ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মনিরুল ইসলাম মনি

পাতালপুরী

প্রকাশিত: ১১:৪৯, ২৪ মে ২০১৯

 পাতালপুরী

সাড়ে ছয়শ’ বছর ধরে কুষ্টিয়ার খোকসার গড়াই নদী পাড়ে হয়ে আসছে পাঁঠা বলি ও কালীপূজা। নটমন্দির প্রাঙ্গণে মেলাও হয়। প্রকান্ড একটি বটগাছকে ঘিরেই কালী প্রতিমা তোলা হয়। দেশ-বিদেশ থেকে হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা এ পূজায় আসনে পূর্ণ লাভের আশায়। কালীমন্দির নিয়ে অনেক রূপকথা প্রচলিত আছে। শুরুর দিকে মন্দিরটি ছোট আকৃতির থাকলেও চারদিকে অনেক জায়গা ছিল। তৎকালীন জমিদার বাবু এ জমিদান করেছিলেন। শুধু তাই-ই নয়- এখানে ঠাকুরের থাকার জায়গা, ধোপার থাকার জায়গাসহ মন্দিরের সেবায়েতদের জন্যও থাকার ব্যবস্থা ছিল। কালের পরিক্রমায় মন্দিরের প্রসার বাড়ানো হয়। মাঘ মাসের আমাবশ্যা তিথির আগেই এ এলাকার সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই অন্যরকম উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। আগে অবশ্য এমন ছিল না। অন্য ধর্মের মানুষদের প্রবেশে অনেক বিধি-নিষেধ ছিল। যুগ পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রীতিটাও অনেক মজবুত হয়েছে। এখন এ পূজা দেখলে বোঝার উপায় নেই যে- এটি হিন্দুদের না অন্য ধর্মের উৎসব। দৃষ্টিনন্দন মন্দিরের কারুকাজকে করেছে তার নাম-ঠিকানা কারো জানা নেই। যাদের জানা আছে তারা বেঁচেও নেই। নড়াইলের এক জমিদার নাকি কলকাতা থেকে এক শিল্পীকে আনিয়ে এই কারুকার্য করেছিলেন। কিন্তু সেই কথারও ভিত্তি নেই। থাকলেও সেটি এই মন্দির নয়। কারণ নড়াইলের জমিদারের মাধ্যমেই প্রথম যে মন্দিরের গোড়াপত্তন সেটি অনেক আগেই গড়াই-তে বিলীন হয়ে গেছে। তবু যে শিল্পীই এটি করে থাকুন না কেন তার কর্মের প্রশংসা করতেই হবে। অবশ্য কারুকাজে স্থানীয় শিল্পীদেরও ভালো অবদান আছে। মন্দিরে একদম উপরে দেবতা শিবকে তার শিষ্য গোখরা সাপ আড়াল করে রেখেছে। তাকে অভয় দিচ্ছে যেন শিষ্য। পাশেই আছে দুটি তালগাছ। আমাবশ্যা এলেই ভৌতিক এক পরিবেশ সৃষ্টি হয় এখানে। আর কালীপূজাও করা হয় আমাবশ্যা তিথিতেই। ভক্তদের সঙ্গে সাধুদের মিলনমেলাও বসে মেলাটিকে ঘিরে। পাশের গ্রামেই থাকে অপূর্ব। ও এবার ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠবে। বাইরের পরিবেশের সঙ্গে ও অতটা অভ্যস্ত না। অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষা দিয়েই ওর বাবা-মায়ের কাছে আবদার করে রেখেছে এবার ও ভরা পূজা দেখতে যাবে। বাড়ির পাশে পূজা হলেও কখনো অপূর্ব আসেনি। বাবা-মায়ের অনুমতি পাওয়ায় অপূর্বরা ৫ বন্ধু এবার মেলায় আসবে