ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চিকিৎসক ধার করে চলছে চিকিৎসা

যশোর জেনারেল হাসপাতালের সিসিইউ বেহাল

প্রকাশিত: ০৮:৩৭, ২৫ মে ২০১৯

 যশোর জেনারেল হাসপাতালের সিসিইউ বেহাল

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ নানা সঙ্কটে যশোর জেনারেল হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নিজেই যেন লাইফ সাপোর্টে রয়েছে। নেই নিজস্ব চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারী। এক প্রকার ধার করে চলছে। সেই সঙ্গে চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব দীর্ঘদিনের। চিকিৎসার পরিবেশ নেই ইউনিটিতে। তেলাপোকা উপদ্রবে অতিষ্ট রোগী ও তার স্বজনরা। গরমে নাভিশ্বাস তো আছেই। এক প্রকার জোড়াতালি দিয়েই চলছে সিসিইউ। হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিটের যাত্রা শুরু হয়। ২০০৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করা হয়। ২৮ শয্যার করোনারিতে নারী ৫টি, পুরুষ ১৫টি, মুক্তিযোদ্ধা ২টি ও সিসিইউ ৬টি শয্যা রয়েছে। এজন্য দুইজন সিনিয়র কনসালট্যান্ট, চারজন জুনিয়র কনসালট্যান্ট, আটজন জরুরী চিকিৎসা কর্মকর্তা থাকার কথা। কিন্তু সেখানে করোনারি কেয়ার ইউনিটের নিজস্ব কোনো জনবল নেই। বিকল্প ব্যবস্থায় যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য জনবল দিয়ে করোনারি কেয়ার ইউনিট চালু রাখা হয়েছে। বর্তমানে কর্মরত আছেন যশোর মেডিক্যালের দুজন সহযোগী অধ্যাপক, একজন সহকারী অধ্যাপক, ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের দুজন জুনিয়র কনসালট্যান্ট ও পাঁচজন চিকিৎসা কর্মকর্তা। তারা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। করোনারি কেয়ার ইউনিটে প্রতিদিন একশ’ রোগী চিকিৎসা নেন। এরমধ্যে ভর্তিই থাকেন ৭০-৮০ জন। শুধু যশোর নয়, এ অঞ্চলের ছয়টি জেলার রোগীদের ভরসাস্থল এটি। করোনারি কেয়ার ইউনিটের পূর্বশর্ত শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) নষ্ট হয়ে আছে। চিকিৎসা সরঞ্জামের মধ্যে শুধু মাত্র দুটি ইসিজি মেশিন ও অক্সিজেন ছাড়া কিছু নেই। ইটিটি মেশিন, কার্ডিয়াক যন্ত্র, এনজিওগ্রাম মেশিনের মত অতিগুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন নষ্ট ও সরবরাহ না থাকায় রোগীদের বেসরকারী ক্লিনিকে ঝুঁকতে হচ্ছে। বাইরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে চড়া মাশুল দিতে হচ্ছে রোগীদের। করোনারীতে ৮০ টাকায় ইসিজি করা সম্ভব। সেই পরীক্ষা বাইরে ক্লিনিকে ১২০-২৫০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। ইটিটি পরীক্ষা ফি হাসপাতালে ২৫০-৭০০ টাকা পর্যন্ত। বাইরে ক্লিনিকে গুনতে হয় ১৫শ’ থেকে ১৮শ’ টাকা পর্যন্ত। ইকো কার্ডিয়াক পরীক্ষা হাসপাতালে ফি ১২শ’ থেকে ১৫শ’ টাকা। বাইরে ক্লিনিকে সেই ফি ১৭শ’ থেকে ২২শ’ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। হাসপাতালে নেই কোন প্যাথলজি সুযোগ সুবিধা। অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষাও বাড়তি টাকা গুনতে হয় রোগীকে। ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উজেলার অহিদুল ইসলাম (৫০) ভর্তি হয়েছেন দুদিন আগে। তিনি বেড পেয়েছেন। কিন্তু মাথার ওপর কোন ফ্যান নেই। তাই বিকল্প টেবিল ফ্যানই তার ভরসা। বেড পেতে তাকে তদ্বিরও করতে হয়েছে, জানালেন সঙ্গে থাকা মেয়ে রিনা খাতুন। তিনি বললেন, দেখে বোঝার উপায় নেই, এটি করোনারি কেয়ার ইউনিট। গাদাগাদি করে আছে সবাই। দিনের পর দিন নানা সঙ্কটে থাকায় করোনারি ইউনিট নিজেই ‘লাইফ সাপোর্টে’ চলে গেছে! তিনি আরও বলেন, চারটি টেস্টের সব ক’টি বাইরে ক্লিনিকে করেছি। খরচও একটু বেশি পড়েছে। পাশের বেডে ভর্তি যশোর শহরের মিশনপাড়া এলাকার রফিকুল ইসলাম (৫০)। তার হার্টে চারটি রিং পরানো। সঙ্গে থাকা তার স্ত্রী শাকিলা বেগম বলছিলেন, ক্রিটিক্যাল রোগীর জন্য নেই কোন এসির ব্যবস্থা। গরমে সবাই হাঁসফাঁস করছে। মাথার ওপর ফ্যানও ঘোরে না। বাড়ি থেকে টেবিল ফ্যান এনে চালাচ্ছি। এভাবে রোগী রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। এভাবেই চলছে সেবা। তিনি আরও বলেন, এখানকার পরিবেশ মোটেও উপযোগী নয়। বাথরুম, বেসিন, বেড অপরিষ্কার থাকলেও দেখার কেউ নেই। এই অবস্থার উন্নতি দরকার। একমাত্র করোনারি কেয়ারের এই হাল আমরা দেখতে চাই না। যশোর শহরের আরএন রোড এলাকার শাহিদা বেগম বলেন, স্বামীকে ভর্তি করেছি। নোংরা পরিবেশ। তেলাপোকা ও পোকামাকড়ের উপদ্রব, বাথরুম ও বেসিন নোংরা। পরিষ্কার করার যেন কেউ নেই। দায়িত্বরত একাধিক নার্স জানালেন, প্রতিদিন ৭০-৮০ জন রোগী ভর্তি থাকে। বাধ্য হয়েই তাদের মেঝে কিংবা বারান্দায় রাখতে হয়। সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। রোগীর চাপ বেশি থাকায় অনেক কিছুর ব্যত্যয় ঘটে। জানতে চাইলে যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (চলতি দায়িত্ব) ডাঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, আজ অবধি জনবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের জনবল দিয়ে করোনারি ইউনিট চালু রাখা হয়েছে। ২৮ বেডের বিপরীতে প্রতিদিন ৭০-৮০জন রোগী ভর্তি থাকে। যন্ত্রপাতি বলতে দুটি ইসিজি মেশিন ছাড়া আর কিছু নেই। তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর করোনারি ইউনিটের জন্য ৭৯ পদ সৃষ্টির তালিকা পাঠিয়েছিলাম মন্ত্রণালয়ে। এরমধ্যে ৪৬টি পদ সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু সেটি আজও সৃজন হয়নি। জনবল ও যন্ত্রপাতি সঙ্কট ঠিকমেতা সেবা দিতে পারছি না। সঙ্কটের বিষয়টি জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি।
×