ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শত্রুকে বিশ্বাস করার অর্থ অনিবার্য মৃত্যু ॥ ২৬ মে, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ২৬ মে ২০১৯

 শত্রুকে বিশ্বাস করার অর্থ অনিবার্য মৃত্যু ॥ ২৬ মে, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ২৬ মে দিনটি ছিল বুধবার। এই দিন মুক্তিবাহিনী কুমিল্লার জগন্নাথ দীঘিতে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর অকস্মাৎ আক্রমণ চালায়। অভিযানে পাকবাহিনীর ১৯জন সৈন্য হতাহত হয়। এ অভিযানের নেতৃত্ব দেন লে. ইমামুজ্জামান। মুক্তিবাহিনীর টহলদল ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা সড়কের ওপর উজানিশার সেতুর কাছে পাহারারত পাকসৈনিকদের ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। অকস্মাৎ আক্রমণে পাকবাহিনীর ১৩জন সৈন্য নিহত ও ৩জন সৈন্য আহত হয় এবং বিস্ফোরক লাগিয়ে একটি স্প্যান ধ্বংস করা হয়। পাকিস্তানী সৈন্যরা ভারি কামানের সাহায্যে মুক্তিবাহিনীর পাটেশ্বরী প্রতিরোধ ঘাঁটিতে তীব্র আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা ভূরুঙ্গামারীর দিকে ফিরে আসে। সুবেদার বোরহানের নেতৃত্বে হালকা ও যৎসামান্য কিছু অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ঘোগাদহ, পাটেশ্বরী ও পাঁচগাছি এলাকায় অবস্থান নেয়। সুবেদার আরব আলী পাটেশ্বরীর পশ্চিম বরাবর উত্তর-পশ্চিম দিকে তার অবস্থান থেকে আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকেন। কিন্তু অস্ত্র গোলাবারুদের অপ্রতুলতায় পাটেশ্বরীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রমেই শোচনীয় হয়ে পড়ে। হেডকোয়ার্টারে সাহায্য চেয়ে সংবাদ পাঠানো হতে থাকে। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে হেডকোয়ার্টার থেকে যথোপযুক্ত সাহায্য না পাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ভেঙে যায়। এদিন কুড়িগ্রাম এলাকাতে মুক্তিবাহিনীর একটি টহলদার দলের সঙ্গে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বেশ ক্ষতিসাধন করে নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে আসে। কুড়িগ্রামে কালুর ঘাট নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘রেকি’ দলের সঙ্গে পাকবাহিনীর সম্মুখ সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ২জন সৈন্য নিহত হয়। ছাত্রকে ১৮ জন যুবক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে যাওয়ার পথে বেতুরার পাকির চেয়ারম্যান ও তার দলের হাতে ধরা পড়ে। এদেরকে তারা পাক হায়েনাদের হাতে তুলে দেয়। হায়েনার দল এই ১৮ যুবকের ১৭ জনকে ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ রাস্তার মাধবপুরের কাছে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। এতে সবাই নিহত হয়। সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় পাক বর্বররা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। বুরুঙ্গাবাজারে বর্বরদের পৈশাচিক নির্যাতনে ৮১ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের চার্লস ডব্লিউ ব্রে ওয়াশিংটনে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি পাকিস্তানের একটি ঘরোয়া রাজনৈতিক ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র কামনা করে না এ থেকে উপমহাদেশে কোন দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক। সে জন্য মার্কিন সরকার পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি সম্পর্কে সংযত মনোভাব গ্রহণ করার জন্য ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী কিথ হেলিয়র্ক সিঙ্গাপুর সফরকালে উপমহাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সাংবাদিকদের বলেন, নিউজিল্যান্ড পূর্ব পাকিস্তানের ট্র্যাজেডিতে নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। নিউজিল্যান্ড সরকার ও জনগণ মানবিক কারণে বাঙালী উদ্বাস্তুদের প্রতি সহানুভূতিশীল। করাচীর চীনা কনস্যুলেট জেনারেল নিয়েহ বুন চি বলেন, স্বাধীনতা রক্ষার ন্যায্য সংগ্রামকে চীন সব সময় পাকিস্তানকে সমর্থন জানাবে। বৈদেশিক আক্রমণ ও হস্তক্ষেপ মোকাবেলায় চীন পাকিস্তানীদের পাশে দাঁড়াতে কুণ্ঠাবোধ করবে না। মুসলিম লীগের সভাপতি খান আবদুল কাইয়ুম খান