পূজা দেখতে। ওদের মধ্যে আবার ৩ জন আগেই কয়েকবার মেলায় গিয়েছিল। কিন্তু কেউ-ই ভরা পূজায় যায়নি এ পর্যন্ত। এবার ওদের মনে অন্যরকম আনন্দ কাজ করছে। কদিন পরেই শুরু হবে পুজো। পুজো উপলক্ষে মন্দিরের সামনের মাঠটিতে বসে বিশাল গ্রামীণ মেলা। আসে দি লায়ন সার্কাস, পুতুল নাচ, মোটরসাইকেল রেস, ম্যাজিকসহ নানা রকম খেলা। মেলা চলে একটানা একুশ দিন। এ বছরের মেলা আস্তে আস্তে বসতে শুরু করেছে। পূজার জন্যও তৈরি হয়ে গেছে সাড়ে ১২ হাত দীর্ঘদেহী কদম কাঠের কালী প্রতিমা। এক হাতে অস্ত্র আর অন্য হাতে শত্রুর মাথা আর পায়ের নিচে তার প্রাণপ্রিয় স্বামী। তার ভুল হয়েছে- এমনটি বুঝতে পেরে তিনি জিহ্বা বের করলেন। এই মুহূর্তটিকেই স্মরণ করে চলে পূজা। আমাবশ্যা তিথি সমাগত, কৃষ্ণপক্ষ তিথির শেষ প্রহরে শুরু হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা এবং জোড়া পাঁঠা ও মহিষ বলি। বিকেলেই জড়ো হয়ে গেছে হাজারো মানুষ। মন্দিরের সামনে মেলায় সাজানো লাইটগুলো পর্যায়ক্রমে জ¦লতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে অপূর্ব আর ওর ৫ বন্ধু মেলায় এসে পড়েছে। মেলায় ঢোকার সময়ই ওরা কলাইয়ের ডালের পাপড় খেয়েছে। খুব সুস্বাদু! রাজশাহী আর গোয়ালন্দ থেকে এসেছে ওরা। প্রতিবারই আসে। এরই মাঝে ওরা দেখতে পেল কিছু সাধু ও লাল পোশাকের কিছু সন্ন্যাসীদের। ওনারা মন্দির পানেই ছুটছেন। মাঘ আসলেই কালীমন্দিরে তাদের দেখা মেলে। অন্য সময় তেমন একটা দেখা যায় না। এরা বেশিরভাগ নির্জন এলাকা যেমন শ্মশান, ঘন বন বা কোন পৌঢ় মন্দিরে থাকে। যে মন্দিরের পাশে শ্মশান থাকে সেখানেই তারা বেশি থাকে। আজ এখানে তাদের দেখে ওরা পিছে পিছে যেতে থাকল। মন্দিরের পাশের বটগাছটার পাশেই সাধুদের জন্য বসার জায়গা করেছে মন্দির কর্তৃপক্ষ। তারা পূজাকে সফল করতে খুবই তৎপর। মন্দিরের গেটে দাঁড়াতেই ওদের কপালে তিলক এঁকে দিল কেউ একজন। এতে ওরা খুব আনন্দই পেল। কিন্তু ওদের ভিতরে ঢোকার মতো পরিবেশ নেই। লোকে গিজগিজ করছে মন্দিরের ভেতরটা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের আঁধার নামতে শুরু করেছে। মন্দিরের মাঠটিও মানুষে টইটম্বুর। খুবই উপভোগ করছে অপূর্ব ওরা। এখন মন্দিরের ভেতরটাতে ঢোকা অনেক দুঃসাধ্য ব্যাপার। একটু উত্তেজনা নিয়েই বলল অপূর্ব। অপূর্বর কথা শেষ হতে না হতেই সোহান বলল- তাহলে চল এক কাজ করি। নদীতে যাই। শ্মশান ঘাটের ওখানে জেলেদের মাছ ধরার নৌকা আছে। আমরা ঐ নৌকা নিয়ে একটু নদী ভ্রমণ করে আসি। বালুর মাঠে দৌড় পাল্লাও দেওয়া যাবে। তাছাড়া রাতে নৌকা ভ্রমণ অনেক মজাও হবে। আকাশ: এগুলো কি ঠিক হবে। আমার কিন্তু এখনই