ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তির লাখো-কোটি মশাল!

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ২৪ মে ২০১৯

মুক্তির লাখো-কোটি মশাল!

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ২৪ মে দিনটি ছিল সোমবার। সমগ্র বাংলাদেশ এই দিন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বাংলার সবুজ প্রান্তরে জ্বলে উঠেছে মুক্তির লাখো কোটি মশাল। তার আগুন স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার দিগদিগন্তে। স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অগণিত বাঙালী শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবীর দল। তারা প্রত্যেকেই আজ এক-একজন মুক্তিসেনায় পরিণত হয়েছে। জীবন বাজি রেখে তারা লড়ে যাচ্ছে মুক্তির জন্য। দুর্জয় সাহসে অপ্রতিরোধ্য গতিতে শত্রুর ওপর আঘাতের পর আঘাত হেনে চলেছে। এই দিন ক্যাপ্টেন অলি একটি তিন ইঞ্চি মর্টার সেকশন ও এক কোম্পানি যোদ্ধা নিয়ে চট্টগ্রাম সেনাবাহিনীর ঘাঁটি চাঁদগাজী আক্রমণ করেন। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাকসেনারা চাঁদগাজী ছাড়তে বাধ্য হয়। সিলেটের মুক্তিবাহিনীর সুতারকান্দি চেকপোস্টে পাকবাহিনী হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা সংখ্যায় কম হলেও প্রথম দিকে এমনভাবে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে অবস্থান নেয় যে, পাকসেনারা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু পরে পাকসেনারা ব্যাপক হামলা চালালে এবং মুক্তিযাদ্ধাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে এলে তাঁরা তাঁদের অবস্থান ত্যাগ করেন। এ সংঘর্ষে ৩৯ জন পাকসেনা নিহত এবং ২জন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়, অপরদিকে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ও কয়েকজন আহত হয়। এদিন কর্নেল ওসমানী মুক্তিযোদ্ধাদের ভূরুঙ্গামারী থানা হেড কোয়ার্টার পরিদর্শন করেন। তিনি স্থানীয় যোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রতিরোধ ও কুড়িগ্রাম শহর সংলগ্ন ধরলা নদীর উত্তর-তীরস্থ মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ ঘাঁটি মজবুত করার বিষয়ে আলোচনা করেন। ঝালকাঠিতে পাকহানাদার বাহিনী ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। দৈহারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে ১৭ জন নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে সবাই নিহত হয়। অপর এক ঘটনায় পাক বর্বররা খাড়াবাগ গ্রামের অঞ্জলি রানীকে হাত-পা বেঁধে জীবন্ত পুড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতাবিরোধী জিএম খানের সভাপতিত্বে দিলু রোডে শান্তি কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংস করার জন্য আহ্বান জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আমাদের দেশ, আমাদের জনগণ শান্তিতে বিশ্বাসী। তবে আমি আমাদের জনগণকে সতর্ক করে দিতে চাই, আমাদের হয়তো আরও অনেক বেশি বোঝা বহন করতে হতে পারে। আজ আমরা যেসব সমস্যার মখোমুখি সেসব কেবল অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা নয়। সেসব জাতীয় সমস্যা। বস্তুত মূল সমস্যাটি হলো আন্তর্জাতিক। আমরা বিদেশে অবস্থিত আমাদের প্রতিনিধি ও ভারতে অবস্থিত বিদেশী সরকারগুলোর প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিশ্ব-বিবেক জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছি। জাতিসংঘের কাছেও আমরা আবেদন জানিয়েছি। শ্রীমতি গান্ধী বলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের নির্বোধ কার্যকলাপের মাধ্যমে প্রতিবেশীদের প্রতি বন্ধুসুলভ মনোভাব এবং শান্তি ও মানবতার মৌল নীতিগুলো যথেচ্ছভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত, পূর্ববঙ্গের সমস্যার কোন সামরিক সমাধান হতে পারে না। যাদের ক্ষমতা রয়েছে, তারা রাজনৈতিক সমাধান করতে পারেন এবং তাদের করতেই হবে। এ ব্যাপারে বৃহৎ শক্তিবর্গের একটি বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। তারা যদি শিগগির সঠিকভাবে তাদের শক্তি প্রয়োগ করেন তাহলেই কেবল আমাদের উপমহাদেশে আমরা স্থায়ী শান্তি দেখতে পাব। তিনি ইউ ও এ আর এর সভাপতি ও মিসরের প্রেসিডেন্ট জনাব সাদাতকে একটি ব্যক্তিগত বার্তা পাঠিয়েছেন যা প্রাথমিকভাবে পূর্ববাংলা ও ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থার একটি প্রতিবিম্ব তুলে ধরেছে। তিনি তার বার্তায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান এর পূর্ববাংলায় রক্তপাত বন্ধ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মধ্যস্থতা করার অনুরোধ জানিয়েছেন। ময়মনসিংহে অতর্কিতভাবে পাকসেনারা বিমান থেকে মর্টারের গোলাবর্ষণ করে, পানিহাটা মিশন মুক্তিযোদ্ধাদের হাইড আউটে আক্রমণ চালালে ময়মনসিংহ শহরের কৃষ্টপুরের আব্দুল মতিন শহীদ হন। প্রত্যুত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা রামচন্দ্রকুড়া সীমান্ত ফাঁড়িতে আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদের হটিয়ে দিয়ে সীমান্ত ফাঁড়ির সমস্ত ঢেউটিন খুলে এনে নিরাপদ আশ্রয়ের বেড়া সৃষ্টি করে। এই দিন সংবাদ সংস্থা এ পি এর বরাতে আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘স্টিমার আটক করে ১৭ জন পাকিস্তানীর প্রাণদ-াদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ যাত্রীবাহী স্টিমার আটক করেছে এবং গণআদালতে বিচার করে স্টিমারের অবাঙালী যাত্রীদের ১৭ জনকে মৃত্যুদ- দিয়েছে। গতকাল কূটনৈতিক মহলেই খবর দিয়েছে। তারা বলেছেন, সেনাবাহিনী যদিও বলেছেন সব প্রতিরোধ চূর্ণ করা হয়েছে তবু ওখানে যে এখনও প্রতি আক্রমণ চলছে এটাই তার বড় প্রমাণ। কোন রাজনীতিক সামরিক শাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন না এবং যেসব পশ্চিম পাকিস্তানী পূর্ববাংলায় অসামরিক কাজকর্মে লিপ্ত তারাও নিজেদের নিরাপত্তা সম্পর্কে চিন্তিত। মুক্তিবাহিনী মে মাসের গোড়ার দিকে স্টিমারটিকে আটক করে। স্টিমারটি ঢাকা ও খুলনার মধ্যে নিয়মিত যাতায়াত করত। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, খুলনা শেখের নিজস্ব অঞ্চল। তারা কালিয়া থানার জয়নগর হাইস্কুলে আয়োজিত গণআদালতে ১৭ জনকে বেছে নিয়ে বিচার করেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর খবর, ১৭ জনের মধ্যে ১২ জনের প্রাণদ-াদেশ কার্যকর হয়েছে। একই দিন পি টি আই এর বরাতে দৈনিক যুগান্তর শিরোনাম করেছে নারায়ণগঞ্জ শহরে মুক্তিফৌজ গেরিলা ‘সক্রিয়’। সীমান্তের ওপার থেকে এখানে বিলম্বে প্রাপ্ত এক খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ শহরে মুক্তিফৌজ গেরিলারা ‘সক্রিয়’ হয়ে উঠেছে। জানা গেল, মুক্তিফৌজ গেরিলাদের হাতবোমায় সম্প্রতি ইংল্যা- ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি টারমিনাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঢাকায় শাহজাহানপুরে কমান্ডোরা পাকসৈন্য বোঝাই ২টি জীপ উড়িয়ে দেয়। আর এক মহল থেকে এই মর্মে খবর পাওয়া গিয়াছে সামরিক প্রশাসন কর্তৃপক্ষের অবাঙালী তাঁবেদাররা সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলের বহুসংখ্যক কর্মীকে খুন করেছে। মিলের ম্যানেজার ও মেডিক্যাল অফিসারও রেহাই