ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দিনে মহাসড়কে একটি করে পণ্যবাহী যান ছিনতাই

প্রকাশিত: ০৯:৪৭, ২১ মে ২০১৯

 দিনে মহাসড়কে একটি  করে পণ্যবাহী যান ছিনতাই

গাফফার খান চৌধুরী ॥ মহাসড়কে পণ্য বোঝাই গাড়ি ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। অভিযানে শ্রীমঙ্গল থেকে চা পাতাসহ পণ্যবাহী গাড়ি ছিনতাই করে আনার সময় ঢাকায় র‌্যাবের সঙ্গে গোলাগুলিতে দুই ছিনতাইকারীর মৃত্যু হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে ছিনতাই করা মালপত্র। ঈদ সামনে রেখে মহাসড়কে পণ্যবাহী ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এজন্য ঈদ সামনে রেখে মহাসড়কে পণ্যবাহী যানবাহন ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারে অভিযানের তীব্রতাও বাড়ানো হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশের পরিসংখ্যান মোতাবেক প্রতিদিন মহাসড়কে গড়ে অন্তত একটি করে পণ্যবাহী যানবাহন ছিনতাই হয়। বেহাল মহাসড়ক আর হাইওয়ে পুলিশের দ্রুতগতির যানবাহন না থাকার কারণে অধিকাংশ ছিনতাইকারী ধরা পড়ে না। সারাদেশের মহাসড়কে পণ্যবাহী যানবাহন ছিনতাইকারী চক্রের দশটি গ্রুপ জড়িত। ছিনতাইকারী গ্রুপগুলোর প্রধান টার্গেট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ১১ হাজার ৮০৬ কিলোমিটার মহাসড়কে অপরাধপ্রবণ স্পটের সংখ্যা দুই শতাধিক। এসব স্পটে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও হাইওয়ে ডাকাত বা ছিনতাইকারীদের রোধ করা যাচ্ছে না। কারণ হাইওয়ের সঙ্গে ছোট ছোট অনেক লিংক রোড আছে। প্রতিটি লিংক রোডে পাহারা বসানোর মতো পর্যাপ্ত পুলিশ নেই। এই সুযোগটিকেই কাজে লাগায় ডাকাত ও ছিনতাইকারীরা। পুলিশ অপরাধপ্রবণ এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করলে ছিনতাইকারীরা নতুন জায়গা বেছে নেয়। তারা রাতের আঁধারে রাস্তায় গাছ ফেলে পণ্যবাহী যানবাহন ছিনতাই করে। অনেক সময় এসব ছিনতাইয়ের সঙ্গে পণ্যবাহী যানবাহনের চালক ও হেলপাররাও জড়িত থাকে। ডাকাতি বা ছিনতাই হওয়ার খবর পাওয়ার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই ছিনতাইকারীরা অন্য রাস্তা ধরে পালিয়ে যায়। হাইওয়ে পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠের কাছে রীতিমতো ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, পুলিশের হাইওয়ে বিভাগটি চলছে আল্লাহ্র ওয়াস্তে। রাতে বা দিনে নিরাপত্তা টহল দেয়ার জন্য হাইওয়ে পুলিশের বেশিরভাগ থানায় প্রয়োজনীয় যানবাহন নেই। যা আছে তার অধিকাংশই নষ্ট। বছরের পর বছর এসব পিকআপকে মেরামত কারখানাগুলোতে বসবাস করতে হয়। পিকআপগুলোর গতি দেখলে হাসি পায়। সারাদেশে মহাসড়কে অন্তত ১০টি ছিনতাইকারী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। ছিনতাইকারী গ্রুপগুলোর প্রধান টার্গেট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। সারাদেশের মহাসড়কে প্রতিদিন গড়ে অন্তত একটি