ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষিতদের প্রায় ৫০ শতাংশই বেকার, মনের মতো কাজ পাচ্ছেন না ;###;বিদেশে কমছে সনদের মর্যাদা ;###;সঙ্কট উত্তরণে শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন ও শক্ত এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল চান শিক্ষাবিদরা

বাড়ছে শিক্ষিত বেকার ॥ মানহীন শিক্ষা, চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিহীন শিক্ষা ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ১০:১৭, ২৩ মে ২০১৯

বাড়ছে শিক্ষিত বেকার ॥ মানহীন শিক্ষা, চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিহীন শিক্ষা ব্যবস্থা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়লেও মান সঙ্কট আর কাজের বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিহীন শিক্ষাব্যবস্থার কারণে বেড়েই চলেছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। প্রতিবছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেকই বেকার থাকছেন অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না। লাখ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কাজের বাজারের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রতিবছর ২৫ থেকে ৩০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছেন। কিন্তু কাজ পান মাত্র সাত থেকে আট লাখ। প্রায় ৫০ শতাংশ স্নাতকই বেকার। শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষার মান সঙ্কট বেকার সমস্যাকে প্রকট করছে। বিদেশেও কমছে সনদের মর্যাদা। সঙ্কট উত্তরণে শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন ও কার্যকর এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল হতে পারে বড় সমাধান। উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিতের আশায় দেশে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বাংলাদেশ এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদও উদ্বিগ্ন দেশের উচ্চশিক্ষার মানের সঙ্কটজনক পরিস্থিতি নিয়ে। তিনি বলেছেন, আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশে প্রশ্ন আছে। দিন দিন সার্টিফিকেট মূল্যায়নে পিছিয়ে পড়ছি আমরা। এর মূল কারণ হচ্ছে গবেষণাহীন, সেকেলে শিক্ষা, অগভীর ও অগোছালো শিক্ষা পদ্ধতি। শৃঙ্খলা ও মানোন্নয়নে তাই যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া দরকার। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে এই মুহূর্তে বাস্তব, পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে এ জাতি। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে নবগঠিত বাংলাদেশ এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলকে (বিএসি) কর্মময় ও সক্রিয় করতে সবার সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। কারণ শিক্ষার মানোন্নয়ন গবেষণা, কোয়ালিটি ও সিলেবাস কারিকুলাম ডেভেলপমেন্টে এখনই হাত না দিলে ভবিষ্যাতে এর দায় আমাদের নিতে হবে। মানহীন উচ্চশিক্ষা শিক্ষিত বেকার সমস্যা বাড়াচ্ছে মন্তব্য করে অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, উচ্চশিক্ষায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে আসন সংখ্যা সাড়ে ছয় লাখের বেশি। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন রয়েছে ৫৩ হাজারের ওপরে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে তিন লাখ ২৭ হাজার প্রায়। এর বাইরে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশকিছু আসন রয়েছে। ইন্টার লেভেলে ৩৬ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। তারা ১৫৫টি প্রাইভেট ও সারাদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত প্রায় দুই হাজার বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অনার্স, মাস্টার্স সম্পন্ন করছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কি পড়ানো হচ্ছে তাদের? প্রায়ই দেখি দেশে হাজার হাজার শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার পরও বেকার হয়ে রাস্তায় চাকরির জন্য ঘুরছে। এর মূল কারণ হলো মানহীন শিক্ষায় শিক্ষিত তারা। হতাশা প্রকাশ করে এ শিক্ষাবিদ আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনও দেখা গেছে, ১৯৭৭ সালের জনৈক শিক্ষার্থীর হ্যান্ড নোট নিলক্ষেত থেকে ফটোকপি করে পড়ছে ২০১৯ সালের শিক্ষার্থীরা। যুগ যুগ ধরে চলছে ডিপার্টমেন্টের ওই বড় ভাইয়ের নোট। একই বিভাগের গত বাধা সেই নোট তোতা পাখির মতো ঠোঁটস্ত করে যাচ্ছে। তারা পাস করছে কিন্তু মেধাহীনভাবে। এখনও চার পাঁচ দশক আগের সিলেবাসে চলছে বেশ কিছু ডিপার্টমেন্ট। গবেষণার ধারেকাছেও নেই এগুলো। এ হল আমাদের উচ্চশিক্ষার একাংশের চিত্র। