ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া ২০ হাজার রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে ফেরত

প্রকাশিত: ০৯:৪২, ২৭ মে ২০১৯

 বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া ২০ হাজার রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে ফেরত

শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়ে ভয়ঙ্কর ও বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থী হিসাবে আশ্রিত রোহিঙ্গরা। গত এক বছরে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে দেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়ার পর আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে ২০ হাজার রোহিঙ্গাকে। রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসতে সাহায্য করার অভিযোগে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয়েছে তিন শতাধিক দালালকে। বাংলাদেশের ভুয়া পাসপোর্ট তৈরি করে পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা নানা মাদকসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মানবিক কারণে আশ্রয় দেয়া রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে যাতে দেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য এক ডজন তল্লাশি চৌকি বসিয়ে, পুলিশ প্রহরা দিয়ে, গোয়েন্দা নজরদারি করেও তাদের ক্যাম্পে রাখা যাচ্ছে না। গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে এই ধরনের তথ্য চিত্র ফুটে উঠেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে। শনিবার ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয় দুই নারী রোহিঙ্গা। বিমানে উঠার আগে তাদের আচরণে সন্দেহে আটক করা হয় তাদের। গত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে ঢাকা থেকে দুই নারীর পাসপোর্ট করা হয়। তাতে একজনের বাড়ি চট্টগ্রাম এবং অন্যজনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিক দেখিয়ে ভুয়া তথ্য দিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে বিদেশে যাওয়ার আগে আটক করা হয় দুই নারী রোহিঙ্গাকে। ওই দুই নারীর সঙ্গে দালাল ছিল, যারা কৌশলে সটকে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের ঘিরে এক শ্রেণীর দালাল গোষ্ঠীও গজিয়ে উঠেছে। তারা বাংলাদেশের জাল পাসপোর্ট তৈরি, নাগরিকত্ব প্রদান, বিদেশে বৈধ বা অবৈধভাবে পাচার করছে বলে জানা গেছে। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানার কাজীর দেউড়ী, স্টেডিয়াম ও সার্কিট হাউসের আশপাশের এলাকা থেকে ৫৪ রোহিঙ্গা নারীপুরুষ ও শিশুকে আটক করা হয়েছে। এসব রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে পুলিশ। তারা ভিক্ষা করার নামে মানুষকে বিরক্ত করত। এলাকায় সাধারণ পথচারী, রেস্টুরেন্টে আসা লোকজনের পথরোধ করে টাকা আদায় করত। রমজান শুরুর পর তাদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে যায় বলে পুলিশের দাবি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গারা ক্রমেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এসব রোহিঙ্গা ও দালালদের প্রতিহত করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে রোহিঙ্গরা। অনেক রোহিঙ্গাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধরে আবার শিবিরে ঢুকানো হয়েছে। সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর কঠোর নজর রাখছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই কর্মকর্তার দাবি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার সময় সরকারের পক্ষ থেকে হোটেল, রাস্তা, যানবাহনে সার্বক্ষণিক নজরদারি ও তল্লাশির ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ত্রিশটি ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ঢুকে পড়া এসব রোহিঙ্গারা প্রতিদিন ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গা আটক হচ্ছে। কাজের খোঁজ ছাড়াও শরণার্থী শিবিরের মানবেতর জীবন থেকে মুক্তি পেতে ও ধনী হওয়ার আশায় স্থানীয় দালাল চক্রের সহযোগিতায় বিদেশ পাড়ি দেয়ার ইচ্ছায় অনেক রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে যাচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া রোহিঙ্গারা মাঝেমধ্যে আটক হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দালালরা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কাঁটা তারের বেড়া দেয়ার কথা থাকলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গারা যাতে দেশের মূল জনস্রোতে মিশে যেতে না পারে সেজন্য টেকনাফ থেকে উখিয়া পর্যন্ত বসানো হয়েছে বেশ কয়েকটি চেকপোস্ট। পুলিশ, বিজিবি ও অন্যান্য সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এসব চেকপোস্টে তল্লাশি চালান। তবে এত সতর্কতার পরও রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ছে অন্যান্য এলাকায়। জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন পেশায়। উখিয়ার ফলিয়া পাড়া সড়ক দিয়ে প্রতিদিন ভোরে রোহিঙ্গাদের কাজের সন্ধানে বের হতে দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর সদস্য টাকার বিনিময়ে তাদের অবাধে বাইরে যেতে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রোহিঙ্গারা আসার পর বোরকার বিক্রি বেড়ে গেছে। ক্যাম্পের নারীরা বোরকা পড়েন। বোরকা পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যাওয়ার সুবিধা আছে। পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, চলতি বছর দেশের বিভিন্নস্থান থেকে বোরকা পরে পাসপোর্ট করতে গিয়ে দালালসহ পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন রোহিঙ্গা তরুণী। ঢাকার সূত্রাপুর থানার পুলিশ একটি হোটেল থেকে কয়েকজন রোহিঙ্গা নারীকে উদ্ধার করার ঘটনার নজিরও আছে। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলার কোন না কোন স্থানে ছেলে ধরা (শিশু চোর) রোহিঙ্গা সন্দেহে এলাকাবাসীর গণপিটুনি বা লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন এ দেশেরই বয়স্ক ভিক্ষুক ও মানসিক রোগীরা। রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা বাহিনীর চেকপোস্ট এড়িয়ে পাহাড়-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এলাকা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তারা এখন লোকাল ভাষা শিখে গেছে। পোশাক লোকালদের মতো পড়ছে। চেকপোস্ট দিয়ে দুই-চারজন যারা আসছে তারা স্পষ্টভাবে জায়গার নাম বলছে। সাধারণভাবে ধরা পড়লে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হলেও ইয়াবা নিয়ে ধরা পড়লেই শুধু রোহিঙ্গাদের জেল হাজতে পাঠানো হচ্ছে। যেসব রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার পরও রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে পালানো ঠেকানো যাচ্ছে না, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে দেশের সর্বত্র, নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা।
×