খুব ভয় করছে। তাছাড়া জেলেরা যদি আমাদের ধরে ফেলে। তাহলে কী হবে! সোহান : আরে তোরা দেখি এখনও বোকাই রয়ে গেলি। জেলেরা আজ পূজা নিয়ে ব্যস্ত। ওরা এদিকে আসবে না। অপূর্ব : আমাদের কি যাওয়া ঠিক হবে সোহান? সোহান : কোন সমস্যা নেই। আমি আছি তো- আকাশ : তাহলে চল। যাওয়া যাক। পূজার যে অবস্থা দেখছি। তাতে আমরা চাপা পড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাব। এর থেকে নদীতে শীতের মধ্যে কুয়াশার সঙ্গে কথা বলা যাবে আবার মজাও করা যাবে। অপূর্ব সম্মতি দেওয়ায় ওরা শ্মশানঘাটের পেছন দিকটায় চলে আসল- যেখানে জেলেদের নৌকা বাধা থাকে। এ সময়টাতে শ্মশানের পিছনে মানুষ থাকে না। কিন্তু মেলার সময় মানুষে গিজ গিজ করে। মেলা কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের অজান্তে গোপনে জুয়ার আসর বসায়। মাদকের আড্ডাও বসে। পুলিশ টের পেলে তাদের আর রক্ষা নেই। বিড়ি-সিগারেট হরদম ফুঁকে এ জায়গায়। মাঘ মাস হলেও শীত তেমন একটা নেই। মানুষজনের সমাগম বেশি হওয়ায় শীত কেটে গেছে। কিন্তু নদীর পাড়ে হালকা কুয়াশা আর ঠা-া বাতাস বইছে। ভালোই লাগছে ওদের। একটু নিচেই জেলেদের সারি সারি নৌকা বাধা রয়েছে। বছরের কয়েকটি দিনই এ নৌকাগুলোর অবসর মেলে। তার মধ্যে আজকের এ দিনটি! নদীতে সবসময়ই পানি থাকে কমবেশি। তবে এ সময়টাতে গড়াই নদী ছোট নালার মতো হয়ে যায়। আর বাকি অংশটাতে পড়ে চর। সারির মধ্য থেকেই যেকোন একটি নৌকা নিয়েই ওরা ঘুরবে। সোহানের মোটামুটি নৌকা চালানোয় অভ্যাস আছে আগে থেকেই। ও খুব দুরন্ত আর সাহসী। কর্কশ অন্ধকারের মধ্য ওরা নদীর পানিতে বৈঠার আঘাত দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নিমিষেই মিলিয়ে গেল অন্ধকার আর ঘন কুয়াশার চাদরে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে ওরা কোথায় আছে এখন, আর যাবেই বা কোথায়? মোবাইলের আলো দিয়েও দেখা যাচ্ছে না। অপূর্ব গুগল ম্যাপ দিয়ে দেখে নিল ওদের অবস্থান। একে তো আমাবশ্যার আঁধার তার ওপর ঘন কুয়াশা। এত কঠিন ভেদ কিছুতেই পার হতে পারছে না ওরা। এরই মধ্যে ওরা অনুভব করল- কি যেন একটার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ওদের নৌকা আটকে গেছে। এবার ওদের মনে ভয় জমতে শুরু করল। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না ওরা। সোহান পানিতে হাত দিয়ে দেখল পানি অনেকটাই গরম। অর্থাৎ মাঘের শীতেও পানি এত গরম থাকার কাহিনী কী? নিজে নিজেই অবাক হল সোহান। কিন্তু ওদের কাছে বলল না ঘটনাটি। কিসের সঙ্গে বেঁধেছে এটা দেখার চেষ্টা করল সোহান। না কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না আসলে কিসের সঙ্গে বেধেছে নৌকাটি। ওদের মনে হচ্ছে নৌকায় পানি ঢুকছে। কিন্তু মোবাইল ফোনের টর্চ মেরে দেখল, পানি ঢুকছে না- এটি ওদের মনের ভুল। কি আজব এক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছে ওরা। ভয় আর ভয়। সবাই যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ভূতরা ঘিরে রেখেছে। মনে মনে ভাবছে ওরা। তারপর আমাবশ্যা রাত। যে রাতটি ভূতদের কাছে অনেক প্রিয়। ওরা অবাধ হয়ে ঘুরে বেড়ায় নদী বুকে কিংবা জঙ্গলে। মানুষের মধ্যেও আসে। কি যে বিপদ। শেষ পর্যন্ত ওরা ভূতের কবলে পড়ছে? অনেক সাহসী হলেও সোহানও যেন চুপছে গেছে। কুয়াশার শীতল কণার মত হিম হয়ে গেছে সারা শরীর। ও একটু বেশিই ভড়কে গেছে। কারণ ও বুঝতে পেরেছে এখানে বড় ধরনের গ-গোল আছে। ওরা যেখানে এসেছে- এটা নদীর পাক (গভীর জায়গা)। এখানে অনেক অশরীরীরা থাকে। এটা নাকি পাতালপুরীর প্রবেশদ্বার- বড়দের মুখে শুনেছে। ওরা হয়তো ওদের প্রবেশদ্বারে এসে পড়েছে বলেই ওদেরকে পাকড়াও করেছে। ভাবনাটি মোটেও অমূলক কিছু নয়। সাহস করে ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখল ৩টা সাত বেজে গেছে। পূজা এতক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। এখন শুরু হবে পাঁঠা ও মহিষ বলি। শোরগোল হচ্ছে। উলুধ্বনির শব্দও ভেসে আসছে। তার মানে ওরা মেলার খুব কাছাকাছিই আছে। আস্তে আস্তে অন্ধকার কাটতে শুরু করছে। এখন একে অপরের চেহারা দেখতে পারছে ওরা। এরই মাঝে পানির ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল- অনেক সাহস হয়ে গেছে তোদের? ভেবেছিলাম তোদের শেষ করে দিব। কিন্তু না তোদের বাঁচিয়ে দিলাম। তোরা তাড়াতাড়ি চলে যা এখান থেকে। কোনদিনও আসবি এখানে। এ জায়গাটি খুব ভয়ানক। এখান থেকে কেউ কখনো ফিরে যায়নি। তোরাই ভাগ্যবান- যারা ফিরে যাচ্ছিস। অদৃশ্য প্রকট কণ্ঠস্বরটি ওদেরকে আরও দুর্বল করে দিল। অপূর্বদের মুখে কথা বলার শক্তি যেন নিমিষেই উধাও। ভয় ভয়তে সোহান কাঁপুনি কণ্ঠে বলল- আ....”....ছা.....হ ঠিক আছে। রাতটি অনেক দীর্ঘ ছিল। চোখে-মুখে ওদের রহস্য। কিছুক্ষণ পরে ওরা ফিরে আসল মেলার দিকে শ্মশান ঘাটের পিছনে। নৌকা থেকে তাড়াতাড়ি নেমে হাঁটা শুরু করল মেলার দিকে। পাঁঠা ও মহিষ বলি হয়ে গেছে। ঠাকুর ও ভক্তদের নির্ঘুম কেটেছে। উৎসবের রেশ এখনও কাটেনি। এখনও পূজা-আরাধনা-ভক্তি চলছে। মন্দিরের উন্নয়ন কল্পে মাইক থেকে ভেসে আসছে ধারাভাষ্যকারের দান প্রার্থনার আকুতি। সবই শুনছে- দেখছে কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না ওরা। ভিড় ঠেলে ওরা রওনা দিল বাড়ির দিকে-। লেখক : সাংবাদিক, মোহনা টেলিভিশন
×