ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাল্টে গেছে ঢাকা- চট্টগ্রাম সড়কের আগের চিত্র

যানজটের বিষফোঁড়া ৫০ মিনিটেই পার

প্রকাশিত: ০৯:৪৩, ২৭ মে ২০১৯

 যানজটের বিষফোঁড়া  ৫০ মিনিটেই পার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একেবারেই অবিশ্বাস্যরকম পাল্টে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বর্তমান চিত্র। ফোর-লেন প্রকল্প চালুর পর থেকেই যেখানে যানজটের ভোগান্তি ছিল নিয়মিত। এ নিয়ে যাত্রী থেকে শুরু করে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা সবাই ক্ষোভ জানিয়ে আসছিলেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইফলাইন হিসেবে পরিচিত ফোর-লেন প্রকল্প মানুষের কোন উপকারে আসবে না- এমন অভিমতও দিয়েছেন অনেকে। অথচ গত ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে অবসান ঘটেছে আগের সব সমালোচনার। নতুন দুই সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে উবে গেছে বিষফোঁড়া যানজট। এখন পুরো সড়কের কোথাও যানজট নিয়ে কারও কোন অভিযোগ নেই। এ যেন ম্যাজিক! ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বিভীষিকাময় অংশটুকুর নাম ছিল না’গঞ্জের সোনারগাঁও থেকে কুমিল্লার দাউদকান্দির গৌরীপুর। দূরত্ব ৩০ কিমির মতো। অথচ তীব্র যানজটে এইটুকু পথ কতক্ষণে পাড়ি দিতে পারবেন, তা নিয়ে চিন্তায় থাকতেন যাত্রীরা। এখন এসবই অতীত। কারণ, এই পথ এখন পাড়ি দেয়া যাচ্ছে মাত্র ৩০ মিনিটে! সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ মহাসড়ক দিয়ে দৈনিক প্রায় ৩৫ হাজারেরও বেশি যানবাহন চলাচল করে। তাই যানজটও ছিল প্রকট। এ যানজট নিরসনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গোমতী নদীর ওপর ১ হাজার ৪১০ মিটার দীর্ঘ ও ১৭ দশমিক ৭৫ মিটার প্রস্থের দ্বিতীয় গোমতী সেতু নির্মাণ করা হয়। এতে ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। আর সাড়ে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে মেঘনা নদীর ওপর ৯৩০ মিটার দীর্ঘ ও ১৭ দশমিক ৭৫ মিটার প্রস্থের দ্বিতীয় মেঘনা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৩ বছর ধরে কাজ চলার পর ৪১তম মাসে নির্মাণ শেষ হয় সেতু দু’টির। শনিবার সেতু দুটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় সড়কের চিত্র। কমে যানজটের ভোগান্তিও। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মেঘনা ও গোমতী নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় মেঘনা ও দ্বিতীয় গোমতী সেতু এবং দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতু শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করেন। বলা হচ্ছে ঢাকা চট্টগ্রাম ও বৃহত্তর সিলেট এই দুই অঞ্চলের মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার। এই উপহারে বেশ স্বস্তিতেই হবে ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা। এরই সুফলে ৩০ কিলোমিটারের যানজট পাড়ি দেয়া যাচ্ছে ৩০ মিনিটে। মূলত এই মহাসড়কের যানজট নিরসন করতেই দ্রুত এই দুটি সেতু নির্মাণের কাজ শেষ হয়। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক পুরোটাই ফোর লেন করা হলেও প্রকল্পের কাজের সঙ্গে সঙ্গে সেতুগুলো ফোর লেন হয়নি। এতে দেখা গেছে ফোর লেনের রাস্তা প্রতিটি সেতুর কাছে গিয়ে দুই লেন হওয়ায় যানবাহন পারাপারে দুর্ভোগ হয়। সৃষ্টি হয় যানজটের। তাছাড়া ওজন স্কেলও এই রুটে যানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ হিসেবে দাবি করে আসছিলেন তারা। দ্বিতীয় মেঘনা ও দ্বিতীয় গোমতী সেতুর প্রকল্প পরিচালক আবু সালেহ মোঃ নুরুজ্জামান বলেন, নতুন দু’টি চার লেনের সেতু চালু হওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মানুষের যাত্রা আরামদায়ক হয়েছে। ঈদে ঘরমুখো মানুষও এর সুফল পাবেন। আবার পুরনো দুই লেনের সেতু দুটিরও সংস্কার কাজ চলমান। আগামী ডিসেম্বরে সংস্কার কাজ শেষ হবে। রবিবার ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক নিয়ে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেও। তিনি বলেছেন, এই মহাসড়কে দুটি সেতু নতুন করে চালু হওয়ায় আশা করছি ঈদযাত্রা একেবারেই নিরাপদ হবে। যানজটের ভোগান্তি ছাড়াই ঘরমুখো মানুষ যেতে পারবেন। কুমিল্লা ও দাউদকান্দির যাত্রীরা জানিয়েছেন, তারা নিয়মিত ঢাকায় আসা-যাওয়া করেন। গত শুক্রবার রাত বারোটা পর্যন্ত দাউদকান্দি থেকে ঢাকায় পৌঁছতে চার থেকে ১২ ঘণ্টা