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। সাত কলেজের ঝামেলা তো লেগেই আছে। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের গুরুত্বের কথা তুলে ধরে অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত যেসব সমস্যা সামনে চলে এসেছে তার সঠিক সমাধান, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও নিরূপণ করাই এই কাউন্সিলের কাজ। বিশ্বের অনেক দেশে এ কাউন্সিল গঠন করে তার এক্সপার্টরা উচ্চশিক্ষায় আমূল পরিবর্তন এনেছেন। এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার নাম বলতেই হয়। বিগত ৫ বছরে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। কারণ উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নে যে ক্যাটাগরি তারা দিয়েছে তা পালনে ব্যর্থ হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এখন শিক্ষায় এসেছে সুষ্ঠু পরিবেশ। বাংলাদেশ এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের লক্ষ্য ধীরে ধীরে সে পথের দিকেই ধাবিত হওয়া। কিন্তু উচ্চশিক্ষায় মান সঙ্কট আর কাজের বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিহীন শিক্ষাব্যবস্থার কারণে কিভাবে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা? আর শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়লে দেশের সেই চিত্রটাই বা কেমন? কি বলছেন দেশী-বিদেশী গবেষণা সংস্থা ও শিক্ষাবিদরা? তারা বলছেন, এটি একটি বড় সমস্যা হলেও সরকারীভাবে ভাল কোন গবেষণা বা জরিপ খুব একটা দেখা যায় না। প্রায় পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপেও উঠে এসেছিল বেকারত্বের একটি চিত্র। সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে শ্রমশক্তির পরিমাণ প্রায় ছয় কোটি। এর মধ্যে সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের কাজ আছে। এর অর্থ প্রায় অর্ধ কোটি মানুষ বেকার। তবে জরিপেই বলা আছে, পরিবারের মধ্যে কাজ করে কিন্তু কোন মজুরি পান না, এমন মানুষের সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। এ ছাড়া আছে আরও এক কোটির বেশি আছেন দিনমজুর, যাদের কাজের কোন নিশ্চয়তা নেই। তবে বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থা বিশেষত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার হিসাব বলছে, বাংলাদেশের প্রায় ৫০ শতাংশ স্নাতকই বেকার। দক্ষিণ এশিয়ায় এর চেয়ে বেশি উচ্চ শিক্ষিত বেকার আছেন কেবল আফগানিস্তানে ৬৫ শতাংশ। বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্নাতকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা আর কাজের বাজারের চাহিদার মধ্যে বিশাল ফারাক থাকায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও বাড়ছে। বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। যদিও এ পরিসংখ্যান কয়েক বছর আগের, এখন এই পরিমাণ আরও বেড়েছে বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ‘হাই ইউনিভার্সিটি এনরোলমেন্ট, লো গ্র্যাজুয়েট এমপ্লয়মেন্ট’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে ইআইইউ বলেছে, গত এক দশকে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়লেও শিক্ষার গুণগত মান বাড়েনি। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। আর শ্রমবাজার ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয় নেই। স্থানীয় ও বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিতদের কারিগরি ও কাজ করার মতো দক্ষতা কম। তাই উচ্চ শিক্ষিত স্নাতকদের অনেকে বেতন পান বেশ কম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের মান বৈশ্বিক মানদ-ের সঙ্গে তুলনীয় হওয়ার কথা থাকলেও দেশের শিক্ষাকে বাজার উপযোগী নয় বলে বলছেন বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, শিক্ষায় সবার জন্য আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক মনে করে, সরকার কম দেখালেও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর ওপর এখন প্রতিবছর নতুন করে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছেন। সুতরাং নতুন কর্মসংস্থান তৈরির চাপ রয়েছে অর্থনীতির ওপর। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের হার ২ শতাংশ বাড়ানো গেলে প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে উন্নীত হবে। আর তাহলেই ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ হওয়া সম্ভব। দেশীয় গবেষণা সংস্থাগুলোর অভিমত প্রায় অভিন্ন। তারা বলছে, প্রতিবছর ২৫ থেকে ৩০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু কাজ পায় মাত্র সাত থেকে ৮ লাখ। প্রায় ৫০ শতাংশ স্নাতকই বেকার। শিক্ষার মান সঙ্কট উচ্চ শিক্ষিত বেকার সমস্যাকে প্রকট করছে। উচ্চ শিক্ষিত অর্থাৎ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যারা শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন, তারাও আছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে কিছু করার চেষ্টা করেন। আবার অনেকে নিজের যোগ্যতার চেয়ে কম মানের কাজ করতে বাধ্য হন। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবীর পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, দেশে ৪০ শতাংশের বেশি শিক্ষিত বেকার। বিষয়টি চিন্তার। প্রতিবছরই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। তাই শিক্ষার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক নীতি এবং অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির আলোকে শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় না করলে এ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। জাতীয় শিক্ষানীতিকে শ্রমবাজারের প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে কারিকুলাম নির্ধারণের কথা আমরা বলেছি। বিদেশে গিয়ে শ্রমবাজারের অবস্থা দেখে সে অনুসারে শিক্ষাব্যবস্থা সাজানোর কথা বলেছিলাম আমরা। এটা না করতে পারলে শিক্ষিত বেকারের সমস্যা যাবে না বরং বাড়তেই থাকবে। কারণ একদিকে যে শিক্ষা আমরা দিচ্ছি তার কোন বাজারে চাহিদা নেই। তারপর যে শিক্ষা সে পাচ্ছে তার নেই কোন আন্তর্জাতিক মান। এ শিক্ষাবিদ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেড়েছে। কিন্তু মান সঙ্কট আর কাজের বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিহীন শিক্ষাব্যবস্থার কারণেই বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। যার ফলস্বরূপ দেশের গার্মেন্টস সেক্টরেই কাজ করছেন বিদেশের লাখ লাখ দক্ষ কর্মকর্তা। যারা বছরে নিয়ে যাচ্ছে ৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরের জন্য আমরা নিজেরা ওই পরিমাণ দক্ষ জনবল তৈরি করতে পারি। কিন্তু সেটা হ”ে ছনা। এ জন্যই শিক্ষানীতিকে বাজারের অবস্থা চাহিদা দেখে কারিকুলাম ঠিক করার কথা বলা হয়েছে। তাই শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন হতে পারে শিক্ষার অনেক সমস্যার সমাধান। পোশাক খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানা ও বায়িং হাউসে বিদেশী কর্মীর সংখ্যা সাত থেকে ৮ লাখ। যারা প্রত্যেকে মোটা অঙ্কের বেতন পান। মার্চেন্ডাইজার, প্যাটার্ন মাস্টার ও ডায়িংয়ে অনেক বিদেশী কাজ করেন। বায়িং হাউসে মার্কেটিংয়ের দায়িত্বে আছেন বেশির ভাগ ভারতীয়। নির্বাহী পরিচালক, মহাব্যবস্থাপক, ব্যবস্থাপক পর্যায়ে আছেন অনেক ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কান। আর ডায়িংয়ে ফিলিপাইনের কর্মী রয়েছেন অনেক। অথচ বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় পোশাক খাতের জন্য দক্ষ কর্মী তৈরির বিষয়টি তেমনভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না। বাংলাদেশ লেদার গুডস এ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ সব সময়েই বলছেন, বিশেষায়িত কাজের জন্য দেশে ন্যূনতম যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী না পেয়ে উদ্যোক্তারা বিদেশী কর্মী নিয়োগে বাধ্য হন। শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. মমতাজ উদ্দিন পাটোয়ারী দেশের উচ্চ শিক্ষার সঙ্কটের কথা তুলে ধরে বলেন, এ শিক্ষাটা আমার দৃষ্টিতে উচ্চশিক্ষা নয় বরং এটা আসলে ‘নিম্ন’ পর্যায়ের একটি শিক্ষা। আমাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়লেও মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যে শিক্ষা আমরা দিচ্ছি তা কাজের বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এতে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য এমন দীর্ঘ লাইন চোখে পড়লেও উচ্চশিক্ষা শেষে অনেকেই বেকার থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কাজের বাজারের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। বিদেশেও আমাদের সনদের গুরুত্ব করছে। শিক্ষায় সবার জন্য আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন দরকার। উচ্চশিক্ষা পাঠ্যক্রম তৈরিতে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যক্রম সময়োপযোগী করতে হবে। এ জন্য আইনপ্রণেতা, নিয়োগকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সমন্বয় দরকার। উচ্চশিক্ষার সমস্যা কোথায়? এ প্রশ্নে এ শিক্ষাবিদ বলেন, উন্নত দেশগুলোতে গবেষণা উচ্চশিক্ষার আবশ্যকীয় অংশ। তাদের কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণার সঙ্গে শুরু থেকে পরিচিত করানো হয়ে থাকে। গবেষণাপদ্ধতি একটি কোর্স হিসেবে তা তত্ত্বীয় জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা থাকে। পাশাপাশি বিষয়টিকে কিভাবে গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ধারণ করবে, সেটিও প্রায়োগিকভাবে রাখার ব্যবস্থা থাকে। শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট গবেষণার সঙ্গে নিজেরা শুধু পরিচিত হয় না, নিজেদের যুক্ত করতে বাধ্য হয়। কিন্তু আমরা আছি উল্টো পথে। এটি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এখন কল্পনা করা যায় না। অথচ আমরা দেশে উচ্চশিক্ষার নামে অপরিকল্পিতভাবে কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করছি, তাঁদের বেশির ভাগই সনদধারী, মৌলিক চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের খুব একটা অধিকারী হয় না। সে কারণেই আমাদের লাখ লাখ ‘উচ্চশিক্ষিত’ তরুণ-তরুণী তাদের সনদ নিয়ে তেমন কিছু করতে পারে না। উচ্চশিক্ষা গবেষণাহীনভাবে রেখে দেয়ায় এটি অনেকটাই অর্থহীন হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে নতুন করে উদ্যোগ নিতে হবে। এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠান না থাকা ও মানের সমস্যার নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন লেখক, গবেষক, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ইমেরিটাস অধ্যাপক বলেন, সত্যি বলতে কী, আমরা এখনও আমাদের শিক্ষার উপযুক্ত কাঠামোই দাঁড় করাতে পারিনি। তা সেটা প্রাথমিক স্তরে হোক আর প্রাইমারি স্তরেই হোক। শিক্ষার সর্বনাশ ঘটেছে অতিরিক্ত পাবলিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে। কোন প্রকার সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করেই একের পর এক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। তাতে করে গোটা শিক্ষার আয়োজন পরীক্ষা নির্ভর হয়ে পড়ছে। যেটুকু পড়লে পরীক্ষায় ভাল করা যাবে, সেটুকু নিয়েই ব্যস্ত শিক্ষার্থীরা। ক্লাসে মন নেই, গোটা বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। আর শিক্ষক, অভিভাবকরাও তাতেই আটকে আছেন। এই ধারণা কোনভাবেই শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, নির্দিষ্ট ছকের বাইরে আর শিক্ষার্থীরা ভাবতে পারছে না। সর্বশেষ আমরা সৃজনশীল পদ্ধতির সংযোজন দেখলাম। কাজে আসল না। এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের আরও ক্ষতি করেছে। অর্থাৎ সব আয়োজন মূলত পরীক্ষাকে