ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতের রাজনীতিতে নেহরু পরিবারের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন

প্রকাশিত: ১০:২৬, ২৬ মে ২০১৯

 ভারতের রাজনীতিতে  নেহরু পরিবারের  নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ ভারতে সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জয় পেয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। অন্যদিকে বিরোধীদল কংগ্রেস ও এর নেতৃত্ব কার্যত বিধ্বস্ত। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী প্রভাবশালী নেহরু গান্ধী পরিবারের অন্যতম উত্তরাধিকারী। দলের অন্যসব নেতাকর্মী এখনও ধাতস্থ হয়ে উঠতে পারেননি বিষয়টি। খবর বিবিসি। স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের একেবারে কেন্দ্রস্থলে ছিল নেহরু পরিবার। রাহুল গান্ধীর প্রপিতামহ জওহরলাল নেহরু ছিলেন দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তার পিতামহী ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া পিতা রাজীব গান্ধী ছিলেন ভারতের তরুণতম প্রধানমন্ত্রী। এবারের নির্বাচনের আগে পর্যন্ত বলা হতো ২০১৪ সালের নির্বাচনের ফল ছিল কংগ্রেসের জন্য সবচেয়ে খারাপ। ওই নির্বাচনে কংগ্রেস পেয়েছিল ৪৪টি আসন এবার পেয়েছে ৫২টি আসন। কিন্তু এবার একটা বাড়তি আঘাত হলো, উত্তর প্রদেশের আমেথিতে রাহুল গান্ধী পার্লামেন্টে তার নিজের আসনটিও খুইয়েছেন। আসনটির সঙ্গে তার পরিবারের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে। পারিবারিক আসন হাতছাড়া হলেও রাহুল অবশ্য এমপি হয়েছেন অন্য রাজ্য থেকে। আগামী পার্লামেন্টে রাহুলকে বসতে দেখা যাবে কেরালার এক আসন থেকে। কেরালার ওয়নাডের ওই আসন থেকে তিনি নির্বাচন করেন এবং জেতেনও। কিন্তু আমেথিতে রাহুলের পরাজয়ের গুরুত্ব-তাৎপর্য অনেক। বিবিসির গীতা পা-ে লিখেছেন, রাহুল গান্ধীর পারিবারিক পূর্বসূরিদের চিরকালের পাকা আসন এই আমেথি । সেখান থেকে তার পিতামহী ইন্দিরা, বাবা রাজীব ও মা সোনিয়া সবাই জিতেছিলেন, এমনকি রাহুল নিজেও গত ১৫ বছর ধরে ওই আসনে জিতে আসছিলেন । তাই আমেথিতে রাহুলের হেরে যাওয়া এক বিরাট অপমান। ওই আসনে রাহুল হেরে গেছেন বিজেপির স্মৃতি ইরানীর কাছে, যিনি অভিনেত্রী থেকে রাজনীতিতে এসেছেন। তবে এটাও ঠিক এবারের নির্বাচনে কংগ্রেস জিতবে এমনটা খুব কম লোকই ভেবেছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ অন্তত এটুকু আশা করেছিল যে ২০১৪ সালের চেয়ে এবার ভাল ফল করবে কংগ্রেস। কিন্তু তা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মতো কংগ্রেস নেতাকর্মীদের বিস্মিত করেছে। ফল ঘোষণার পর রাহুল বলেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং শেষ পর্যন্ত তারা জয়ী হবেনই। কিন্তু লক্ষেèৗ শহরে কংগ্রেসের অফিসে যে ক‘জন কর্মী টিভির পর্দায় তাদের দলের বিপর্যয়ের খবর দেখছিলেন, তাদের কাছে সে সম্ভাবনা এক মরীচীকা বলেই মনে হচ্ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মী বলেন, আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা খুবই কমে গেছে, আমাদের প্রতিশ্রুতি লোকে বিশ্বাস করছে না। অন্যদিকে মোদি প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও লোকে তার কথা বিশ্বাস করছে। কিন্তু কেন করে সে প্রশ্নের উত্তর তাদের কাছেও নেই। দলের ফল বিপর্যয়ের পর রাহুলের নেতৃত্ব টিকবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তবে ফল ঘোষণার দিনই রাহুল নিজেই সরে দাঁড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। পার্টির সায় না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত রাহুল স্বপদেই থাকছেন