সময় লাগত। অনেকেই বলছেন, এইটুকু রাস্তা অতিক্রম করতে আট থেকে ১২ ঘণ্টা সময় লাগত প্রায়ই। আজ ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বাস গৌরীপুর পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার অতিক্রম করছে মাত্র ৫০ মিনিটে। সে হিসাবে তীব্র যানজট লেগে থাকা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থেকে কুমিল্লার দাউদকান্দির গৌরীপুর পর্যন্ত পাড়ি দিতে লেগেছে ৩০ মিনিট। বিভিন্ন কোম্পানির পরিবহন চালকরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন যানজটে নাকাল মহাসড়কে দুটি সেতু চালুর পর তারা স্বস্তির দেখা পেয়েছেন। তাদের ভাষ্য, হাইওয়ে পুলিশ মহাসড়কে থামিয়ে বিরক্ত না করলে ঈদে তারা আনন্দে গাড়ি চালাতে পারবেন। আলাল নামে এক বাসযাত্রী গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ডে বলেন, দীর্ঘদিন ভোগান্তির পর আজ কুমিল্লায় ফিরতে আরাম পেলাম। মেঘনা, গোমতী সেতু অতিক্রমের সময় মন আনন্দে ভর উঠল। এতদিন চার লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যানবাহনগুলো দুই লেনের গোমতী ও মেঘনা সেতুতে ওঠার পর সেতুর দুই পাশে যানজটের সৃষ্টি হতো। বিশেষ করে শুক্রবার ও শনিবার, ছুটির দিন, ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবের সময় যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করত। এর ফলে ভোগান্তি পোহাতে হতো চালক ও যাত্রীদের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থেকে রোগী, নারী-শিশুসহ সব যাত্রীকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হতো। এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়ে তাই স্বভাবতই আনন্দিত এই পথের চালক-যাত্রীরা। ঢাকা থেকে কুমিল্লার দূরত্ব ৯৭ কিলোমিটার। গাড়ির চালকেরা বলছেন, এই পথ পাড়ি দিতে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা লাগার কথা। দেড় ঘণ্টায়ও যাওয়া যায়। কিন্তু তিনটি নদীর ওপর এতদিন দুই লেনের একটি করে সেতু থাকার কারণে কুমিল্লায় যেতে কত সময় লাগবে, তা কেউই বলতে পারতেন না। মেঘনা ও গোমতী সেতুতে ওঠার আগে টোল প্লাজায় আটকা পড়তে হবে কিনা, এমন আশঙ্কা নিয়েই যাত্রা শুরু করতেন যাত্রীরা। সেতু চালু হওয়ার পর গতকাল ছুটির দিন থেকে রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মহাসড়কে কোন যানজট নেই। এতে ঘুরমুখো যাত্রী, চালক, পরিবহন মালিকেরা খুশি। শাসনগাছা তিশা পরিবহনের ব্যবস্থাপক (সেলস) কাউছার আহমেদ বলেন, এই দুই দিন দেড় ঘণ্টায় ঢাকা থেকে কুমিল্লায় আসা যাচ্ছে। তবে তিনি জানান, সময় কম লাগলেও ভাড়া কমবে না। এশিয়া লাইন পরিবহনের ব্যবস্থাপক ইউসুফ খান বলেন, কুমিল্লা থেকে দাউদকান্দি মেঘনা-গোমতী সেতু পর্যন্ত যেতে সময় লাগে এখন ৪৫ মিনিট। বাকি ৪৫ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছানো যায়। ৯৭ কিলোমিটারের ভাড়া আসে ২০৩ টাকা। আমরা যাত্রীদের কাছ থেকে নিচ্ছি ২০০ টাকা করে। ভাড়া কমবে না। যাত্রীরা আরামে আসবে। দূরত্ব তো কমেনি।’ তিশা বাসের চালক শাকিল খান বলেন, মাত্র দেড় ঘণ্টায় আমরা ঢাকায় আসা-যাওয়া করতে পারছি। রাস্তা ফাঁকাই বলা চলে।’ আশ্রাফপুর বাস টার্মিনালে রয়েল কোচের যাত্রী মিল্লাত হোসেন, জাফর বলেন, আজ ঢাকা থেকে আসতে সব মিলে তাদের এক ঘণ্টা ৪০ মিনিট লেগেছে। তারা বলেন, তাদের খুবই ভাল লাগছে। এশিয়া এয়ারকন পরিবহনের যাত্রী মজিবুর রহমান বলেন, আগে দাউদকান্দির গৌরিপুর গেলেই যানজটে পড়তে হতো। দুই সেতুর কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো। এখন আর সেটি হবে না। আরামে ঢাকা থেকে এসেছেন বলে জানালেন। কুমিল্লা জেলা রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, সেতু দুটি উদ্বোধনের পর দেশের পূর্বাঞ্চলের মানুষ দুই সেতুর সুফল পাচ্ছে। এখন আর যানজট থাকবে না। ঢাকা-কুমিল্লা রুটে চলাচলকারী রয়েল পরিবহনের চালক আমির হোসেন বলেন, আমরা যানজট থেকে মুক্ত হয়েছি। এখন আর যানজটের আশঙ্কা নেই। সহজেই চলাচল করতে পারছি। নতুন দুই সেতু আমাদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে এসেছে। আর যাত্রীরাও বেশ খুশি। ‘যানজটের দিন শেষ। এখন সড়ক দুর্ঘটনাও কমে আসবে। দুই সেতু খুলে দেয়ার সুফল আমরা পাচ্ছি, যোগ করেন আবুল খায়ের। হাইওয়ে পুলিশের দাউদকান্দি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, মহাসড়কে যানজট নেই। স্বাভাবিক গতিতে যানবাহন চলছে। ঈদে এই সড়কে চলাচলকারী যাত্রীদের আর ভোগান্তিতে পড়তে হবে না।
×