ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদ রিপন

সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে ‘ত্রিংশ শতাব্দী’

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ২৩ মে ২০১৯

 সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে ‘ত্রিংশ শতাব্দী’

জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ।’ সত্যিই তাই! ক্রমশ পৃথিবী যেন হয়ে পড়ছে শান্তিকামী মানুষের বসবাসের অনুপযুক্ত। ক’দিন আগে ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কার তিনটি চার্চে আর তিনটি হোটেল ভয়াবহ আত্মঘাতী সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হলো প্রায় তিনশ’ মানুষ এবং আহত হলো আরও পাঁচ শতাধিক! এর পূর্বে, নিউজিল্যান্ডের মসজিদে নিরাপরাধ মানুষের ওপর বর্বর হামলায় ৫০ জন নিহত আর আহত হলো শতাধিক। ইরাক, সিরিয়া, কুয়েত, লিবিয়া, ইয়ামেন সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আইএস চালিয়ে যাচ্ছে ধর্মের নামে নির্মম বর্বরতা। আইএসের নির্মমতার শিকার হয়ে নিষ্পাপ শিশু আইলান কুর্দিরা মরে পড়ে থাকছে তুরস্ক সাগরের তীরে। ধর্মীয় বিদ্বেষে মিয়ানমারে অগণিত রোহিঙ্গাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা আর দেশত্যাগে বাধ্য করা হলো। গুলশানের হলি আর্টিজানে এত-এত বিদেশীকে নির্মমভাবে হত্যা করল জঙ্গীরা। তারও আগে থেকেই বসনিয়া-ফিলিস্তিনে চলছে চূড়ান্ত আমানবিকতা। আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংসে প্রায় তিন হাজার সাধারণ মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু আর এর প্রতিশোধস্বরূপ আফগানিস্তানে আক্রমণ চালিয়ে যুদ্ধে সম্পৃক্ত নয় এমন হাজার হাজার বেসামরিক লোকের রক্তে গঙ্গা বইয়ে দেয়া হলো। আমাদের চোখের সামনে সমৃদ্ধ ‘মেটোপটেমিয়া’ ইরাক পরিণত হলো গোরস্তানে- এমনই সব অমানবিক ঘটনার পেক্ষাপটে সৃষ্টির সেরা জীব ‘মানুষ’ হিসেবে তবে আমাদের কর্তব্য তবে কী? চিরাচরিত সেই ‘নিজে বাঁচলেই তো বাপের নাম’, না-কি কিছু কর্তব্যও আছে সময়ের? কিছু কর্তব্যও আছে প্রতিবাদের? বিশেষত আমরা যদি হই সমাজে ‘জ্ঞান-শিক্ষা-কৌশল-কর্মের’ মিলিত শিল্পরূপের ধ্বজাধারী আর সচেতনতার মশালবাহী বলে দাবিদার- নাট্যকর্মী! অনুরূপ অনুভূতি থেকে গত ১৮ মে শনিবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটারে আয়োজন করা হলো শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে এবং হামলার শিকার হত-আহতদের উৎসর্গ করে নাট্যসংগঠন স্বপ্নদলের যুদ্ধবিরোধী গবেষণাগার প্রযোজনা ‘ত্রিংশ শতাব্দী’-র ১০৫তম মঞ্চায়ন। বাদল সরকারের মূলরচনা অবলম্বনে এ প্রযোজনার রূপান্তর ও নির্দেশনা দিয়েছি আমি। আর বর্ণিত প্রসঙ্গগুলো যৌক্তিকভাবেই উঠে এসেছে ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ নাট্যপ্রযোজনায়। পৃথিবীর ইতিহাসের বর্বরতম অধ্যায় অর্থাৎ এ পর্যন্ত যে একক ঘটনায় সবেচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছে সেটি হচ্ছে- দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধকালে ১৯৪৫-এর ৬ ও ৯ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আণবিক বোমা হামলা। এতে এ দুটি সমৃদ্ধ নগরের ধ্বংসসহ তাৎক্ষণিক ও পরবর্তী তেজস্ক্রিয়তায় মারা যায় সর্বমোট প্রায় দুই লাখ সাতচল্লিশ হাজার মানুষ! ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ নাটকের মূল প্রেক্ষাপট এই হিরোশিমা-নাগাসাকির বিষাদময় পরিণতি। এর সঙ্গেই রয়েছে পৃথিবীর সমকালীন নানা যুদ্ধ-গণহত্যা-অনাচারের প্রসঙ্গ। বাঙলা নাট্যরীতির সাযুজ্যে প্রতিটি প্রদর্শনীতেই সাম্প্রতিক নানা জরুরী প্রসঙ্গও যুক্ত হতে থাকে এ প্রযোজনায়। তাই তো নারীজন্মের অপরাধে অবিচারের প্রতীক নূসরাত-ও এ প্রদর্শনীতে উচ্চারিত হয় গুরুত্বের সঙ্গে। এভাবে দর্শকের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত হালনাগাদ ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ নাট্যের প্রত্যাশা তবে কী? প্রত্যাশা এই যে, সমকালীন বাস্তবতার সীমায় দাঁড়িয়েও যেন তারা মঙ্গলময়তার কথা ভাবতে পারেন। ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। আর যেন সকল আনাচারের বিরুদ্ধে জলন্ত ঘৃণাকে সর্বদা জাগ্রত রাখতে এবং সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিহত করতে পারেন এসব অনাচার। প্রযোজনায় যখন সকলের অন্তর্গত সুচিন্তার প্রতিনিধি ‘সুমন’ চরিত্রের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ইংরেজ কবি জন ডানের সেই বিখ্যাত চরণ- ‘মানুষ কেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। মৃত্যু আমাকে খর্ব করে। কেননা, মানবগোষ্ঠীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি আমি জড়িত। সুতরাং জিজ্ঞেস কর না, কার জন্য ওই মৃত্যুর ঘণ্টা বাজছে? সে তোমার জন্য!’ তখন অনুভূতিতে একাত্ম দর্শক যেন কাল-ভূগোলের সীমা অতিক্রম করে সমগ্র মানবজাতির প্রতিনিধি কিংবা এক বিশ^মানব হয়ে ওঠেন! মনে পড়ে, ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ প্রযোজনাটি ২০১৫-এ এশিয়ার বৃহত্তম ও ভারতের রাষ্ট্রীয় নাট্যোৎসব ‘১৭তম ভারত রং মহোৎসব’-এ আমন্ত্রিত হয়ে দিল্লীর ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এনএসডি)-তে প্রদর্শিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ভারতে আরও নানা গুরুত্বপূর্ণ উৎসবে মঞ্চায়িত হয়েছে স্বপ্নদলের এ প্রযোজনা। ২০১৫-এ ইউরোপের স্বনামখ্যাত নাট্যোৎসব ‘১৩তম এ সিজন অব বাঙলা ড্রামা’-য় ইংল্যান্ডের লন্ডনে ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ প্রযোজনার দুটি প্রদর্শনী এবং কুইন মারি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ড্রামা ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে আমার মাস্টারক্লাস পরিচালনার অংশ হিসেবে প্রযোজনাটির আংশিক উপস্থাপিত হয়। ২০১৮-এর নবেম্বরে জাপানের সর্ববৃহৎ নাট্যোৎসব ‘ফেস্টিভ্যাল/টোকিও ২০১৮’-এর আমন্ত্রণে বিখ্যাত টোকিও মেট্রোপলিটন থিয়েটারে ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ প্রযোজনার দুটি ব্যাপক প্রশংসিত প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। উল্লিখিত দেশগুলোর মধ্যে ইংল্যান্ড ও ভারত পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। সুতরাং তাদের সামনে পারমাণবিক শক্তি সঞ্চয়ের প্রশ্নে তাদের নেতিবাচক সমালোচনা ছিল সত্যিই দৃঢ়তার বিষয়। স্বপ্নদলের ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ হয়ত সে বাণীরই এক প্রামাণ্যরূপ। আমরা বাংলাদেশই বিশ্বকে শান্তির পথ দেখাতে চাই।’ বলাবাহুল্য, ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ প্রযোজনাটি যে দেশে-বিদেশে উচ্চপ্রকৃতিক প্রশংসা অর্জনে সক্ষম হয়েছে তার অন্যতম কারণ প্রযোজনার বিষয়বস্তুর সঙ্গে এর উপস্থাপনরীতির সুসমন্বয়। এ প্রযোজনায় প্রযুক্ত হয়েছে ঐতিহ্যের ধারায় আধুনিক ‘বাঙলা নাট্যরীতি’, যা একইসঙ্গে দেশে-বিদেশে উচ্চে তুলে ধরেছে বাঙালীর সহস্র বছরের নিজস্ব নাট্যরীতির স্বকীয়তা এবং সামর্থ্য। বর্তমান পৃথিবীতে আমেরিকা-রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যে প্রায় সাড়ে পনেরো হাজারের মতো পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ আছে তা দিয়ে আমাদের প্রিয় সবুজ-কোমল এ গ্রহটিকে তো অন্তত আটাশ থেকে আটত্রিশবার পর্যন্ত ধ্বংস করা সম্ভব! সুতরাং পৃথিবীতে বাঁচাতে হলে সকল ‘ধ্বংসের আয়োজন’-কে বিনাশ করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। তাই যুদ্ধ-অনাচার-জঙ্গীবাদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে আমাদের কণ্ঠ উচ্চকিত রাখতে হবে অনুক্ষণ। পরিশেষে বলা যায়, ‘বিশ্বগ্রাম’ ধারণার এ সমকালে শ্রীলঙ্কার মতো আরও যেখানেই অনাচার ঘটুক না কেন আমাদের তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হতে হবে। সোচ্চার হতে হবে পথে এবং মঞ্চে!
×