পণ্যবাহী যানবাহন ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে। নিত্য ব্যবহার্য পণ্য ছাড়াও গার্মেন্টস সামগ্রী ছিনতাইকারীদের প্রধান টার্গেট। তেল, চিনি, লবণ, চাল, ডাল, আটা, সার, কাপড়, মসল্লা, গার্মেন্টস সামগ্রী ছাড়াও অন্যান্য দামী মালামালও ছিনতাইকারীদের টার্গেট। তিনি আরও জানান, ছিনতাইকারীদের প্রতি গ্রুপে ন্যূনতম ৮ থেকে শুরু করে ১০ জন পর্যন্ত থাকে। ছিনতাইকারী দলে থাকে দক্ষ চালক, হেলপার, শ্রমিক, যানবাহন মেরামত করার কারিগর। ছিনতাইকারীরা খালি ট্রাক নিয়ে টার্গেটকৃত মালামাল বোঝাই যানবাহনটিকে প্রথমে টার্গেট করে তার পিছু নেয়। ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত অধিকাংশ যানবাহনের নম্বর প্লেটই ভুয়া। ছিনতাইকারীরা খালি ট্রাকটি আচমকা মালামাল বোঝাই যানবাহনটির সামনে নিয়ে বেরিকেড দেয়। বাধ্য হয়ে মালামাল বোঝাই যানবাহন থামায়। এরপর ধারালো অস্ত্রের মুখে বা নেশা জাতীয় বা অজ্ঞান করার ওষুধ নাকের কাছে ধরে মালামাল বোঝাই ট্রাকের সবাইকে অজ্ঞান করে ফেলে। কোন কোন সময় মালামাল বোঝাই যানবাহনের সবাইকে হত্যা করে ফেলা হয় বা যানবাহন থেকে বাইরে ফেলে দেয়া হয়। এরপর ছিনতাইকারীরা মালসহ ছিনতাইকৃত যানবাহনটি চালিয়েই অনেক সময় পালিয়ে যায়। এক্ষেত্রে ছিনতাইকারীরা এতই বেপরোয়া যে পুলিশ বা অন্য কোন যানবাহন তাদের পিছু নিলে তাদের চাপা দিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়। অনেক সময় ছিনতাইকারীরা সুবিধাজনক জায়গায় নিয়ে ছিনতাইকৃত যানবাহন থেকে মালামাল নিজেদের যানবাহনে উঠিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। এতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। খালি ট্রাকটি রাস্তার মাঝ বরাবর রেখে দেয়। যাতে রাস্তায় যানজট লেগে যায়। গাড়িটি সরিয়ে মহাসড়ক চলাচলের উপযোগী করতে করতেই ছিনতাইকারীরা পালিয়ে যায়। ঈদকে সামনে রেখে মালামালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে মহাসড়কে ছিনতাই বেড়ে যায়। ছিনতাইকারীদের যানবাহনের গতির কাছে হাইওয়ে পুলিশের যানবাহনের গতি সত্যিই হাস্যকর। ছিনতাইকারীরা দ্রুতগতির ট্রাক দিয়ে পণ্যবাহী যানবাহন ছিনতাই করে ছিনতাইকৃত যানবাহনসহ দ্রুত পালিয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে হাইওয়ে পুলিশ পিছু নিলেও কোন লাভ হয় না। কারণ হাইওয়ে পুলিশের যানবাহন সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগে যেতে সক্ষম, সেখানে ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত যানবাহন ঘণ্টায় ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার বা তারও বেশি গতিতে যেতে সক্ষম। এসব ক্ষেত্রে কোন পণ্যবাহী যানবাহন ছিনতাই হওয়ার পর হাইওয়ে পুলিশের দাঁড়িয়ে দেখা ব্যতীত তেমন কোন কাজ থাকে না। ছিনতাইকারী ঘন ঘন ছিনতাইয়ের স্পট বদল করায় মহাসড়কে ছিনতাইরোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে মহাসড়কজুড়ে