ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

জীবন দিয়ে প্রতিশোধ ॥ ২৫ মে, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ২৫ মে ২০১৯

 জীবন দিয়ে প্রতিশোধ ॥ ২৫ মে, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ২৫ মে দিনটি ছিল মঙ্গলবার। এই দিন মুক্তিবাহিনীর একটি দল বাটপাড়া জোরকাননের কাছে পাকবাহিনীর সৈন্যবাহী একটি ট্রাক ও একটি আর আর রাইফেল-এর জীপ এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে পাকবাহিনীর ২০জন সৈন্যসহ ট্রাক ও জীপ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়। মুক্তিবাহিনীর ছোট একটি দল শালদা নদীর পাক অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের এ অভিযানে পাকবাহিনীর একজন জেসিও এবং পাঁচজন সৈন্য নিহত হয়। দুপুর দু’টায় মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী ক্যাপ্টেন নওয়াজেশকে সঙ্গে নিয়ে সাহেবগঞ্জ থেকে সোজা জয়মনিরহাট ডাকবাংলোতে আসেন। সেখানে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ, সুবেদার আরব আলী ও অন্যদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা বলে তিনি আবার সাহেবগঞ্জ হয়ে ফিরে যান কুচবিহারে। ওইদিনই পাকসেনারা ধরলা নদী পার হয়ে কুড়িগ্রামের মুক্ত এলাকা নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারীর দখল নেয়ার জন্য রাত থেকে প্রচন্ড আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানী বাহিনী অতর্কিতভাবে বেপরোয়া গোলাগুলির মধ্য দিয়ে ভারতের ঢালু নামক স্থানে প্রবেশ করে নিরীহ শরণার্থীদের অকাতরে হত্যা করে। এখানে উল্লেখ্য যে, বিএসএফ সুবেদার ত্রিপাল সিং সহ ৯ জন সদস্যকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যরা গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পাকবাহিনী সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় অবস্থানরত মুক্তিযাদ্ধাদের ওপর হামলা চালায়। এদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত এমএলএ রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে বিবৃতি প্রদান করেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং পার্লামেন্টে বলেন, প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আসার ফলে উদ্বাস্তু সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে। পূর্ববঙ্গে নিরাপত্তার পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পাকিস্তান যদি রাজি না হয় তাহলে ভারত উদ্বাস্তু ও নিজ দেশের অর্থনীতির স্বার্থে বিবেচনা অনুযায়ী যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এদিন সামরিক কর্তৃপক্ষ ২১ নং সামরিক অধ্যাদেশ জারি করে। এর মাধ্যমে বাতিল করা হয় মিউনিসিপ্যাল কমিটি। এদিন স্বাধীনতাবিরোধী আব্দুল মান্নানকে সভাপতি করে ভৈরবে ২৭ সদস্যবিশিষ্ট ভৈরব শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এই দিন পিটিআই-এর বরাতে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় ‘জীবন দিয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওরা পশ্চিম বাংলাদেশের রংপুর শহরের পাঁচজন ছাত্র। তারা দেখেছেন, পাকসৈন্যরা তাদের মা-বাবাকে হত্যা এবং নারীদের শ্লীলতাহানি করছে। তারা সংকল্প করলেন, যেভাবেই হোক এই নারকীয় হত্যার প্রতিশোধ তারা নেবেন। তারা মরণপণ করে একটি কমা-ো দল গঠন করলেন। শত্রু খতম করাই হলো তাদের লক্ষ্য। এদিন ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের জনৈক বিশেষ প্রতিনিধির সঙ্গে প্রদত্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামের সাক্ষাতকারে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্তা স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে নিহিত রয়েছে বাংলাদেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসার নিশ্চয়তা। