ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা অনুমোদন;###;চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৭ দশমিক ১৮ শতাংশ বেশি ষ স্থানীয় সরকার বিভাগকে সর্বোচ্চ বরাদ্দ;###;প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণ খোঁজার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

রেকর্ড এডিপি ॥ আগামী অর্থ বছরের উন্নয়ন বাজেট

প্রকাশিত: ১১:১৯, ২২ মে ২০১৯

রেকর্ড এডিপি ॥ আগামী অর্থ বছরের উন্নয়ন বাজেট

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আগামী অর্থবছরের (২০১৯-২০২০) জন্য উন্নয়ন বাজেটে প্রথমবারের মতো রেকর্ড ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) অনুমোদন করা হয়েছে। এর আগে এত বেশি এডিপির অনুমোদন দেয়া হয়নি। সে হিসেবে এটি রেকর্ড। স্থানীয় সরকার বিভাগকে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে আগামী অর্থবছরের এডিপির আকার চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৭ দশমিক ১৮ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা কর্পোরেশনের প্রায় ১২ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকার এডিপিও অনুমোদন দেয়া হয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট বা এডিপি অনুমোদন করেছিল সরকার। সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নসহ এ বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১৮০ হাজার কোটি টাকা। মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেন এনইসি চেয়ারপার্সন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতির কারণ খুঁজতে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা সচিব নুরুল আমিন এবং তথ্য ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, এটি রেকর্ড এডিপি অনুমোদন। এবারই প্রথম দুই লাখ কোটি টাকার ওপরে এডিপি অনুমোদন হলো। অনুমোদিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকার মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা রয়েছে। আর স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বা কর্পোরেশনের ১২ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকার মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস ৭ হাজার ৮২ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উৎস ৫ হাজার ৩১০ কোটি টাকা রয়েছে। সুতরাং মোট ১ হাজার ৫৬৪ প্রকল্পের উন্নয়ন সহায়তাসহ এডিপির সর্বমোট আকার দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। জানা গেছে, বাংলাদেশের উন্নয়ন রূপকল্প-২০২১, ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ (এসডিজি) বিদ্যমান বিভিন্ন নীতিমালার আলোকে অগ্রাধিকার খাতসমূহে পর্যাপ্ত সম্পদ বরাদ্দ প্রদানের মাধ্যমে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়াও উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন, দারিদ্র্য হ্রাস তথা জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ইত্যাদিসহ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একুশ শতকের উপযোগী একটি উন্নত দেশ করার লক্ষ্য সামনে রেখে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী প্রণয়ন করা হয়। মন্ত্রণালয় জানিয়েছেন, এডিপিতে দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পসমূহকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় রেখে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর সফল বাস্তবায়ন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন তথা দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এদিকে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পে প্রকাশিত দুর্নীতি বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বিষয়টি নজরে রাখা হয়েছে। বিষয়টি দেখে আমি এক্সসাইটেড। প্রকল্পে ৩ টাকার বালিশ তুলতে পাঁচ টাকা হলো কেন? বিষয়টি তদন্ত করতে রূপপুরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরীবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) টিম পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পের কেনাকাটায় নিয়ে দুইটা তদন্ত চলছে। একটা পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট (পিডাব্লিউডি) অন্যটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। আমরাও আইএমইডিকে দিয়ে তদন্ত করাব। রূপপুরে টিম যাবে। এই টিম কি তথ্য দেয়া তা প্রধানমন্ত্রীকে অবগত করা হবে। এর পরেই আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারব। পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, উন্নয়ন থেমে থাকবে না। দেশের উন্নয়ন চলবে। আমাদের দেশের সকল উন্নয়ন ধরে রাখব। এডিপি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে বরাদ্দ রয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। সে তুলনায় নতুন অর্থবছরের এডিপির আকার বাড়ছে ১৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। এছাড়া মাঝ পথে এ অর্থবছরের বরাদ্দ কমিয়ে সংশোধিত এডিপিতে ধরা হয় ১ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপির তুলনায় নতুন এডিপিতে বরাদ্দ বাড়ছে ২১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। নতুন এডিপিতে পদ্মা সেতু ও পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগসহ গুরুত্ব বিবেচনায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে পরিবহন খাতে। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের হিসাবে সর্বোচ্চ ২৯ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগে। