ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে আইন হচ্ছে- দেশে প্রথম

প্রকাশিত: ০৯:৪৫, ২১ মে ২০১৯

 সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে আইন হচ্ছে- দেশে প্রথম

তপন বিশ্বাস ॥ কোন ব্যক্তি একাধিক সরকারী সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা পাবেন না। জনগণের দারিদ্র্য স্কোরভিত্তিক খানা জরিপের ফলের ভিত্তিতে জাতীয় কমিটি সুবিধাভোগী নির্বাচন করতে পারবে। দারিদ্র্যের স্কোর বিষয়ক কোন আপীল বা অভিযোগ থাকলে তা স্থানীয় ইউনিয়ন বা উপজেলা কমিটি যাচাই করে ব্যবস্থা নেবে। মিথ্যা তথ্য প্রদানকারীর বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রেখে সামাজিক নিরাপত্তা আইন-১৯ করতে যাচ্ছে সরকার। এটি বাংলাদেশে এ বিষয়ে প্রথম আইন। আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধা উপকারভোগীর কাছে ডিজিটাল পদ্ধতি মোবাইলে, পোস্টাল ক্যাশ কার্ডে, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে কিংবা অন্য কোন উপায়ে পৌঁছে দেয়া হবে। কোন ব্যক্তি মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত সুবিধা নিলে, অন্য কোন ব্যক্তিকে মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে ভাতা বা সুবিধা পেতে সহযোগিতা করলে, অন্যায়ভাবে কোন যোগ্যব্যক্তিকে সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা বা ভাতা পেতে বাধা দিলে, সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা বা সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য উৎকোচ দাবি করলে কিংবা সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর, সংস্থার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে গাফলতি দেখালে তিনি ৬ মাসের জেল ও দশ হাজার টাকা অর্থদ- অথবা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। উল্লেখিত বিধিবিধান রেখে সামাজিক নিরাপত্তা আইন নামে একটি আইন প্রণয়ন করছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এটি সামাজিক নিরাপত্তা আইন-১৯ নামে অভিহিত হবে। আইনটির ওপর ইতোমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মতামত নেয়া হয়েছে। খসড়া আইনে বলা হয়েছে অন্যান্য আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন এই আইনের আওতায় অপরাধ সংঘটিত হলে মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯-এর অধীন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে বিচার কাজ সম্পাদন করা হবে। তবে এই আইনের অধীনে দেয়া শাস্তির বিরুদ্ধে দেশে প্রচলিত বিধান মোতাবেক উর্ধতন আদালতে আপীল দায়ের করা যাবে। চলতি অর্থবছর দেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় ২৩ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। অবশ্য এই কার্যক্রম সংক্রান্ত এটিই প্রথম আইন বলে জানিয়েছেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থেকে গরিব মানুষের জন্য নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হলেও এই সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোন আইন নেই, সামাজিক নিরাপত্তা আইন ২০১৯ হচ্ছে এই সংক্রান্ত আইন যা এখনও খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন ও তত্ত্বাবধানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা পরিষদ নামে একটি পরিষদ গঠন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও ওই কমিটিতে সাত মন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সমন্বয়ক (এডিজি বিষয়ক), প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, সচিব সমন্বয় ও সংস্কার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, অর্থ সচিব এবং সমাজকল্যাণ সচিব থাকবেন। সামাজিক নিরাপত্তার সেবা ও ভাতা বিতরণ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা, সামাজিক নিরাপত্তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে অগ্রগতি মূল্যায়ন, দুর্বলতা চিহ্নিত করা, ত্রুটি সংশোধন, পরিমার্জনের নির্দেশনা দেয়া, বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থাকে সামাজিক নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করাই হবে জাতীয় কমিটির কাজ। আইনের অধীনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি (সিএমসিএসএস) থাকবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছাড়াও কমিটিতে ৩৪ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবরা দায়িত্ব পালন করবেন। এই কমিটি বছরে দুটি সভা করবে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে যুগ্মসচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা সামাজিক নিরাপত্তার ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবেন। বিষয়ভিত্তিক ক্লাস্টার গঠন ॥ সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে দক্ষতা বাড়াতে বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পারস্পরিক সহযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য কার্যক্রমের সাদৃশ্যের ওপর ভিত্তি করে মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহের সমন্বয়ে পাঁচটি বিষয়ভিত্তিক ক্লাস্টার গঠন করা হবে। সামাজিক ভাতা ক্লাস্টার, খাদ্য নিরাপত্তা ও দুর্যোগ সহায়তা ক্লাস্টার, সামাজিক নিরাপত্তা ক্লাস্টার, শ্রম ও জীবিকায়ন ক্লাস্টার, মানব উন্নয়ন ও সামাজিক ক্ষমতায়ন ক্লাস্টার। ক্লাস্টারসমূহ প্রতি তিনমাস অন্তর একটি সভা করে সভার কার্যবিবরণী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাবে। যেসব মন্ত্রণালয় থেকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ভাতা দেয়া হয় সে সব মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের সমন্বয়ে গঠিত হবে ভাতাভিত্তিক ক্লাস্টার। এই ক্লাস্টারের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এই ক্লাস্টারের আওতায় সমাজকল্যাণ, মহিলা ও শিশু, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এই আইনের আওতায় কর্মক্ষম জ্যেষ্ঠ মানুষের জন্য বার্ধক্য পেনশন সুবিধা থাকবে। থাকবে বেকারদের জন্য বেকারভাতা, স্বাস্থ্যবীমা, দুর্ঘটনা, পঙ্গুত্ব, মাতৃত্বকালীন ঝুঁকির জন্য থাকবে সামাজিক বীমার আইনী কাঠামো। গড়ে তোলা হবে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো এবং পরিচালনা ব্যবস্থা পরীবীক্ষণ ব্যবস্থা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এই ক্লাস্টারের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ বিভাগ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এই আইন কার্যকরের পরপরই সামাজিক বীমা ব্যবস্থা চালুর জন্য সরকারী গেজেট জারি করে একটি জাতীয় সামাজিক বীমা কর্তৃপক্ষ নামে একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। খসড়া আইনে বলা হয়েছে ॥ সবসময় মানুষের জন্য গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্যের পর্যাপ্ত উৎপাদন ও জোগান নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ বিষয়ক সামাজিক নিরাপত্তা ক্লাস্টারে খাদ্য মন্ত্রণালয় হবে ক্লাস্টার প্রধান সমন্বয়ক। খাদ্য মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, কৃষি মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। শ্রম ও জীবিকায় ক্লাস্টারের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এছাড়া, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। মানব সম্পদ উন্নয়ন ও সামাজিক ক্ষমতায়ন ক্লাস্টারের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং যুব ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। প্রশাসনিক বিভাগে বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে বিভাগীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি, জেলা পর্যায়ে ডিসির নেতৃত্বে জেলা ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং উপজেলা পর্যায়ে ইউএনওর নেতৃত্বে উপজেলা ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকবে। উপজেলা ব্যবস্থাপনা কমিটি অতিবৃদ্ধ, দুস্থ ও দরিদ্র মানুষকে তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সামাজিক নিরাপত্তার স্থানীয় তহবিল থেকে বা অন্য কোন নিয়মিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত এনজিও সুশীল সমাজের কার্যকর সমন্বয় ও সহযোগিতার আনুষ্ঠানিক প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য ৩০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হবে। কমিটির প্রধান হবেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) দেশের সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধাভোগী বা প্রত্যাশীদের অভিন্ন পরিচিতি নম্বর বা ইউআইডি থাকবে। থাকবে দারিদ্র্য স্কোর ও অন্যান্য মৌলিক উপাত্তের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল তথ্যভা-ার। অন্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন এই আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই আইনের বিধানাবলী প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে।
×