ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মাহে রমজান

প্রকাশিত: ০৯:৫৯, ২৫ মে ২০১৯

 মাহে রমজান

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ মাহে রমজানের আজ ১৯তম দিবস। এ সময় আমরা আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর পরিবারের একটি ঘটনা নিয়ে উদ্বুদ্ধ হব। বিষয়টি হলো অতীব গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞাতব্য মহানবী পিতার অলৌকিক জীবন প্রাপ্তি এবং পরিশেষে আখেরি নবীর আবির্ভাব। আঁ- হযরতের পিতার সংক্ষিপ্ত নাম হযরত আবদুল্লাহ। মহানবীকে বাল্যজীবনে অভাবনীয় অভিভাবকত্ব দানকারী আবু তালিব ছিলেন আবদুল্লাহর সহোদর। আবদুল্লাহ ছিলেন পিতা আবদুল মুত্তালিবের শেষ সন্তান। তারা ছিলেন ১০ বা ১২ ভাই। ভ্রাতাদের মধ্যে আবু জুবাইর, আবু তালিব, আবু লাহাব, হামযা ও আব্বাস (র.) বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। শেষোক্ত দুইজন ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ইতিহাসে অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। আবদুল্লাহ সম্ভবত ৫৫৪ খ্রী. নাওশীরওয়ানের রাজত্বের ২৪তম বর্ষে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার জীবনের স্মরণীয় ঘটনাবলীর মধ্যে কুরবানীর ঘটনাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বলা হয়, তার পিতা আবদুল মুত্তালিব মানত করেছিলেন যে, তার ১০টি পুত্র যৌবনে উপনীত হলে একটিকে আল্লাহর নামে কুরবানী করবেন। ঘটনার মূলে ছিল এই- আবদুল মুত্তালিব ছিলেন একজন ধার্মিক লোক। মক্কার কা’বা গৃহে প্রতি বছর বিভিন্ন স্থান হতে তীর্থ যাত্রীরা তীর্থ করতে আসত। আবদুল মুত্তালিবের ওপর ঐসব মেহমানদের পানি সরবরাহের ভার ছিল। প্রতিনিয়ত ছিল সুপেয় পানির অভাব। তাই তিনি এক পর্যায়ে বহু বছর আগের ইব্রাহিম (আ.) আমলের ‘জমজম’ কূপটি পুনঃআবিষ্কার করতে চেষ্টা করলেন। এটি তখন মাটি চাপা পড়েছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। বরং তার এটাকে অনেকে উদ্ভট চিন্তা মনে করে তাকে পরিহাস করতে লাগলো। পক্ষান্তরে তার বয়সও এখন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ কোন সন্তান সন্ততি লাভ করছেন না। এ জন্যই তিনি একদিন কঠোর প্রতিজ্ঞা করলেনঃ যদি আমার দশটি পুত্র জন্মে আর সকলের মেহেনত ও ভাগ্যে যদি আবিষ্কার করতে পারি ‘জমজম’কূপ তবে একটি পুত্রকে হযরত ইব্রাহিমের ন্যায় আমিও কুরবানী দেব।’ আশ্চর্যের বিষয়, একে একে ১০টি পুত্র সন্তানও লাভ করলেন এবং কালক্রমে তিনি জমজম উৎসের আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। তখন আবদুল মুত্তালিব পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো একটি পুত্রকে কুরবানী দিতে মনস্থ করলেন। পুত্রদের মধ্যে কাকে কুরবানী দিবেন তার ভাগ্য পরীক্ষা (লটারি) করানো হলো। ফলে সর্বকনিষ্ঠ পুত্র আবদুল্লাহর নাম উঠলো। আবদুল মুত্তালিব আবদুল্লাহকে সর্বাপেক্ষা বেশি ভালবাসতেন তবুও কর্তব্যের খাতিরে তাকেই কুরবানী দেয়ার জন্য কা’বা গৃহে নিয়ে যান। উল্লেখ্য, এই প্রেক্ষিতেই হযরত মুহাম্মদ (স.)