্তায় মায়ের ওপরই। আর নারীর পূর্ণতাও আসে মাতৃত্বে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, একজন মায়ের গর্ভকালীন সুস্থতাই পারে একটি সুন্দর ও সুস্থ শিশু জন্ম দিতে। তাই নিরাপদ মাতৃত্ব প্রতিটি মায়ের অধিকার। কিন্তু বাস্তবে আমাদের দেশে মাতৃত্ব আসলে কতটুকু নিরাপদ, তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। একটি পরিসংখ্যানে জানা যায়, প্রতিবছর সারা বিশ্বে প্রায় ২১ কোটি নারী গর্ভবতী হয়। এর দুই কোটিরও বেশি গর্ভজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন এবং আশি লাখের জীবনাশঙ্কা দেখা দেয়। এখনও আমাদের দেশে প্রতি ১ লাখ জীবিত জন্মে ১৭২ জন নবজাতকের মৃত্যু ঘটছে। প্রসবকেন্দ্রিক মোট মাতৃমৃত্যুর ৭৩ শতাংশ ঘটছে প্রসব পরবর্তী সময়ে। আর প্রথম ২৪ ঘণ্টাতেই মারা যায় মোট মাতৃমৃত্যুর ৫৬ শতাংশ। দেশে গর্ভপাতও বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে। এখনও বাড়িতে প্রসব হচ্ছে ৫৩ শতাংশ প্রসূতির প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ১৫ জন প্রসূতি। গরিব, অসচ্ছল জনগণের মধ্যে জটিলতায় ভোগার আশঙ্কা বেশি। মূলত গর্ভকালীন জটিলতা, দক্ষ স্বাস্থ্যসেবার অভাব, প্রয়োজনীয় যত্ন ও পুষ্টির অভাব, পরিবারের অসচেতনতা, প্রসব পরবর্তী সেবাযত্নের অপ্রতুলতা ইত্যাদি একজন মাকে ঠেলে দিচ্ছে সীমাহীন অনিশ্চয়তা, দুর্ভোগ আর কষ্টের মুখে। সঙ্গে সঙ্গে গর্ভজাত সন্তানটিও পড়ছে ঝুঁকির মধ্যে। প্রতিবছর ২৮ মে বিশ্বব্যপী ‘আন্তর্জাতিক নারী স্বাস্থ্য দিবস’ হিসেবে ১৯৮৭ সাল থেকে ‘নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। মাতৃস্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব ও এর কার্যকারিতা অনুধাবন করে ১৯৯৭ সাল থেকে বাংলাদেশেও যথাযথভাবে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হয়। প্রতিবারই একটি করে প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে যেমন, ‘কমাতে হলে মাতৃমৃত্যু হার, মিডওয়াইফ পাশে থাকা একান্ত দরকার’, ‘প্রতিটি জন্মই হোক পরিকল্পিত, প্রতিটি প্রসব হোক নিরাপদ’, ‘নিরাপদ প্রসব চাই, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চলো যাই’, ‘সকল প্রসূতির জন্য মানসম্মত সেবা আমাদের অঙ্গীকার’ ইত্যাদি। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- ‘মর্যাদা ও অধিকার, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসূতি সেবায় অঙ্গীকার। ‘মা ও শিশুমৃত্যু রোধ এবং তাদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতার বিষয়ে সবাইকে সচেতন করার পাশাপাশি এসব সমস্যা প্রতিরোধসহ মাতৃস্বাস্থ্য, নিরাপদ প্রসব, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সেবার গুণগত মান বৃদ্ধি সম্পর্কে মা, পরিবার ও সমাজের সকল স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সকলের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করাই এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য। শিশুর জন্মদান ও মাতৃত্ব সম্পর্কিত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা ও এসবের সুষ্ঠু সমাধানের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা এই দিবসটির অন্যতম উদ্দেশ্য। সেইসঙ্গে নিরাপদ মাতৃত্বকে নারীর অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং নবজাতকের মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার মতো বিষয়গুলো হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাতৃস্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ও মাতৃমৃত্যু রোধকল্পে ২০১৫ সালের মধ্যে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অর্জনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতিবছর ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালিত হচ্ছে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ ২০১০ সালে বাংলাদেশকে এমডিজি পুরস্কার এবং ২০১১ সালে সাউথসাউথ পুরস্কার প্রদান করে। এত সাফল্যের পরও সচেতনতার অভাবে গর্ভকালীন কিছু জটিলতার কারণে এখনও মাতৃমৃত্যুর হার আশানুরূপ হারে কমানো সম্ভব হয়নি। প্রসবকালীন সময়ে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন উচ্চ রক্তচাপ, মাথা ঘোরা, রক্তক্ষরণ এবং রক্তশূন্যতা। এছাড়াও এক্লাম্পশিয়া, প্রসব পরবর্তী সময়ে রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি এবং মায়ের আয়রনের অভাব। এসব কারণে মাতৃমৃত্যুর হারও বাড়তে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গর্ভকালীন জটিলতা, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা ও পরিবারের অবহেলা মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। কোন নারী প্রসূতি হলে আনন্দের পাশাপাশি তার নিরাপদ প্রসব পর্যন্ত নানা ধরনের ঝুঁকি ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগতে থাকে স্বজনরা। সবাই