ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন শিল্পী ছিলেন সুবীর নন্দী’

প্রকাশিত: ০৯:৫৭, ২৩ মে ২০১৯

 ‘আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন শিল্পী ছিলেন  সুবীর নন্দী’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’, ‘কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’সহ অসংখ্য কালজয়ী গানে শ্রোতার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন নন্দিত সঙ্গীতশিল্পী সুবীর নন্দী। সবাইকে শোকে ভাসিয়ে গত ৭মে চিরবিদায় নেন একুশে পদকপ্রাপ্ত আধুনিক বাংলা গানের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী। তার প্রয়াণে কেঁদেছে অগণন ভক্তের অন্তর। সদ্যপ্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী সুবীর নন্দীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক স্মরণসভা হয় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তনে বুধবার বিকেলে। শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমীন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী, সুবীর নন্দীর একমাত্র কন্যা ফাল্গুনী নন্দী মৌ ও স্ত্রী পূরবী নন্দী, এ প্রজন্মের সঙ্গীতশিল্পী সাব্বীর, কোনাল, ইউসুফ প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করে একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। শুরুতে বক্তব্য রাখেন প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী। তিনি বলেন, আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন স্নেহের সুবীরের প্রতি শ্রদ্ধা জানতে এখানে এসেছিলাম, কিছুটা রবাহুত বলা যায়। আমি একজন অতি নগণ্য শিল্পী মনে করি নিজেকে, কিন্তু এতটা নগণ্য নই যে সুবীরের স্মরণানুষ্ঠানে একটি আমন্ত্রণপত্র আমার কাছে পৌঁছবে না। একজন শিল্পী যখন চলে যান, তখন তাকে নিয়ে আমরা অনেক অশ্রু বর্ষণ করি। কিন্তু শিল্পীরা যখন অসুস্থ কিংবা বিপদগ্রস্ত হন, তখন তার পাশে দাঁড়িয়ে সেই মহত্ত্বটুকু প্রদর্শন করি না। সুবীর নন্দী অনেক আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন শিল্পী ছিলেন। অনেক আগেই তার একুশে পদক পাওয়া উচিত ছিল। তার যোগ্যতায়ই সে এই পদক পেয়েছে। এর পেছনে আমার সামান্য অবদান ছিল। এ কারণেই সে একুশে পদক মঞ্চ থেকে নেমে আমাকে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন-তাতে লেখা ছিল হাদী ভাই আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। দেশে আরও অনেক শিল্পী অসুস্থ অবস্থায় আছেন। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক শিল্পীদের জন্য ‘শিল্পীর পাশে’ ফাউন্ডেশন করেছিলেন। এখন এটি আর্থিক দৈন্যতায় ভুগছে। সবাইকে অনুরোধ এই ফাউন্ডেশনের পাশে আপনারা দাঁড়ান। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, আজ এরকম একটা অনুষ্ঠানে আমাকে আসতে হবে আমি কল্পনাও করি নাই। সুবীর নন্দীর গান সম্পর্কে নতুন করে বলার আর কিছুই নেই। তিনি মানুষ হিসেবে যেমন ছিলেন, তেমনই সুন্দর ছিল তার গান। সুবীরের সঙ্গে আমার এত বেশি ঘটনা, এত বেশি গল্প, এত বেশি স্মৃতি আছে যা বলে শেষ করা যাবে না। প্রথম আমরা ‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবিতে ‘রহমত ভাই নামদস্তখত শিখাতে চাই’ গানটি ডুয়েট গেয়েছিলাম। তার প্রত্যেকটা গান যেন সরকারীভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। আরও যেসব বড় বড় শিল্পী চলে গেছেন, তাদের গানও যেন সংরক্ষণ করা হয়। যাতে নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা সেসব গান শুনতে পারে এবং বুঝতে পারে তাদের আগের শিল্পীরা কেমন ছিলেন। সুবীর নন্দীর একমাত্র কন্যা ফাল্গুনী নন্দী মৌ বলেন, এক মাসও হয়নি বাবা চলে গেছেন। আমার কাছে মনে হয় বাবা এখনও যায়নি, অথবা কোথাও ঘুরতে গছেন। কিন্তু একটা সময় আমার রিয়ালাইজেশন আসে যে বাবা আর আসবে না। লাগারতার ২৪ দিন সে বাঁচার জন্য লড়াই করেছে কিন্তু একটা সময় সে আর পারে নাই। সবাই আমার বাবার জন্য প্রার্থনা করবেন। আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ তাকে সব সময় মনে রাখবে। অন্যান্য বক্তরা বলেন, গুণীদের যে সমাজ সম্মান করে না, সে সমাজে গুণী তৈরি হয় না। সুবীর নন্দীর মতো আপদমস্তক একজন গুণী শিল্পীর সম্মান যদি আমরা না করি, আমাদের দেশে কখনই গুণী শিল্পীর জন্ম হবে না। এত বড় মাপের শিল্পী চলে যাওয়ায় আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে শূন্যতার সৃষ্টি হলো। এ শূন্যতা পূরণ হবার নয়। তার গায়কী, পরিমিতি বোধ এত বেশি ছিল যা কারও সঙ্গে তুলনা করা যায় না। তার তুলনা সে নিজেই। তার গানেরতো তুলনা নাই। অসাধারণ কণ্ঠ দিয়ে জয় করে নিয়েছে সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের হৃদয়। তার বিয়োগ ব্যাথায় কাঁদছে গোটা বাঙালী জাতি। তিনি শুধুমাত্র একজন সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন না, একজন ভাল মনের মানুষও ছিলেন। খুব সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা ছিল। যখন আধুনিকতার নামে সঙ্গীতাঙ্গনে যাচ্ছে তাই অবস্থা চলে, সুবীর তখন তীক্ষ্ণ হয়ে কাজ শুরু করেছেন। এ জন্য জাতি তাকে চিরদিন স্মরণ করবে। সুবীর নন্দীর মতো শিল্পী আর আসবে না। তিনি আমাদের যে গান উপহার দিয়ে গেছেন, তার মধ্যেই বেঁচে থাকবেন। আমার অনুরোধ তার গান যেন পরবর্তীতে কোন রকম বিকৃত না হয়। তিনি সব রকম পুরস্কার পেয়েছেন কিন্তু মানুষের ভালবাসাই তার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। তিনি অর্থের পেছনে না ছুটে আজীবন শিল্পের পেছনে ছুটেছেন। সত্যিকার শিল্পী বলতে যা বোঝায়, সুবীর নন্দী ছিলেন তাই। সুরের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন। এরকম শিল্পী খুব আছে। সংস্কৃতিতে তার অবদান অন্যতম। তার কালজয়ী গানের সংখ্যা অনেক। তিনি বেশ কিছু গান পরবর্তীতে করেছেন যেগুলো আজও রিলিজ হয়নি। কিভাবে এ গানগুলো রিলিজ করা যায় সে বিষয়ে সবার এগিয়ে আসা উচিত। তিনি নিজেই সুবীর নন্দী হয়ে উঠেছেন। তার তুলনা একমাত্র তিনি নিজেই। সুবীর নন্দী একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের আধুনিক গানের ইতিহাস লেখা যাবে না।
×