পাননি। এই দিনে পাকিস্তান টাইমসে প্রকাশিত প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্যে তিনি জানান যে আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা করছেন। ক্ষমতা হস্তান্তর করাই তার মূল লক্ষ্য এবং তিনি কখনই তার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। পূর্ব পাকিস্তানে যে বিদ্রোহ চলছে, তা তার ক্ষমতা হস্তান্তরে একটি বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করেছিল, যদিও তা ছিল একটি অস্থায়ী সমস্যা। সেই সঙ্গে তিনি বলেন, গত দুই বছর ধরে চলমান পরিস্থিতিতে দেশে নির্বাচন দেওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছিল। তিনি বলেন- ‘আমি এই নির্বাচন ব্যর্থ হতে দিতে পারি না, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসা মাত্রই আমি আমার লক্ষ্য পূরণ করব। যদিও তিনি আবারও একটি বিষয় স্পষ্ট করে দেন যে ‘আমি কোন অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করব না। এই ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টাতে কোনও পরিবর্তন ঘটেছে বা সম্ভাবনা আছে কিনা তা জানতে চাইলে উত্তরে তিনি বলেন, একজন সৈনিক হলে আপনি বুঝতে পারতেন যে সেনাবাহিনীতে লক্ষ্যপূরণ হলো যুদ্ধের অন্যতম নীতি এবং আমার লক্ষ্য এখনও আগের মতই অটুট আছে আর তা হলো ক্ষমতার হস্তান্তর। তিনি বলেন, তিনি গত দুই বছর ধরেই এই কথা বলে আসছেন, কিন্তু কেউ তার কথা বিশ্বাস করছে না। কিন্তু তিনি এখনও এটি করার আশা করেন। তিনি বলেন, এমনকি আমার নিজের অনেক জনগণের এই বিষয়টি পছন্দ নয়, কিন্তু তারপরেও আমি এটা করব, কেননা আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। আমার বিশ্বাস যে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই ক্ষমতার যোগ্য এবং তারা তা পাবে। এই দিন ব্যাঙ্কক পোস্ট ‘বিশ্ব কিছুই করছে না’ শিরোনামে সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করে, যাতে বলা হয়েছে, আমরা যদি এমন পরিস্থিতি চিন্তা করি যে ব্যাঙ্কক এবং থানবাসির প্রত্যেক নাগরিকের খাদ্য, বাড়ি চাকরি এবং চিকিৎসার সুযোগ নেই, তবে আমরা বুঝতে পারব পূর্ব পাকিস্তানীদের ২.৬ মিলিয়নের অবস্থা কি! সেখানে এই মানুষগুলো নিজের ভিটেয় টিকে থাকতে না পেরে শরণার্থী হয়েছে। এই সংখ্যাটা হলো তাদের যারা গত সাত সপ্তাহে দেশের যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে ভারতে পারি জমিয়েছে। আরও কত মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে তা অনুমান করা অসম্ভব। অন্যদিকে গত শুক্রবার রাষ্ট্রপতি ইয়হিয়া খান তার বিবৃতিতে বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিকের দিকে ফিরে এসেছে এবং ভারতে অবস্থিত সব উদ্বাস্তু এখন দেশে ফিরে আসতে পারেন। এটা স্পষ্ট যে বিস্তৃত সাহায্যের জন্য বিশ্ববাসীর জরুরী সাহায্য প্রয়োজন। গত বছর যখন ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল তখন পূর্ব পাকিস্তানে তেমন কোন সহায়তার ব্যবস্থা ছিল না যেমনটা আমরা দেখেছি। তখন বাইরের সাহায্য চাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু এবার কোনও রয়াল মেরিন বঙ্গোপসাগরে আসেনি- কোনও মার্কিন হেলিকপ্টার চাল দিতে মাটিতে নামেনি। পৃথিবী সব সময় পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল এবং বলেছে এবার তাদেরকে নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে দিন। কিন্তু আমরা এই ঘটনা চলতে দিতে পারি না। মানবতার নামে, আমরা গৃহযুদ্ধ শুরু করতে পারি না। বিশ্ব পূর্ব পাকিস্তানে অনেক ভাল কিছু করতে পারে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×