ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

পঞ্চম শিল্প বিপ্লব

প্রকাশিত: ০৮:৫০, ২৭ মে ২০১৯

পঞ্চম শিল্প বিপ্লব

চমকে ওঠার মতো বিষয় বটে। সারা দুনিয়া যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তখন বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম তাদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আলোচনার পাশাপাশি আলোচনা করছে পঞ্চম শিল্প বিপ্লব নিয়ে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আলোচনার সূত্রপাতটাও এই সংস্থাই করেছিল। উইকিপিডিয়ার তথ্য এরকম : বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের নির্বাহী চেয়ারম্যান ক্লাউস সোয়াবের ২০১৫ সালের একটি লেখা থেকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের শব্দগুলোর বিস্তার ঘটে। স্ইুজারল্যান্ডের ডাভোসে আয়োজিত ২০১৬ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘মাস্টারিং ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশন। ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর সানফ্রান্সিসকোতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কেন্দ্র স্থাপিত হয়। সোয়াব তার বইতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব চিহ্নিত করতে গিয়ে হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, জীববিদ্যার বিষয়গুলো ছাড়াও ডিজিটাল সংযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির প্রতি দিকনির্দেশ করেন। রোবোটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো টেকনোলজি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বায়ো টেকনোলজি, আইওটি, ৫জি, ৩ডি মুদ্রণ এবং সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় যানবাহন প্রযুক্তিকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বাহন হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন। আমার হাতে ২০১৬ সালে ব্রিটেন থেকে পেঙ্গুইন প্রকাশিত কার্লস সোয়াবের যে পেপারব্যাক বইটি স্নেহভাজন নুরুল কবিরের সৌজন্যে রয়েছে তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ২০১১ সালের হ্যানোভার মেলাতে প্রথম চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শব্দটি উচ্চারিত হয় এবং এর ধারণা প্রধানত প্রচলিত শিল্প-কলকারখানার ডিজিটাল উৎপাদন ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করে। সোয়াব অতীতের বিপ্লবগুলোকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তার সারাংশ হলো : কৃষি বিপ্লব বস্তুত শুরু হয় যখন মানুষ বন্য প্রাণীকে পোষা প্রাণীতে পরিণত করতে পারে তখন থেকে। তিনি সময়টি ১০ হাজার বছর আগের বলে মনে করেন। তিনি প্রাণীকে ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন, পণ্য পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের বিষয়টি উল্লেখ করেন। অবশ্য তিনি ভুলে যাননি যে এর সবটাই হয়েছে মানুষের হাতে। তার মতে কৃষি যুগের পরে ধারাবাহিকভাবে শিল্প বিপ্লব প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা সবাই জানি, বাষ্পীয় ইঞ্জিনভিত্তিক ছিল ১৭৬০ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত প্রথম শিল্প বিপ্লব। এর পরের বিপ্লবটা বিদ্যুতনির্ভর, যার সঙ্গে গণউৎপাদন, এসেম্বলী লাইন এবং বিদ্যুতনির্ভর প্রযুক্তির ব্যাপক সম্পর্ক ছিল। শোয়াব মনে করেন ষাটের দশকে সেমি কন্ডাক্টর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। এখনকার সময়টাকে তিনি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সময় বলে চিহ্নিত করেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কার্লস সোয়াবের ধারণা বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বদৌলতে সারা দুনিয়াতেই ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হতে থাকে। ইউরোপের এই ধারণা এখন আরও একটু বেশি জনপ্রিয় হয়েছে। বিশেষ করে মোবাইলের ৫ম প্রজন্মের বিস্তৃতি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারণাটিকে আরও জনপ্রিয় করেছে। অবস্থাটি এমন যে, বিশ্বের যে প্রান্তেই আগামী দিনের প্রযুক্তি বা শিল্প বিপ্লব নিয়ে আলোচনা হলে সেটির ভিত্তি অবশ্যই থাকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। যদি প্রশ্ন করা হয় ণ্ডে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কোন্ স্তরে আছি আমরা, তবে এর জবাবটা হবে আমরা এর মাঝেই বসবাস করছি। যদিও আরও কিছুটা সময় লাগবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পুরো স্বাদটা পেতে। এটি দৃশ্যমান হওয়াটা কেবল সময়ের ব্যাপার। আমরা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ডিজিটাল রূপান্তরের বিষয়টা উপলব্ধি করেছিলাম বলেই ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশকে আমাদের প্রতিপাদ্য হিসেবে ঘোষণা করি। এখানে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট করা দরকার যে, আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা এমনকি পঞ্চম শিল্প বিপ্লব এক নয়। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শিল্পোন্নত দেশের কৌশল, যাতে রয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও সংযুক্তি ব্যবহার করে তাদের হৃত শিল্প বিপ্লবকে পুনরুদ্ধার করার স্বপ্ন। প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, পুনরুদ্ধার মানে কি? বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। তবে এক কথায় বলতে গেলে একুশ শতকে এসে শিল্পোন্নত ইউরোপ, আমেরিকা বা জাপান অনুভব করছে যে, মানুষের অভাবে তারা বর্তমানের শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে পারছে না। প্রথমত পোশাক শিল্প বা অনেকটাই কায়িক শ্রমকেন্দ্রিক শিল্প উৎপাদনের শ্রমের যোগানদারে তারা থাকতে পারেনি। এসব শিল্প তাদের হাতছাড়া হয়ে চলে এসেছে বাংলাদেশ, নেপাল, ভিয়েতনাম বা এই ধরনের দেশে। কিন্তু মানুষ নিয়ে বড় সঙ্কটটা তাদের কেবল কায়িক শ্রম নয়, মেধাশ্রম নিয়েও। কারণ, মানুষ ছাড়া মেধারও বিকাশ ঘটে না। সেজন্য তারা ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় মানুষের ঘাটতিটা পূরণ করতে চায়। আমি আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে স্মরণ করতে পারি যে, ১৮ সালের মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে একজন জাপানী মন্ত্রীকে ড্রাইভারবিহীন গাড়ি পাবার জন্য উল্লাস করতে দেখেছি। তারই প্রতিবাদে আমি বলেছিলাম- মানুষকে বলি দিয়ে আমরা প্রযুক্তি চাই না। প্রযুক্তি মানুষের জন্য, মানুষ প্রযুক্তির জন্য নয়। এবার মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস এবং উইসিসেও একই কথা বলেছি। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে ইউরোপ বা আমেরিকার মতো করে ধারণ করতে চাই না। এমনকি প্রস্তাবিত ৫ম শিল্প বিপ্লবকেও শিল্পোন্নত দেশগুলোর মতো করে নিতে চাই না। বরং বাংলাদেশের নিজস্ব ঘোষণা ডিজিটাল বাংলাদেশ এসব বিপ্লবের ধারণার চাইতে অনেক বেশি গণমুখী। তবে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এবার জাপানে আয়োজিতব্য তাদের সম্মেলনে জাপানের সোসাইটী ৫.০ ধারনাটিকে প্রতিপাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। সঙ্গত কারণেই বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এখন পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের কথা বলছে। গত ১৫ মে এই সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত উত্তর বিষয়ক একটি নিবন্ধ বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিশ্বকে নতুন করে মূল্যায়ন করার পরিস্থিতি তৈরি করেছে। হুয়াট দ্য ফিফথ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশন ইজ এ্যান্ড হুয়াই ইট ম্যাটারস শিরোনামের একটি নিবন্ধে চতুর্থ ও পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের একটি তুলনা উপস্থাপন করেছে। নিবন্ধটির মূল প্রতিপাদ্য বস্তুত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জকেই উপস্থাপন করেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বৈশিষ্ট্যগুলোকে নিম্নরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। ১. কর্মসংস্থান ও দক্ষতার আমূল পরিবর্তন, ২. উদ্ভাবন ও উৎপাদনশীলতা, ৩. বৈষম্য, ৪. গতিশীল প্রশাসন, ৫. নিরাপত্তা ও বিরোধের বিস্তৃতি, ৬. ব্যবসার আমূল পরিবর্তন, ৭. অভাবিত প্রযুক্তি এবং ৮. নৈতিকতা ও ব্যক্তি পরিচয় সঙ্কট। এই আটটি বিষয় পর্যালোচনা করলেই একদিকে যেমন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আগ্রাসন অনুভব করা যায়, তেমনি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সঙ্কটগুলোও বোঝা যায়। সেজন্যই হয়ত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের মতো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যান্ত্রিকতা অতিক্রম করে পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের মানবিকতার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা বা শিল্পোন্নত দেশগুলোর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মাতামাতির মাঝে আকস্মিকভাবে এর নেতিবাচক দিকগুলোও আলোচনায় আসতে পারে সেটি আমি অন্তত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের কাছ থেকে আশা করিনি। কিন্তু অবশেষে জাপানে সম্মেলন হচ্ছে বলেই কিনা ১৯ সালের বিশ্ব অর্থনেতিক ফোরামের প্রতিপাদ্য হচ্ছে জাপানের স্বপ্ন সোসাইটি ৫.০। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম যাকে পঞ্চম শিল্প বিপ্লব বলছে তার একটু বিবরণ পেশ করা যেতে পারে। ৫ম শিল্প বিপ্লব : বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম নিজেই স্বীকার করেছে যে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এতটাই যান্ত্রিক যে, মানুষের জন্য সেটি বিপজ্জনক হতে পারে। মানুষের কর্মচ্যুতির পাশাপাশি প্রযুক্তির দাপট এমনভাবেই সম্প্রসারিত হতে পারে যে, মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় মানুষ একটু থমকে দাঁড়াতেই পারে। আমাদের মতো, ভারতের মতো বা চীনের মতো জনবহুল দেশগুলোর জন্য রোবট ব্যবহার করে মানুষের কর্মসংস্থান বিনষ্ট করাটা অবশ্যই ভাবনার বিষয়। চালকবিহীন গাড়ি জাপানের জন্য খুবই চমৎকার হতে পারে, জার্মানি পোশাক বানানোর রোবট নিয়ে আনন্দে নাচতে পারে; কিন্তু আমাদের কথা ভাবলে গা শিউরে উঠবে। এমনিতেই আমরা কর্মসংস্থানের সঙ্কটে নিমজ্জিত। এর মাঝে ডিজিটাল প্রযুক্তি যদি আমাদের কর্মহীন করে দেয় তবে রক্ষা নেই। আমরা তাই ডিজিটাল রূপান্তরের ভাল অংশটুকু নিতে চাই এবং ভয়ঙ্কর অংশটি ত্যাগ করতে চাই। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামও তাই ৫ম শিল্প বিপ্লবকে মানবিক বলছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ভয়ঙ্কর দিকটা কাটিয়ে চলার বিষয়ে ৫টি আশাবাদের কথা বলা হয়েছে। ক. বাণিজ্যের ডিজিটাল রূপান্তর পুঁজিবাদী অর্থনীতিতেও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে, শিল্প-কলকারখানাকে ক্রেতামুখী হতে হবে। ৫ম শিল্প বিপ্লবের লক্ষ্যটা তাই মানুষকে তথা ক্রেতাকে বাদ দিয়ে নয়। খ. ৫ম শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তি দিয়ে মানুষকে স্থলাভিষিক্ত না করে মানুষের জন্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করবে। বাক্যটা এরকম, ‘In the Fifth Industrial Revolution, humans and machines will dance together, metaphorically. At Davos 2019, an event sponsored by Forbes, MIT and Tata had the theme Blockchain+AI+Human = Magic. This equation seems impossible to some, but it can, and will, prove true. AI will help increase human labour productivity. Blockchain will help give access to banking (and intangible forms of capital) to the unbanked. Robots will help humans align returns on investment (ROI) with purpose. But it will require intentionality and moral clarity. গ. জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশের প্রত্যয় এসডিজিতে এমন কিছু বিষয় আছে যা সারা দুনিয়াকেই বস্তুত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ভয়ঙ্কর বিষয়গুলো এড়িয়ে শিল্প-বাণিজ্য তথা জীবনধারাকে ৫ম শিল্প বিপ্লবমুখী করতে উৎসাহিত করবে। এসডিজি বস্তুত মানবসভ্যতার সামাজিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোকে সমন্বিত করেছে। এজন্য ৫ম শিল্প বিপ্লবকে বিশ্ববাসী স্বাগতই জানাবে। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা যেমন ১. দারিদ্র্যহীন বিশ্ব, ২. ক্ষুধাহীন বিশ্ব, ৩. সুস্বাস্থ্য, ৪. উন্নত শিক্ষা, ৫. লিঙ্গ সমতা, ৬. সুপেয় পানি, স্যানিটেশন, ৭. ক্রয়ক্ষমতায় থাকা ক্লিন এনার্জি, ৮. সুকর্ম ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ৯. শিল্প, উদ্ভাবন ও অবকাঠামো, ১০. হ্রাসকৃত অসমতা, ১১. সাসটেইনেবল নগর ও সম্প্রদায়, ১২. দায়িত্বশীল ভোগ ও উৎপাদন, ১৩. জলবায়ু বিষয়ক কার্যক্রম, ১৪. জলজ প্রাণীর জীবন, ১৫. ভূমিতে বসবাসকারী প্রাণী, ১৬. শান্তি, বিচার ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, ১৭. লক্ষ্য অর্জনে পারস্পরিক সহায়তা। এসডিজির এসব লক্ষ্যমাত্রার মাঝে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম। ঘ. লিঙ্গ সমতায় বিশ্ববাসীর আগ্রহ। ঙ. এবং সামগ্রিকভাবে বিশ্ববাসীর অগ্রগতির সমন্বিত আকাক্সক্ষাকে আশাবাদের বিষয় হিসেবে বিবেচনা করছে। ঢাকা, ২৫ মে ১৯ ॥ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান-সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক
×