অপেক্ষায় থাকে ওই প্রসূতির প্রসবপূর্ব, প্রসবকালীন ও প্রসবপরবর্তী মাতৃত্বকালীন পূরো পর্ব নিরাপদে হওয়ার। ক্ষেত্রবিশেষে অনেক জটিল রোগের চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে প্রসব পর্বটি। এ জন্যই সবাই খোঁজে নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য সেবার নাগাল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি, গর্ভপাত, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের প্রভাবে প্রসূতি মায়ের মৃত্যু যেমন দেশে মাতৃমৃত্যুর বড় কারণ হয়ে উঠেছে, তেমনি এর সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ানের বিষয়টিও আলোচনায় সামনে চলে আসছে। দেশে প্রসবজনিত মাতৃমৃত্যুর মধ্যে এখনও সর্বোচ্চ ৩১ শতাংশের মৃত্যু ঘটছে রক্তক্ষরণে। এর পরেই বেশি ২৪ শতাংশের মৃত্যু হচ্ছে খিঁচুনিতে। পর্যাপ্ত ওষুধের অভাবে রক্তক্ষরণ কমানো যাচ্ছে না প্রত্যাশিত হারে। এসব জটিলতা থেকে মাকে অবশ্যই নিরাপদ রাখতে হবে এবং তাতে নিরাপদ থাকবে অনাগত শিশুটিও। কর্মজীবী মায়েদের ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা আরও বেশি। গর্ভবতী নারীদের কমপক্ষে ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটির প্রয়োজন। অনেক কর্মজীবী নারীদের, বিশেষ করে নারীশ্রমিকদের গর্ভাবস্থা নিয়েই অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয়। গ্রাম-গঞ্জে এ বিষয়ে অসচেতনার কারণে অনেকেই সংসারের বিভিন্ন কাজ এমনকি ভারি কাজকর্মও চালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেখানেও পরিবারের অনেকেই সহযোগিতা করে না। ফলে মা ও অনাগত সন্তানের জীবন পড়ে যায় ঝুঁকির মুখে। তাছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারী হাসপাতাল, চিকিৎসা, পর্যাপ্ত ডাক্তার, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব এখনও প্রকট। মা ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্যাটেলাইট ক্লিনিক এবং বিভিন্ন এনজিও বা সংস্থার মা ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর দৈন্যদশা, সার্বক্ষণিক ডাক্তারের অভাবে নিরাপদ মাতৃত্বের বিষয়টি হুমকির সম্মুখীন। দেশে বিচ্ছিন্নভাবে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে প্রসূতি চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হলেও এখন পর্যন্ত নারীদের জন্য বিশেষায়িত কোন হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। আরও নজরদারি বাড়ানোর জন্য পৃথক একটি ইনস্টিটিউট তৈরি করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য আলাদাভাবে প্রশিক্ষিত জনবল ব্যবস্থাপনাও এখন জরুরী হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে এখনও দক্ষ প্রসবকর্মীর অনেক ঘাটতি রয়েছে। দেশে ২২ হাজার মিডওয়াইফের বা ধাত্রী দরকার হলেও সরকারীভাবে আছে মাত্র এক হাজার ১৪৮ জন। যারা দেশের ৩৫০টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ২৯টি ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করছে। নিরাপদ মাতৃত্বকে নারীর অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে মা ও নবজাতকের মৃত্যুহার কমিয়ে আনা যায়। একজন গর্ভবতী মহিলা গর্ভকালীন সেবা, নিরাপদ প্রসবের জন্য যাবতীয় সেবা এবং প্রসব পরবর্তী সেবা পাওয়ার সব অধিকার রাখেন এবং তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ নারীই এখনও উপরোক্ত কোন অধিকারই প্রায় ভোগ করতে পারেন না। এসব কারণে মাতৃমৃত্যুর হার কমার যে ধীরগতি, তাতে গতি সঞ্চার করা এবং সে লক্ষ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী। মায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে প্রথম সন্তান প্রসবের পর ৩ থেকে ৪ বছর বিরতি দিয়ে পরবর্তী সন্তান নেয়া উচিত। গর্ভবতী মায়েদের ভারি কাজ বা ভারি জিনিস বহন না করা, নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া, টিকা নেয়া, প্রসব পূর্ব বা প্রসব পরবর্তী সময়ে নিয়মিত ডাক্তার দেখানো, বাড়িতে প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত ক্লিনিক ও হাসপাতালে স্থানান্তর করার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সহানুভূতি ও সহযোগিতাও অত্যন্ত জরুরী এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসে সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো গেলেই নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত হবে এবং সব শ্রেণীর মানুষ এই অধিকার পাবে। তাহলেই নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন সার্থক হবে। নারীর জন্য নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত হোক এবং সংরক্ষিত হোক নারীর অধিকার- এই হোক নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের প্রত্যাশা। লেখক : সাবেক ডিন ও চেয়ারম্যান, মেডিসিন অনুষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
×