ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘আবারও বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করতে চাই’

প্রকাশিত: ১০:০৮, ২৫ মে ২০১৯

 ‘আবারও বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করতে চাই’

রুমেল খান ॥ হ্যান্ডবল একটি প্রাচীন খেলা। গ্রিক কবি হোমারের ওডিসি মহাকাব্যে এই খেলার উল্লেখ আছে। খ্রিস্টপূর্ব যুগে নীল নদের উপত্যকা-ভূমিতে বল নিয়ে যেসব খেলা প্রচলিত ছিল, তার সবকটিই ছিল হাতের খেলা। তবে খেলার ধরন-পদ্ধতির দিক দিয়ে আজকের হ্যান্ডবল সম্পূর্ণ নতুন একটি সংযোজন। পাঠক নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন আজকের লেখার বিষয়বস্তু হচ্ছে হ্যান্ডবল। তবে এই খেলাটির সঙ্গে ফুটবল এবং মালদ্বীপের একটি যোগসূত্র আছে। সেটা কেমন? বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ফুটবলার হিসেবে বিদেশের লীগে খেলেন সাবিনা খাতুন, ২০১৫ সালে, মালদ্বীপে গিয়ে। তেমনি বাংলাদেশের প্রথম হ্যান্ডবলার হিসেবে বিদেশের লীগে খেলেন সুমি বেগম, ২০১৭ সালে। মজার ব্যাপার- সুমিও সেই লীগ খেলেন মালদ্বীপে গিয়েই! সিক্স মিটার পজিশনের খেলা সুমি সেবার খেলেছিলেন মালদ্বীপের ড. আব্দুল সামাদ মেমোরিয়াল হসপিটাল হ্যান্ডবল দলের হয়ে, হাভারু উইমেন্স হ্যান্ডবল টুর্নামেন্টে। সুমির মালদ্বীপে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন কোচ আমজাদ হোসেনের বদৌলতে। বাংলাদেশের এই অভিজ্ঞ কোচ তখন মালদ্বীপ জাতীয় হ্যান্ডবল দলের দায়িত্বে ছিলেন। সেবার মালদ্বীপ যাওয়া-আসার বিমান ভাড়া, থাকা-খাওয়া, স্থানীয় অন্যান্য খরচ বহন ছাড়াও দলটি সুমিকে ৫০০ মার্কিন ডলার দিয়েছিল। দু’বছর পর এবার আবারও মালদ্বীপের ‘হাবারু ওমেন্স হ্যান্ডবল টুর্নামেন্ট’-এ খেলার ডাক পেয়েছেন (শুরু হবে আগামী ৪ জুন থেকে) পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার মেয়ে সুমি। ১৯৯৩ সালের ১৪ অক্টোবর পৃথিবীতে আসা এই হ্যান্ডবল কন্যা এবার খেলবেন মালদ্বীপের থিনাদো দ্বীপের লাম্বাদা ক্লাবের হয়ে। আগের বার খেলতে যাওয়ার সুবাদে সেখানকার খেলোয়াড় ও ক্লাবগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। প্রায় মাসখানেক আগে ক্লাবটি আমজাদ হোসেনের মাধ্যমে নক করে সুমিকে। ব্যাটে-বলে মিলে যাওয়ায় রাজি হয়ে যান তিনি। তবে তারা পারিশ্রমিক কত দিচ্ছে, সেটা এখনও পরিষ্কারভাবে জানেন না। তবে ক্লাব নাকি আশ্বাস দিয়েছে ভাল পারিশ্রমিকই দেয়া হবে। দলটির ফুটবল ক্লাবও আছে। তবে হ্যান্ডবলে এবারই প্রথম খেলবে তারা। এ উদ্দেশে তুলা রাশির জাতক সুমি ঢাকা ছাড়বেন আগামী ৩০ মে, ১ বা ২ জুন ... যেকোন একটি তারিখে। ২০১৭ সালে খেলতে গিয়েই দলীয়ভাবে অপরাজিত শিরোপার স্বাদ পেয়েছিলেন সুমি। সেবার ৮ দল খেলেছিল লীগ পদ্ধতিতে। চূড়ান্ত খেলায় সুমির দল এমআরডিসি ক্লাবকে হারিয়েছিল ২১-৮ গোলে। সে আসরে ১৬-১৭টির মতো গোল করেছিলেন সুমি। ওই আসরে প্রতিটি দলে দুজন বিদেশী খেলানোর নিয়ম থাকলেও সুমিই ছিলেন তার দলের একমাত্র বিদেশী খেলোয়াড়। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে অভিষিক্ত হয়েই স্মরণীয় শিরোপা অর্জন। কেমন লেগেছিল? জনকণ্ঠকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে সুমি বলেন, ‘খুবই গর্ব বোধ করেছিলাম। সবাই বাংলাদেশের নামটা জেনেছিল এবং বাংলাদেশের হ্যান্ডবল সম্পর্কে ধারণা দিতে পেরেছিলাম।’ এবারের মালদ্বীপে খেলতে যাওয়া প্রসঙ্গে তার বিজেএমসি ও জাতীয় দলের সতীর্থদের প্রতিক্রিয়া কি? ‘তারা সবাই খুবই খুশি। সবাই শুভকামনা জানিয়েছে। ফেডারেশনও জানে। তারাও আনন্দিত। জনকণ্ঠের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই যেন দেশের মানসম্মান রক্ষা করতে পারি।’ মালদ্বীপের মহিলা হ্যান্ডবলের সঙ্গে বাংলাদেশের মহিলা হ্যান্ডবলের কোন পার্থক্য? ‘আমাদের হ্যান্ডবলের মান অনেক শক্তিশালী। তবে মালদ্বীপেরটা আগে অনেক দুর্বল হলেও এখন তারা অনেক এগিয়ে গেছে। ওরা এখন বিচ হ্যান্ডবলও খেলছে। ওই দেশের প্রতি খেলোয়াড়ই বিভিন্ন সংস্থায় চাকরি করে। আমাদের দেশে সংখ্যাটা খুবই কম। তাছাড়া মালদ্বীপের সরকার হ্যান্ডবলকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে। এটাই সবচেয়ে বড় পার্থক্য।’ সুমির অভিমত। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় হ্যান্ডবল খেলা শুরু করেন সুমি। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় (নবম শ্রেণীতে, ২০০৮ সালে) এবং সন্তান হওয়ায় (এক ছেলে : সামির আহমেদ স্বপ্নীল, বয়স ৬) কয়েক বছর পড়াশোনায় ছেদ পড়ায় এখন পড়ছেন উচ্চ মাধ্যমিকের শেষ বর্ষে। শুরুতে পরিবারের বাধা পেয়েছিলেন খেলতে। তবে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী সুমন আলীর ঠিকই উৎসাহ পেয়েছেন। ২০১২ সাল থেকে বিজেএমসির হয়ে খেলছেন সুমি (এখন কর্মরত চট্টগ্রাম জোনে)। তার আগে খেলেছেন আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, আরএম স্পোর্টিং এবং মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। এছাড়া জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে বিভিন্ন সময় খেলেছেন পঞ্চগড়, ফরিদপুর, নড়াইল ও ঢাকা জেলা দলের হয়ে। বছরখানেক ধরে ঢাকার সানিডেল স্কুলে ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। মালদ্বীপ খেলতে যাওয়ার জন্য স্কুল থেকে ছুটি চেয়ে ইতোমধ্যেই তা পেয়েও গিয়েছেন বলে জানান সুমি। ২০১১ সাল থেকে জাতীয় দলে খেলা সুমি এ পর্যন্ত খেলতে গিয়েছেন পাকিস্তান, নেপাল, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও ভারতে। সুমির ভবিষ্যত লক্ষ্য হচ্ছে এসএ গেমসের হ্যান্ডবলে বাংলাদেশের হয়ে স্বর্ণপদক জেতা। ২০১২ সালে খেলতে গিয়ে এ্যাঙ্কেলের টিস্যু ছিঁড়ে যাওয়াটাকেই এখন পর্যন্ত ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ইনজুরি বলে মনে করেন। সুমির অন্য প্রিয় খেলা হচ্ছে দীর্ঘ লাফ। শুনে অবাক হবেন এ খেলায় তার পদকও আছে! ২০০৮ সালে গ্রীষ্মকালীন আন্তঃস্কুল ক্রীড়ায় রীতিমতো রেকর্ড গড়ে সোনা জেতেন। ২০০৯ সালে জাতীয় আন্তঃস্কুল ক্রীড়ায় বর্শা নিক্ষেপে জেতেন স্বর্ণপদক। বিজেএমসির হয়ে ২০১৪ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে উশুতে জিতেছেন তা¤্রপদক। এছাড়া পঞ্চগড়ের কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের হয়ে আন্তঃস্কুল ভলিবল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন ২০০৬ সালে। একই স্কুলের হয়ে আন্তঃস্কুল হ্যান্ডবলে হ্যাটট্রিকসহ টানা ৫ বার শিরোপা জেতেন (২০০৬-২০১০)। খেলেছেন বিচ রাগবি, বেসবলও। ২০১৩ সালে প্রিমিয়ার লীগ ফুটবলেও খেলেছেন ফরাশগঞ্জের হয়ে! পাঠক নিশ্চয়ই প্রশ্ন করতে পারেন- অলরাউন্ডার সুমির আর কোন্ খেলা খেলতে বাকি আছে? স্কুলের আবুল হোসেন মন্ডল স্যারের উৎসাহে-কোচিংয়েই হ্যান্ডবল ভুবনে পা রাখা সুমির। এছাড়া এলাকার আনসার ও বিজিবির সাবেক অবসরপ্রাপ্ত অফিসার আবুল কালাম আজাদও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সুমির জন্য। বিয়ের পর ও সন্তান হলে খেলা ছেড়ে দিয়েছিলেন সুমি। তখন তাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে আবার খেলায় ফিরিয়ে আনেন যিনি, সেই বিজেএমসির সিনিয়র খেলোয়াড় রোজিনা খাতুনের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন সুমি। সুমির আদর্শ হ্যান্ডবলার অনেকেই- পুরুষদের মধ্যে আমজাদ হোসেন, আরিফ, সুদান বড়ুয়া; মহিলাদের মধ্যে শাহনাজ পারভীন মালেকা (বর্তমানে জাতীয় ও তারকা কাবাডি খেলোয়াড়), ডালিয়া আক্তার, শিলা রায় এবং খালেদা সুলতানা। তার অন্য প্রিয় খেলা হকি। প্রথমবার মালদ্বীপে গিয়ে যেভাবে শিরোপা জিতে সফল হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন, এবার দ্বিতীয়বারও কি সেখানে গিয়ে সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারবেন হ্যান্ডবল কন্যা সুমি?
×