ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রতারণার ফাঁদে ৫৪ সদস্য

প্রকাশিত: ০৯:৩৮, ২৬ মে ২০১৯

প্রতারণার ফাঁদে ৫৪ সদস্য

স্টাফ রিপোর্টার, পঞ্চগড় ॥ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর এলাকার রজনীগন্ধা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি জহিরুল ইসলাম জহিরের বিরুদ্ধে সমিতির সদস্যদের না জানিয়ে তাদের নামে সমবায় ব্যাংক থেকে ৩০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। ২০১৩ সালে নেয়া ওই ঋণের বিষয়ে সদস্যরা কিছু না জানলেও তাদের বিরুদ্ধে ঋণখেলাপী মামলা হয়েছে। সমিতির ধূর্ত সভাপতি জহিরুলের প্রতারণা মামলার শিকার হয়ে নিরীহ সদস্যরা চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন। সদস্যদের অধিকাংশই গরিব দিনমজুর ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ঋণখেলাপীর মধ্যেই জহির আবারও নতুন কৌশলে ঋণের পাঁয়তারা করছেন বলেও অভিযোগ করেন সংশ্লিষ্টরা। জানা যায়, ২০১২ সালে তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর এলাকার রজনীগন্ধা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড সমবায় অধিদফতরের রেজিস্ট্রেশন পায়। সমিতির বর্তমান সদস্য ৪২৩ জন। সদস্যদের কাছে সঞ্চয় গ্রহণ ও ঋণ বিতরণ করা হয় এই সমিতি থেকে। ২০১৩ সালের অক্টোবরে সমিতির ৬০ সদস্যের নাম দিয়ে সমবায় ব্যাংক থেকে গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের আওতায় জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা করে ৩০ লাখ টাকা ঋণ নেয় সমিতির সভাপতি জহিরুল ইসলাম। সমিতির যেসব সদস্যের নামে ঋণ নিয়েছেন তাদের অধিকাংশই এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। তাদের নামে ঋণখেলাপী মামলা হওয়ার পর বিষয়টি জানতে পারেন। সদস্যদের অভিযোগ, গোপনে কারও সঞ্চয়পত্রের কথা বলে স্বাক্ষর নিয়ে আবার কারও স্বাক্ষর জাল করেই বিরাট অঙ্কের এই ঋণের টাকা উত্তোলন করেন জহির। এ ক্ষেত্রে সমবায় ব্যাংক ও সমবায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেয়ার অভিযোগ তুলেছেন তারা। গোপন সূত্রে জানা যায়, সমিতির সদস্যদের নামে টাকা উত্তোলন করে সংগঠনের সভাপতি জহির সমিতির ৬ সদস্যের ব্যবস্থাপনা কমিটির যোগসাজশে নামমাত্র গরু মোটাতাজাকরণ খামার করে বাকি টাকা আত্মসাত করে। ব্যবস্থাপনা কমিটির সবাই জহিরের খুব কাছের মানুষ। এদের কেউ তার পরিবারের সদস্য আবার কেউ নিকটাত্মীয়। গরু মোটাতাজাকরণ খামার করে কয়েক মাস যেতে না যেতেই অর্ধেক গরু অসুস্থ হয়ে মারা যায় বলে প্রচার করে সে। এরপরেই শুরু হয় তার লোকসানি নাটক। সমিতির ৬০ সদস্যের ব্যক্তি নামে তোলা ঋণে জহিরের করা গরু মোটাতাজাকরণ খামারের বিষয়েও অধিকাংশ সদস্য কিছুই জানতেন না। যারা তার খুব কাছের মানুষ তারাই কেবল বিষয়টি জানতেন। আবার কেউ কেউ জানতেন তার ব্যক্তিগত খামার হিসেবে। সমিতির পক্ষ থেকে সেখানে ১শ’ গরু নিয়ে খামার করার কথা বললেও সেখানে তার অর্ধেক গরুও ছিল না বলে জানান স্থানীয়রা। গরু রাখার সে শেড নির্মাণ করা হয়েছিল তাতে ২০ থেকে ৩০ গরুর বেশি ধরবে না বলেও তারা জানান। গরু মারা যাওয়ার দাবি করলেও সে সমবায় ব্যাংকের কাছে কোন তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। এক বছর মেয়াদে সমান দুই কিস্তিতে ঋণের টাকা পরিশোধ করার কথা থাকলেও তা পরিশোধ করা হয়নি। পরে ব্যাংক ঋণ পরিশোধে আরও তিন বছর সময় বৃদ্ধি করলে নির্ধারিত সময়ে মাত্র ৬ জনের টাকা পরিশোধ করা হয়। জহিরসহ বাকি ৫৪ জনের টাকা পরিশোধ করা হয়নি। এরপর সমবায় ব্যাংক থেকে উকিল নোটিস পাঠানো হয় ওই ৫৪ জনের নামেই। সেটিও গোপন রাখেন জহির। এরপর চলতি বছরের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের পক্ষে ব্যাংক কর্মকর্তা জুবায়েদ আহাম্মদ পঞ্চগড় আদালতে ঋণখেলাপীর অভিযোগে ৫৪ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। মামলাটি বর্তমানে আদালতে চলমান রয়েছে। ৫৪ জনের নামে নেয়া ২৭ লাখ টাকা সুদে-আসলে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা। অধিকাংশ সদস্যের নামে নেয়া ঋণের ৫০ হাজার টাকা এখন সুদে-আসলে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯১ হাজার টাকা। কোন টাকা না নিয়েও এখন একদিকে সুদে-আসলে ৯১ হাজার টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে নিরীহ সদস্যদের। অপর দিকে মামলার ভোগান্তি রয়েছেই। তাদের দাবি সমিতির সভাপতি জহিরের কারণেই তাদের এই বদনামের সঙ্গে সঙ্গে এই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সমিতির সদস্য মতিয়ার রহমান বলেন, জহির আমার নামে ঋণের টাকা নিয়েছে তা আমি কিছুই জানি না। তারা টাকা নিয়ে কি করেছে তাও জানি না। হঠাৎ করে দেখি আমার নামে মামলা হয়েছে। তখন আমি জানতে পারি সে আমার নামে ঋণ নিয়েছে। আমি কোন ঋণ না নিয়েও যদি আমাকে ঋণের বোঝা বহন করতে হয় তাহলে বাঁচব কেমনে। আমরা জহিরের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। সমিতির সদস্য আজগর আলী বলেন, আমরা ঋণের বিষয়ে কিছুই জানি না। জাল স্বাক্ষর করে জহির আমাদের নামে টাকা তুলেছে। ওই টাকায় সে কী করেছে তাও আমরা জানি না। এখন দেখি আমাদের নামে মামলা হয়েছে। জহিরুল এখন আমাদের কোর্টে গিয়ে স্বীকার করতে বলতেছে যে আমরা ঋণ নিয়েছি। স্বীকার করলেই নাকি সে আমাদের সবার টাকা পরিশোধ করবে। আমরা তাকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি আদালতে মিথ্যে বলতে পারব না বরং আমরা তার বিচার চাইব। ভুক্তভোগী ইলিয়াস বলেন, সমিতির সদস্য হিসেবে বিভিন্ন সময়ে আমাদের কাছে স্বাক্ষর নেয় জহির। কিন্তু কখন ঋণের স্বাক্ষর নিয়েছে তা আমরা জানিই না। আমাদেরকে এ বিষয়ে কিছুই জানায়নি। মামলা হওয়ার পর আমরা মানুষের মাধ্যমে জানতে পারি যে আমাদের নামে মামলা হয়েছে। আপন দুলাল নামের আরেক ভুক্তভোগী বলেন, আমি গরিব মানুষ ভাই। রজনীগন্ধায় আমার অল্প কিছু সঞ্চয় ছিল। তাও তুলে ফেলছি। এখন শুনতেছি ২০১৩ সালে আমার নামে ঋণ নেয়া হয়েছে। তা সুদে-আসলে ৯১ হাজার হয়ে গেছে। সেটার মামলাও হয়ে গেছে। আমি তো এসবের কিছুই জানি না। এত টাকা এখন আমি শোধ করব কিভাবে। ভজনপুর বাজারের হোটেল শ্রমিক আনিসুর রহমান জানান, আমি হোটেল শ্রমিক আমার নামে জীবনে মামলা হয়নি। এখন ঋণ না নিয়েও আমি ঋণের মামলার আসামি। খুব সমস্যায় পড়ে গেছি। ভজনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মকসেদ আলী বলেন, জহির সদস্যের না জানিয়ে তাদের নামে ঋণ নিয়েছে বলে সদস্যরা আমার কাছে অভিযোগ করেছে। আমি বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছি। সে সবার ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব নেবে বলে আমাকে জানিয়েছে। তবে যারা ঋণটি দিয়েছে তাদের আরও খোঁজ খবর নিয়ে ঋণটি দেয়া দরকার ছিল। তাহলে সাধারণ সদস্যরা এভাবে প্রতারিত হতো না। তেঁতুলিয়া উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা ফারুক হোসেন জানান, আমি যোগদানের আগেই এই ঋণটি তারা নিয়েছে। তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় তাদের বিরুদ্ধে সমবায় ব্যাংক মামলা করেছে। যেহেতু বিষয়টি আদালতে চলমান রয়েছে তাই এ বিষয়ে তেমন কিছু বলতে চাই। কারও এ বিষয়ে অভিযোগ থাকলে তারা আদালতে জানাতে পারে। মামলার বাদী ও পঞ্চগড় সমবায় ভূমি উন্নয়ন ব্যাংক লিমিটেডের ম্যানেজার জুবায়েদ আহাম্মদ বলেন, যে ৫৪ জনের নামে মামলা হয়েছে ঋণের সময় তাদের প্রত্যেকের স্ট্যাম্পে ও চেকে স্বাক্ষরের পর তাদের ৫০ হাজার টাকা করে ঋণ দেয়া হয়েছে। এমনটা হতে পারে অনেকে না বুঝেই স্বাক্ষর করেছেন। তবে তারা এখন এর দায় এড়াতে পারবেন না। রজনীগন্ধা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির সভাপতি জহির সবার পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিল। আমরা তাকে আরও ৩ বছর সময় দিয়েছিলাম। কিন্তু বাড়তি সময়েও ঋণটি পরিশোধ করা হয়নি।
×