-কে ‘ইবনুয যাবিহাঈন’ (কুরবানীকৃত ব্যক্তিদ্বয়ের পুত্র বলা হয়ে থাকে। একজন পিতা হলেন তার বংশধারার উর্ধতন পুরুষ হযরত ইবরাহীমের হাতে কুরবানীর আনুষ্ঠানিকতায় উত্তীর্ণ ইসমাঈল (আ.) আর অপরজন এই নিজ পিতা আবদুল্লাহ। আবদুল্লাহকে কুরবানী দানের সময় লোকেরা তাকে যারপরনাই এই কাজ করতে নিষেধ করলো। সবচেয়ে তাকে বেশি বাধার সৃষ্টি করল আবদুল্লাহর বোনদের কান্নাকাটি। অগত্যা আরো বুঝার জন্য তিনি একজন ভবিষ্যৎ বক্তার নিকট যান। কোন কোন বর্ণনায় আছে, বোনেরাই তাকে শেষবারের মতো অন্তত একবার কোন গণকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন। আবদুল মুত্তালিব তাই করলেন। গনক নির্দেশ দিলেনঃ আবদুল্লাহর বিনিময়ে ১০টা উট নির্ধারণ করে উট ও আবদুল্লাহর মধ্যে ভাগ্য নির্ণয় কর। যতক্ষণ না উটের নাম উঠবে বা উট কুরবানী দানের পাল্লাটি ভারী না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যেকবার উটের সংখ্যা ১০টি করে বাড়িয়ে দিও। এরূপে যখনই উটের নাম প্রাধান্য পাবে, তখন নির্দিষ্ট সংখ্যক উট কুরবানী করবে।’ ঠিক তাই করা হলো। ১০ বারে উটের নাম উঠলো। কাজেই উটের সংখ্যা দাঁড়ালো ১০০। তখন আবদুল মুত্তালিব সন্তুষ্টচিত্তে একশটি উট কুরবানী করলেন। সে দিন হতে কারো প্রাণের বিনিময়ে একশ’ উট কুরবানী করার প্রথা আরবে প্রচলিত হয়ে গেল। এরূপে আবদুল্লাহ নিশ্চিত মৃত্যুর হাত হতে রক্ষা পেলেন। পরবর্তীকালে যিনি বিশ্ব নবীর পিতা হওয়ার গৌরব অজর্ন করবেন, তার জীবন এরূপভাবে হেলায় নষ্ট হলে চলবে কেন? অনন্ত করুণা ও কল্যাণের উৎসমুখ কি এত সহজেই রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে? তাই কঠিন পরীক্ষায় আল্লাহ বাঁচিয়ে দিলেন আবদুল্লাহকে। (বিশ্বনবী-৪১)। কালক্রমে বিশিষ্ট মহিলা আমিনা বিনতে ওয়াহাবের সঙ্গে আবদুল্লাহর বিবাহ হয়। আবদুল্লাহ্ ছিলেন সুন্দর দীপ্তি ও কান্তিময় সুপুরুষ। তাঁর চেহেরায় এক অভাবনীয় আলোকচ্ছটা সদা ঝলমল করিত। তাই বংশের প্রতিটি লোকের নিকট তিনি প্রাণাধিক প্রিয় ছিলেন। তার প্রতি মায়া ও স্নেহ ছিল দেশের প্রতিটি মানুষের মনে। কেউ বলেন- রাসুলুল্লাহর (সাঃ) নুর বংশ পরম্পরায় তার কপালে এসেছিল। বিবাহের সময় আবদুল্লাহর বয়স ছিল সতের বছর। মক্কার অভিজাত পরিবারের ঐতিহ্য অনুযায়ী কিছুকাল তিনি শ্যাম বা সিরিয়া দেশে ব্যবসা উপলক্ষে যান। ফেরার পথে তিনি মদিনায় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং যাত্রা বিরতি করেন। নাজ্জার গোত্রের লোকেরা তার সেবা শুশ্র‍ুষায় এগিয়ে আসে। কাফেলার লোকদের কাছে পিতা এ দুঃসংবাদ পেলে তিনি বড় ছেলে হারিসকে মদিনা পাঠালেন। কিন্তু তিনি সেখানে পৌঁছে প্রাণের ভাইকে জীবিত পেলেন না। এক মাস রোগ ভোগ করে-যুরকানীর বিবরণ (পৃঃ-১০৯) অনুযায়ী ১ রমজান (অক্টোবর ৫৭০) এবং কুরআনে বর্ণিত আবাবিল কর্তৃক হস্তীবাহিনী ধ্বংসের ঘটনার ৪ মাস ১৭ দিন পূর্বে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল প্রায় ১৮ বছর। (মতান্তরে ২৫, ২৮ ও ৩০ বছর)। তার একমাত্র সন্তান মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সাঃ) তার মৃত্যুর ৬ মাস পর (রবিউল আউয়াল, ফীল বৎসর) জন্মগ্রহণ করেন। আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলা আলে মুহাম্মদ...।
×