ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মায়ের কবরে শায়িত খালিদ হোসেন

প্রকাশিত: ১০:১৫, ২৪ মে ২০১৯

 মায়ের কবরে  শায়িত খালিদ  হোসেন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নজরুল সঙ্গীতের অমিয় ধারায় নিজেকে সিক্ত করার পাশাপাশি, তার সঙ্গীতলব্ধ জ্ঞান ছড়িয়ে দিয়েছেন হাজারো শিক্ষার্থীর মাঝে। একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য নজরুল সঙ্গীত সাধক, গবেষক, স্বরলিপিকার সঙ্গীতগুরু খালিদ হোসেন রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চির বিদায় নেন বুধবার রাত সোয়া ১০টায়। তার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী কুষ্টিয়ায় মায়ের কবরে তাকে দাফন করা হয় বৃহস্পতিবার রাতে। এ খবরটি কুষ্টিয়া থেকে মোবাইল ফোনে নিশ্চিত করেছেন খালিদ হোসেনের ছেলে আসিফ হোসেন। শিল্পী খালিদ হোসেন কয়েক বছর ধরে হৃদরোগে ভুগছিলেন। শারীরিক গুরুতর সমস্যা নিয়ে তিনি গত বছরের শুরুর দিকে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তিও হয়েছিলেন। এরপর থেকে প্রতি মাসে তাকে একটি বিশেষ ইনজেকশন দিতে হতো। গুণী এ শিল্পীর চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর ১০ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। কিছুদিন আগে তাঁর কিডনির জটিলতা বেড়ে যায়। ফুসফুসেও সমস্যা হচ্ছিল। পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যা ছিল। তিনি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বুধবার রাত সোয়া ১০টায় চির বিদায় নেন গুণী এ শিল্পী। তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। হাসপাতাল থেকে রাতে খালিদ হোসেনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর মোহাম্মদপুরে তাজমহল রোডের নিজ বাসায়। বৃহস্পতিবার ফজর নামাজের পর বায়তুল আমান মিনার মসজিদে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সকাল ১০টায় নজরুল ইনস্টিটিউটে তার মরদেহ নেয়া হয়। সেখানে তাঁকে শ্রদ্ধা জানান নজরুলসঙ্গীতের শিল্পী, তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও ছাত্রছাত্রী আর শুভানুধ্যায়ীরা। খালিদ হোসেনের দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয় সেখানে। শ্রদ্ধা জানাতে আসেন নজরুলসঙ্গীত শিল্পী সালাউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আজ প্রায় ৩০ বছর ধরে খালিদ ভাইয়ের সঙ্গে সঙ্গীত নিয়ে কাজ করছি। উনি আমাদের মুরব্বি ছিলেন। এখন আন্তরিকভাবে নজরুল চর্চা খুবই কম হয়। এ সময় এমন একজন মানুষ যিনি নিবেদিত হয়েই নজরুল চর্চা করতেন তার চলে যাওয়া দুঃখজনক। একসময় সবাইকে চলে যেতে হবে এটা ঠিক কিন্তু চলে গেলে কষ্ট লাগে। অনেক অসুস্থ অবস্থায়ও তার মনের জোরে চলতেন। তার সময় নিয়মানুবর্তিতা অনুসরণযোগ্য। সঙ্গীতশিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল বলেন, আমি অনেক ছোটবেলা থেকে খালিদ হোসেন সাহেবের সঙ্গে পরিচিত। কারণ তখন রেডিও টিভিতে ওনার গান শুনতাম। বেড়ে উঠে যখন নজরুলের গান চর্চা শুরু করলাম, তখন থেকে ওনাকে নজরুলের গানের শিল্পী হিসেবেই পেয়েছি। একটা পর্যায় এসে শুদ্ধ নজরুল চর্চা, শুদ্ধ বাণী, আদি সুর এগুলো নিয়ে কাজ করার ভাবনা যখন আসে, তখন একটি সংগঠন করলাম যার নাম ‘বাংলাদেশ নজরুল সঙ্গীত সংস্থা’। সেটার উনি ছিলেন সভাপতি আর আমি সাধারণ সম্পাদক। তখন