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে, জাতিসংঘ বাংলাদেশ থেকে পাক সৈন্য সরিয়ে নিতে পাকিস্তান সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে। ভারতে আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশ শরণার্থীদের সাহায্য দানের জন্য বিশ্ব সরকারসমূহের প্রতি জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল যে আবেদন জানিয়েছেন সে সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বিশাল সংখ্যক নির্যাতিত ও নিগৃহীত মানুষ যে পাক-দস্যুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে গিয়েছে উ থান্টের আবেদনে তার স্বীকৃতি রয়েছে। এদিন মুক্তিবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় সদর দফতর থেকে পাওয়া এক খবরে জানা গেছে যে, প্রচন্ড সংঘর্ষের পর মুক্তিফৌজ গানবোটযোগে টহলরত গানবোটের আরোহী পাকিস্তানী সেনাদের পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করে তাদের একখানা গানবোট দখল করে নিয়েছে। মুক্তিবাহিনীর জোয়ানরা বরিশালে একটি থানা আক্রমণ করেন এবং বাঙালীর দুশমন কয়েকজন স্থানীয় দোসরকেও হত্যা করেন। রংপুর সেক্টরে পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি দল ধরলা অতিক্রমের চেষ্টা করলে মুক্তিফৌজ তাদের বাধা দেন। সংঘর্ষকালে বেশ কয়েকজন খানসেনা নদীতে ডুবে মারা যায়। রাজশাহীর কাছে একটি কালভার্টে মুক্তিফৌজের স্থাপিত মাইন বিস্ফোরিত হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি জীপ ধ্বংস হয়েছে। জীপের আরোহীরা গুরুতর আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। সিলেট সেক্টরে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি কনভয়ের ওপর চোরা-গোপ্তা আক্রমণ চালান। এতে শত্রুপক্ষের ৭টি যানবাহন ধ্বংস হয়। বিয়ানীবাজার এবং বরলেখায় মুক্তিফৌজ খানসেনাদের ১৭ জন স্থানীয় দালালকে হত্যা করেছেন বলে সংবাদ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি কুমিল্লার কসবা অঞ্চলে বাংলাদেশ মুক্তিফৌজ একটি পাক-হানাদার বাহিনীর ওপর হামলা চালান এবং তাদের হটিয়ে দেন। এই অঞ্চলে মোন্দেভাগ নামক এক জায়গায় পাক-হানাদারদের একটি ট্রলি বোঝাই অস্ত্র আর খাদ্যদ্রব্য যাচ্ছিল। মুক্তিফৌজ সেটি আক্রমণ করে পুড়িয়ে দিয়েছেন। বল্লবপুরে পাক-ঘাঁটির ওপর হঠাৎ আক্রমণ করে মুক্তিফৌজ দু’জন প্রহরীকে হত্যা করেছেন। কাঁঠালবাড়িয়াতে মুক্তিফৌজের হামলায় পাক-বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ও কয়েকজন পাক-হানাদার খতম হয়েছে। ময়মনসিংহ এলাকার শ্রীবর্দীতে মুক্তিফৌজ একটি পাকা সেতু উড়িয়ে দিয়েছেন। সিলেট সেক্টরে দুটি পাক-ঘাঁটি মুক্তিফৌজ জ্বালিয়ে দিয়েছেন। এই ঘাঁটি দুটির নাম জামকান্দি ও লালাপুঞ্জি। কুমিল্লায় বিবিরবাজারে মুক্তিফৌজ মাইন ফেলে পাক-হানাদারদের একটি ট্রাক বিধ্বস্ত করেন। হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি। হিলি আর পাঁচবিবির মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা আমাদের মুক্তিফৌজ বিপর্যস্ত করে দিয়েছেন। পাকিস্তান বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ এবং বিশ্ব বৌদ্ধ ফেলোশিপের পাকিস্তান আঞ্চলিক শাখার সভাপতি মিঃ জ্যোতিপাল মহাথেরো জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্টের কাছে বাংলাদেশে পাক সৈন্য কর্তৃক বৌদ্ধ নিধনযজ্ঞের সংবাদ জানিয়ে একটা তারবার্তা পাঠিয়েছেন। তার বার্তায় তিনি জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলকে জানিয়েছেন , বাংলাদেশে পাক সৈন্যরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করছে। এই হত্যাকান্ড থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও বাদ যাচ্ছে না। মহাথেরো জানিয়েছেন, বৌদ্ধদের গ্রামগুলো একের পর এক জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, মন্দিরগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×