পেশোয়ারে বলেন, আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ছিল একটি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। এদিন কবি বেনজীর আহমদকে সভাপতি করে আড়াইহাজার থানা শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এই দিন জয়বাংলার, ১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যায় ‘খোদ ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর হামলা : এক সপ্তাহে আরও ৬ শত শত্রুসৈন্য খতম’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক সপ্তাহের সংগ্রামে মুক্তিবাহিনীর হাতে আরও ৬ শতাধিক শত্রুসৈন্য প্রাণ হারায়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ঢাকায় গবর্নর হাউস, দৈনিক পাকিস্তান, সেক্রেটারিয়েট ভবন ও নিউ মার্কেটের মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকে হাতবোমা দিয়ে আক্রমণ চালায়। বিভিন্ন জেলায় মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালিয়ে পাকফৌজের কাছ থেকে বহু অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নিয়েছে। কাঠমন্ডু থেকে প্রকাশিত নিউ হেরাল্ড পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে শরণার্থীদের ব্যাপক অন্তঃপ্রবাহে বোঝা যায় এটি এখন আর পাকিস্তানের নিজস্ব কোন ব্যাপার না- যা সাধারণত তারা ও তাদের সহযোগীরা এতদিন বলে এসেছে। এতে প্রমাণিত হয় পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ, ১৯৭১ থেকে সেখানে কি ভয়ানক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সন্ত্রাস এখনও চলছে যার ফলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতের পূর্ব দিকের রাজ্যগুলোতে বাঙালীদের প্রবেশ অব্যাহত আছে। উদ্বাস্তুদের সংখ্যা ইতোমধ্যে প্রায় ৩.৫ মিলিয়নে পৌঁছেছে। এতে ভারতের সম্পদের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই ভারত পূর্ব পাকিস্তানের কারণে তাদের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে সেটা বিশ্ববাসীকে জানানোর চেষ্টা করছে। নিজেদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে ভারতের পক্ষে শরণার্থীদের অনির্দিষ্টকালের জন্য খাওয়ানো সম্ভব না। বিশ্ব জনমত এখন ধীরে ধীরে ভারতের পক্ষে যাচ্ছে। ক্যানবেরা থেকে প্রকাশিত দি এজ পত্রিকার ’জাতিসঙ্ঘের প্রতি চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান ট্র্যাজেডির পূর্ণ মাত্রার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারত সীমান্ত জুড়ে বসবাসরত অসহায় উদ্বাস্তুদের বিশাল বহর দেখে এবং তাদের অব্যাহত প্রবাহের মাধ্যমে। এদিন পিটিআই এর বরাত দিয়ে ন্যাশনাল হেরাল্ড ’নির্যাতনের চিত্র’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করেন। হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ’মেঘালয়ের সীমান্তে গোলাবর্ষণ’ শিরোনামে সংবাদে বলা হয়, যদিও অফিসিয়াল সূত্র মতে আজ মেঘালয় গারো হিল জেলার দালু সেক্টরে পাকিস্তানীদের আক্রমণে ২২ জন মারা গেছে যাদের ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ৯ জন আছে। অসমের প্রধানমন্ত্রী মহেন্দ্রমহন চৌধুরী আজ সন্ধ্যায় এসেম্বলিতে বলেছেন বিএসএফ সফলভাবে পাকিস্তানের আগ্রাসন অসমের বাংলাদেশ বর্ডারের তিনটি সেক্টর থেকে প্রতিহত করেছে। প্রধানমন্ত্রী যিনি ভারতীয় ভূখন্ডের অসমে পাকিস্তানী হামলার ওপর বিবৃতি দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, অসম সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আমাদের অঞ্চলের পবিত্রতা রক্ষা করতে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছিলেন যাতে আমাদের এলাকা থেকে পাকিস্তানী আর্মি দূর হয়। নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকা বলেছেন, গণহত্যার প্রথম ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হানাদাররা ৩ লাখ বাঙালীকে হত্যা করেছে। এর দ্বারা পশ্চিম পাকিস্তানীদের ধ্বংস করার ক্ষমতা বোঝা যায়। আধুনিক অস্ত্র যেমন এদের রয়েছে তেমনি মনের দিক থেকে তারা সম্পূর্ণরূপে বাঙালীবিরোধী। তাদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে, বাঙালীরা ছোট জাত, তারা শাসিত হতেই জন্মেছে, তাদের বিশ্বাস করা যায় না। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×