থেকে তার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠতা হয়। নজরুলের গান শুদ্ধভাবে গাওয়ার চেষ্টা সব সময় ওনার ভেতর ছিল। শেষ বয়সেও তার ভেতর অনেক আগ্রহ দেখেছি। মানুষ হিসেবে ওনার কমিটমেন্ট ছিল সত্য পথে চলা। সেটার সঙ্গে শুদ্ধ নজরুল চর্চা করার কমিটমেন্টও ছিল। কোন অহংকার ছিল না। মানুষ হিসেবে অতি উত্তম ছিলেন। স্বল্পভাষী এবং খুবই ভদ্রলোক ছিলেন। আমাদের খুব স্নেহ করতেন এবং সব সময় অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। পরিণত বয়সে উনি চলে গেলেন এটা ঠিক কিন্তু তারপরেও ওনার সৃষ্টির জন্য উনি বেঁচে থাকবেন। এ প্রজন্মের সঙ্গীতশিল্পী বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী বলেন, খালিদ স্যারের প্রস্থান নজরুল সঙ্গীতের জন্য খুবই ক্ষতি হলো। শুদ্ধভাবে নজরুল সঙ্গীত চর্চা খালিদ স্যারই প্রথম থেকে ধরে রেখেছিলেন। নিজে গেয়েছেন, আমরা যারা ছাত্রছাত্রী ছিলাম তাদেরও শিখিয়েছেন। যারা বিকৃতভাবে গেয়েছেন তাদের সচেতন করেছেন। তিনি আপাদমস্তক একজন গুণী শিল্পী ছিলেন। সব সময় আনন্দের সঙ্গে গান শেখাতেন। শেষবারের মতো খালিদ হোসেনের মরদেহ জাতীয় কবির কবরের পাশে নিয়ে যেতে চেয়েছিল তার পরিবার। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি। খালিদ হোসেনের ছেলে আসিফ হোসেন বললেন, বাবা তেমন কিছু বলেননি, তবে আমি আর আমার মা চেয়েছিলাম, জাতীয় কবির কবরের পাশে কিছুক্ষণ বাবার মরদেহটা রাখব, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে বাবার জানাজা হবে। কিন্তু যাদের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন ছিল, শেষ পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পাইনি। নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে খালিদ হোসেনের মরদেহ কুষ্টিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। খালিদ হোসেনের ছেলে আসিফ হোসেন বলেন, বাবা বলতেন তাকে যেন দাদির কবরে দাফন করা হয়। বাবার কথা মতই কুষ্টিয়া ঈদগাহে বাদ এশা জানাজা শেষে, কুষ্টিয়া সদর কোটপাড়া কবরস্থানে তার মায়ের কবরে বাবাকে দাফন করা হয়। বরেণ্য এ শিল্পীর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে সংস্কৃতি অঙ্গনে। গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক শোক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রী শিল্পী খালিদ হোসেনের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। শোক প্রকাশ করেন তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মুরাদ হাসান। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ শোক প্রকাশ করা হয়। পৃথক শোকবার্তায় মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী মরহুমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি জন্ম ১৯৩৫ সালের ৪ ডিসেম্বর। তখন তারা ছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরে। দেশ বিভাগের পর মা-বাবার সঙ্গে তিনি চলে আসেন কুষ্টিয়ার কোর্টপাড়ায়। তিনি ২০০০ সালে একুশে পদক পেয়েছেন। এছাড়া পেয়েছেন নজরুল একাডেমি পদক, শিল্পকলা একাডেমি পদক, কলকাতা থেকে চুরুলিয়া পদকসহ অসংখ্য সম্মাননা। খালিদ হোসেনের গাওয়া নজরুল সঙ্গীতের ছয়টি এ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। আরও আছে একটি আধুনিক গানের এ্যালবাম ও ইসলামী গানের ১২টি এ্যালবাম।
×