কেন্দ্র করেই। এই ইমেরিটাস অধ্যাপক বলেন, পরীক্ষা নির্ভর শিক্ষা আসলে কী দিচ্ছে আমাদের, তা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময়ে দেখা যাচ্ছে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করছে। তারা ন্যূনতম নম্বরও পাচ্ছে না। আবার যারা পাস করে ভর্তি হচ্ছে, তাদেরও অবস্থাও ভাল বলা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই শিক্ষার্থীরা চাকরির পড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে কোন গবেষণার প্রবণতা নেই, সৃজনশীলতা নেই। নেই সাংস্কৃতিক চেতনার মধ্য দিয়ে শিক্ষা অর্জনের প্রবণতা। আবার চাকরির পড়া পড়েও যখন লাখ লাখ শিক্ষার্থী বেকার হয়ে পড়ছেন, তখন অন্যরাও শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, অবকাঠামোর দিক থেকে, বাজেট বরাদ্দ, ল্যাবরেটরি-লাইব্রেরি সুবিধা- এগুলোর দিক থেকে আমরা বিশ্বমানের চেয়ে পিছিয়ে আছি- সেটি অস্বীকার করা যাবে না। এই সীমিত সুযোগ দিয়ে আমাদের গ্র্যাজুয়েটদের যে পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছি সেটি একটি র‌্যাঙ্কিংয়ের দাবি রাখে। আমাদের ফ্যাসিলিটি আর শিক্ষকদের মান বাড়ানোর জন্যে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তা শুধু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নয়। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও বাড়াতে হবে। শুধু উচ্চশিক্ষায় এসে মান বাড়ালে চলবে না। প্রাথমিক-মাধ্যমিক পর্যায়ে মান বাড়ানো না গেলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং হঠাৎ করে বাড়াতে পারব না। শিক্ষা জাতির মেরুদ- কিন্তু শিক্ষার মেরুদন্ড হচ্ছে শিক্ষকরা। সেই শিক্ষকতা পেশায় মেধাবী ছেলেমেয়েদের আকর্ষণ করানো জন্যে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া দরকার তা তো দেয়া যাচ্ছে না। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, এশিয়ার মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই এর পেছনে বহু কারণ রয়েছে। এক নম্বর কারণ হচ্ছে, উচ্চশিক্ষায় আমাদের বাজেট দক্ষিণ এশিয়ায় সম্ভবত সবচেয়ে কম। আর শিক্ষা বাজেট যে ২.১ শতাংশ রয়েছে সেটিও দক্ষিণ এশিয়ার মান থেকে অনেক পিছিয়ে। আমরা যদি গবেষণায় ব্যয় বৃদ্ধি না করি, সেখানে শুধু ক্লাসের পাঠদানই র‌্যাঙ্কিংয়ে অবস্থান নিশ্চিত করতে পারে না। এটি অনেক কিছুর সমষ্টি। পাঠদানের মানের পাশাপাশি শিক্ষকদের যোগ্যতাও দেখতে হয়। শিক্ষকদের মানসম্পন্ন প্রকাশনাও থাকতে হয়। পিএইচডি কোথা থেকে করা হলো, থিসিসের বিষয়টা কী- সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। তারপর পাঠদানের মানও খুব গুরুত্বপূর্ণ। র‌্যাঙ্কিংয়ের সময় সেগুলোও বিবেচনায় আসে। তিনি সমস্যা সমাধানের দিকে নজর দিয়ে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে শক্ত করতে হবে। আমাদের ২০১০ সালে শিক্ষানীতিকে বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনটি ধারায় বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে যতটা সম্ভব একটি ধারায় নিয়ে আসতে হবে। মাদ্রাসা থাকবে কিন্তু তাদের বিজ্ঞান, কম্পিউটার শেখাতে হবে। এটি সম্ভব হলে আমাদের ফিডার সিস্টেমটা অনেক শক্ত হয়ে যাবে। তারপর আসতে হবে কলেজের শিক্ষাব্যবস্থায়। এটিকে বিলুপ্ত করে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় রাখতে হবে। সেখানে কারিগরিসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিলেক্টেড এডুকেশন দেয়া হবে। সবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার প্রয়োজন নেই। এটি শুনলে হয়তো খারাপ লাগে। কিন্তু পৃথিবীর কোথাও এমন ব্যবস্থা নেই। এছাড়াও শিক্ষকদের রাজনীতি থেকে বিমুখ হতে হবে। কঠোর ব্যবস্থার মাধ্যমে বলতে হবে যে রাজনীতি করলে চাকরি থাকবে না। রাজনীতি করলে করবেন আদর্শের রাজনীতি। এরপর যা করতে হবে তা হলো- বাজেট বাড়াতে হবে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে বলেছিলেন আমাদের শিক্ষাবাজেট জিডিপির ৪ শতাংশ হতে হবে। আমরা এখনও তা করতে পারিনি। আমাদের তো জিডিপির ৪ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করতে হবেই।
×