নিরাপত্তা টহল দেয়া সম্ভব হয় না। এছাড়াও জেলা পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশের মধ্যে ঠেলা ধাক্কা আছে। চলতি বছর মহাসড়কে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে প্রায় দেড়শ’টি। এবার মহাসড়কের ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশ, জেলা পুলিশ ও র‌্যাবের সমন্বয়ে এমন অভিযান চলছে। র‌্যাব জানায় সেই অভিযানের ধারাবাহিকতায় সোমবার ভোর পৌনে চারটার দিকে হাজারীবাগের মধুসিটির সামনে পণ্যবাহী গাড়ি ছিনতাইকারীদের সঙ্গে র‌্যাব-২ এর গোলাগুলি হয়। গোলাগুলিতে মনির (৪৫) ও গিয়াস (৩৩) নামে দুই ছিনতাইকারী নিহত হয়েছে। র‌্যাব-২ এর কোম্পানি কমান্ডার পুলিশ সুপার (এসপি) মুহাম্মদ মহিউদ্দিন ফারুকী জানান, নিহতরা শ্রীমঙ্গল থেকে চা-পাতা ভর্তি কাভার্ডভ্যান ছিনতাই করে পালিয়ে ঢাকায় আসছিল। গাড়িটিতে অন্তত ৮ থেকে ৯ টন চা-পাতাসহ কাভার্ডভ্যানটি ছিনতাই করেছিল তারা। কাভার্ডভ্যানটিকে থামানোর চেষ্টা করলে কাভার্ডভ্যান থেকে তারা র‌্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। র‌্যাবও পাল্টা গুলি করলে ছিনতাইকারী চক্রের দুই সদস্য মারা যায়। গোলাগুলিতে র‌্যাবের দুইজন সহকারী উপ-পরিদর্শকও (এএসআই) আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে চা-পাতা ভর্তি ছিনতাইকৃত কাভার্ডভ্যানসহ বিদেশী পিস্তল ও কয়েক রাউন্ড গুলি উদ্ধার হয়েছে। শ্রীমঙ্গল পুলিশের বরাত দিয়ে র‌্যাব জানায়, নিহত মনির মহাসড়কের পণ্যবাহী যানবাহন ছিনতাইকারী চক্রের পেশাদার সদস্য। তার বিরুদ্ধে ছিনতাইসহ ২১টি বিভিন্ন মামলা আছে। মনির মহাসড়কে পণ্যবাহী ছিনতাইকারীদের একটি চক্রের মূল হোতা ছিল। তার প্রধান কাজই ছিল চা-পাতা ভর্তি বা গার্মেন্টস মালামাল ভর্তি কাভার্ডভ্যান ছিনতাই করা। নিহত গিয়াস ছিনতাইকারী চক্রের চালক ছিল। সে ছিনতাই করা যানবাহন চালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতো। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, হাইওয়েতে একাধিক ছিনতাইকারী চক্র তৎপর। ঈদের সময় মহাসড়কে বেশি পণ্য আনা নেয়া হওয়ার কারণে তারা এই সময়টিতে বেশি তৎপর হয়। তাদের প্রধান টার্গেট দামী মালামাল। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কই তাদের টার্গেট। আর টার্গেটের ক্ষেত্রে তারা সবার আগে প্রাধান্য দেয় গার্মেন্টস মালামালকে। দেশের বিভিন্ন জায়গার মহাসড়কে ছিনতাই হওয়া মালামাল বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। যেমন ঢাকার মালামাল চট্টগ্রামে আবার চট্টগ্রামের মালামাল ঢাকা বা অন্য জেলা শহরে চলে যায়। এর সঙ্গে বিশাল একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটও জড়িত। যারা এসব চোরাই বা ছিনতাই হওয়া মালামাল বেশি লাভের আশায় কিনে থাকে। মহাসড়কে এ ধরনের ছিনতাইরোধে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। ঈদকে সামনে রেখে অভিযানের তীব্রতা আরও বাড়ানো হবে।
×