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানান, চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন (জুলাই-থেকে) ৫৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এ সময়ে ব্যয় হয়েছিল ৯৭ হাজার ৩০ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে বাস্তবায়ন হয়েছে ৫২ দশমিক ৪২ শতাংশ, ওই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ৮২ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। অন্যান্য মন্ত্রণালয় বাড়তি বরাদ্দ চেয়েছে কি এমন প্রশ্নের জবাবে এম এ মান্নান বলেন, অন্য কোন মন্ত্রণালয় বাড়তি বরাদ্দ চাইলে টাকার কোন সমস্যা নেই। কোন মন্ত্রণালয় বাড়তি চাহিদার কথা আমাদের বোঝাতে পারলে বাড়তি বরাদ্দ দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের গবেষণা ও পাটে বিশেষ নজর দিতে বলেছেন। আমরা এই দুটা বিষয়ের উন্নয়নে কাজ করব। কিছু কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণ খুঁজতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আগামী অর্থবছরের জন্য খাতভিত্তিক বরাদ্দের সর্বোচ্চ বরাদ্দ ধরা হয়েছে পরিবহন খাতে। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পদ্মা সেতু ও পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় পরিবহন খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ৫২ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা, যা মোট এডিপির ২৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। এছাড়া, অগ্রাধিকার খাত বিবেচনায় বিদ্যুত খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২৬ হাজার ১৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা, যা মোট এডিপির ১২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ন খাতে তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা, যা মোট এডিপির ১২ শতাংশ। এছাড়া, পর্যায়ক্রমে অন্যান্য খাতের বরাদ্দ হচ্ছে শিক্ষার প্রসার ও গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিক্ষা ও ধর্ম খাতে চতুর্থ সর্বোচ্চ বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৩৭৯ কোটি ১২ লাখ টাকা, যা মোট এডিপির ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণসহ তথ্য ও প্রযুক্তি প্রসারের লক্ষ্যে বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে পঞ্চম সর্বোচ্চ বরাদ্দ ১৭ হাজার ৫৪১ কোটি ২৬ লাখ টাকা, যা মোট এডিপির ৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ। গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনা ও অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান খাতে ১৫ হাজার ১৫৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা বা ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ বরাদ্দ ধরা হয়েছে। এছাড়াও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ১৩ হাজার ৫৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বা ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে কৃষি খাতে ৭ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ বরাদ্দ ধরা হয়েছে। নদী ভাঙ্গন রোধ ও নদীর ব্যবস্থাপনার জন্য পানি সম্পদ খাতে ৫ হাজার ৬৫২ কোটি ৯০ লাখ টাকা বা ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ বরাদ্দ ধরা হচ্ছে এবং মানব সম্পদ উন্নয়নসহ দক্ষতা বৃদ্ধিতে গতিশীলতা আনতে জনপ্রশাসন খাতে ৫ হাজার ২৪ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে, স্থানীয় সরকার বিভাগ ২৯ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বিদ্যুত বিভাগ ২৬ হাজার ১৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ২৫ হাজার ১৬৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এছাড়া, পর্যায়ক্রমে বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রথম ১০ নম্বরে থাকা মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হচ্ছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ১৫ হাজার ৯০৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, রেলপথ মন্ত্রণালয় ১২ হাজার ৫৯৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ৯ হাজার ৯৩৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ৯ হাজার ২৭০ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ ৮ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা, সেতু বিভাগ ৮ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ৬ হাজার ২৫৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা খসড়া বরাদ্দ ধরা হয়েছে। নতুন এডিপিতে মোট প্রকল্প সংখ্যা রয়েছে ১ হাজার ৫৬৪টি। এর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প রয়েছে ১ হাজার ৩৫৮, কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ১১৬, জেডিসিএফ প্রকল্প একটি এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নিজস্ব প্রকল্প রয়েছে ৮৯টি। অন্যদিকে সমাপ্তর জন্য নির্ধারিত প্রকল্প ধরা হয়েছে ৩৫৫টি। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) প্রকল্প ৬২। বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তির সুবিধার্থে বরাদ্দহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্প ২৪২ এবং বরাদ্দহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্প রয়েছে ১ হাজার ৪৫টি। এছাড়া, বরাদ্দসহ অনুমোদিত নতুন প্রকল্প রয়েছে ৪১টি। এডিপি’র বিভিন্ন প্রকল্প প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, প্রকল্পের নামে অহেতুক ও অতিরিক্ত জমি নেয়া যাবে না। ফসলি জমিতে হাত দেয়া যাবে না। যেসব প্রকল্প সমাপ্ত হচ্ছে না, সেগুলো কেন হচ্ছে না প্রধানমন্ত্রী তা খতিয়ে দেখতে বলেছেন। প্রয়োজনে সহায়তা দিয়ে হলেও শেষ করার ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।
×