বলে জানা গেছে। কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ মণিশংকর আয়ার বলেছেন, পরাজয়ের কারণ নেতৃত্ব নয়। তিনি বলেন, কংগ্রেস রাহুলের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না, তিনি পদত্যাগ করতে চাইলেও তা তারা মানবেন না। স্থানীয় অনেক নেতার কথায় রাহুলের নেতৃত্বের চেয়েও দলের ভেতরের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং নির্বাচনে প্রচার কৌশলে ভুল করেছিল। এছাড়া কংগ্রেসের বিশ্লেষকরা একথাও বলেছেন যে, মোদির ব্যক্তিত্বের সঙ্গে রাহুল আসলেই পেরে ওঠেননি। তারা মোদির মতো কোন ব্র্যান্ড কংগ্রেস সামনে আনতে পারেনি। তারা বলেন, নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন কিন্তু তার কথায় এখনও লোকে আস্থা রাখে। অন্যদিকে রাহুলের কোন সম্মোহনী শক্তি নেই, লোকজনের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন না, তিনি দিকভ্রান্ত এবং প্রায়শ নানা রাজনৈতিক ভুল করে বসেন। মোদি নিজেই অনেকবার বলেছেন যে, রাহুল গান্ধী এ অবস্থানে এসেছেন নিজের যোগ্যতায় নয়, বরং পারিবারিক যোগাযোগের কারণে। কংগ্রেসের অনেক সদস্য মনে করেন, রাহুল একজন সহজ-সরল মানুষ, প্রতিপক্ষের কৌশলী ধূর্ততা তার মধ্যে নেই। নেহরু-গান্ধী পরিবার থেকে ভারতের তিনজন প্রধানমন্ত্রী এসেছেন ঠিকই কিন্তু ঐতিহ্য এখন কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে। এ যুগের ভারতের উচ্চাভিলাষী তরুণদের কাছে নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধী আর প্রাসঙ্গিক নন, তাদের অবদান অনেকদূর অতীতের ইতিহাস মাত্র। একালের প্রজন্মের কাছে বরং কংগ্রেসের ২০০৪-২০১৪ শাসনকালের বিতর্ক-দুর্নীতিই মনে গেঁথে আছে। এটা স্পষ্ট যে এই প্রজন্মের কাছে রাহুল গান্ধী তার ‘ভিশন’ বিক্রি করতে ব্যর্থ হয়েছন। কংগ্রেসের নেতারা তাদের এই বিপর্যয়ের জন্য রাহুলকে দোষ দিতে চান না। তবে একজন বলেছেন, রাহুল গান্ধীর একজন ‘অমিত শাহ’ দরকার - যিনি তার জন্য নির্বাচনী জয়ের কৌশল তৈরি করতে পারবেন। যেমনটা বিজেপির সভাপতি মোদির জন্য করেছেন। সাম্প্রতিক রাহুলের ইমেজ আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছিল। ফেব্রুয়ারিতে যখন তার বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী উত্তর প্রদেশের প্রচারে যোগ দেন তখন অনেকে মনে করেছিলেন দুজনে মিলে কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলতেও পারেন। অনেক কংগ্রেস সমর্থক মনে করেন রাহুল নয় প্রিয়াঙ্কাই এ পরিবারের বংশানুক্রমিক রাজনীতিকে রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু প্রিয়াঙ্কা সে দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। মনে করা হয় রাহুল ও প্রিয়াঙ্কার সম্পর্ক যথেষ্ট ভাল। ভাইকে হটিয়ে তিনি এখনই দলের হাল ধরবেন সে সম্ভাবনা কম। তবে আগামীতে একটা বড় ভূমিকা পালন করবেন বলে সবাই আশা করছেন। অনেকের মতে, মোদি যেভাবে ভারতের রাজনৈতিক স্পন্দন ধরতে পেরেছেন এবং তা প্রভাবিত করেছেন; কংগ্রেস সেখানে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের আত্মানুসন্ধান করতে হবে, কেন এটা ঘটল তা বের করতে হবে, বলছেন দলটির নেতারা। তারা আরও বলছেন, নির্বাচনের ফল যতই খারাপ হোক, রাহুল গান্ধীর পাশে তারা থাকবেন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, শুধু রাহুল নয় অনেক নেতাই তো হেরে গেছেন। সব নির্বাচনেই এটা হয়, অনেকে জেতেন, অনেকে হারেন। তারা আরও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ১৯৮৪ সালে বিজেপিই মাত্র দুটি আসন পেয়েছিল। তারা সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে এখানে আসতে পারে, তাহলে আমরাও পারব।
×