ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন বাজেটে বাড়ছে করের আওতা

প্রকাশিত: ০৮:৩১, ২১ মে ২০১৯

নতুন বাজেটে বাড়ছে করের আওতা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে করের আওতা বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে করের হার না বাড়িয়ে কর দাতার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বিশেষ দিক নির্দেশনা থাকছে। অর্থাৎ নিয়মিত করদাতাদের ওপর বোঝা না বাড়িয়ে নতুন নতুন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে সরকার। জানা যায়, ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতার সংখ্যা বাড়িয়ে এক কোটিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য নেয়া হচ্ছে ব্যাপক পরিকল্পনা। পরিকল্পনার আওতায় কর আদায়যোগ্য মানুষ খুঁজে বের করতে সারাদেশে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর জন্য ১০ হাজার জনবল নিয়োগ দেয়া হবে। এতে শুধু রাজধানী ঢাকা শহর থেকেই ৪০ লাখ নতুন করদাতা খুঁজে বের করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া কর আদায় বাড়াতে জেলা-উপজেলায় স্থাপন করা হবে অফিস। বাজেট বক্তৃতায় এ বিষয়ে বিস্তারিত বলবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে ভ্যাট খাতকে। ভ্যাটের পরই রয়েছে আয়কর খাত। এনবিআরের এবারের মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভ্যাট থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। আর আয়কর থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এক লাখ দুই হাজার ২০১ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ খাতকে আরও প্রাধান্য দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। তাই আগামী অর্থবছরের মধ্যে এক কোটি মানুষকে করের আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। পরিকল্পনা মতে, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আয়কর আদায় বাড়ানো হবে। এর জন্য ১০ হাজার জনবল নিয়োগ দেয়া হবে। সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া এই জনবলের প্রায় সবাই হবে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী। তাদের প্রধান কাজ হবে আয়কর আদায়যোগ্য মানুষ খুঁজে বের করা। অনেকটা খানা জরিপের মতো তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবারভিত্তিক সদস্যদের আয়ের উপাত্ত সংগ্রহ করবে। পরে এই উপাত্তগুলো আয়কর অফিসে জমা দেয়া হবে। এর ওপর ভিত্তি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আয়কর আদায়যোগ্যদের আয়করের আওতায় নিয়ে আসবে। নতুন জরিপের মাধ্যমে শুধু ঢাকা শহর থেকে ৩০ থেকে ৪০ লাখ নতুন আয়কর দাতা খুঁজে বের করা হবে। এর বাইরে বিভাগীয় শহর, জেলা ও উপজেলা থেকে আরও ৬০ লাখ সম্ভাব্য করদাতার খোঁজ সংগ্রহ করা হবে। এর জন্য কিছুসংখ্যক জেলা-উপজেলায় অফিস স্থাপন করা হবে। পরে পুরো দেশে এসব অফিস স্থাপন করা হবে। এসব অফিস থেকেই আয়কর আদায় ও আয়করযোগ্যদের খুঁজে বের করার কাজ পরিচালিত হবে। গত বুধবার সাবেক গবর্নরদের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশে চার কোটি মানুষ আয়কর দেয়ার উপযুক্ত; কিন্তু কর দিচ্ছে না। তাদের যদি আমরা আস্তে আস্তে কর নেটের আওতায় নিয়ে আসতে পারি তাহলে আমাদের রাজস্ব আহরণ অনেক বাড়বে। আগামী এক বছরে এক কোটি মানুষকে করের আওতায় নিয়ে আসা আমাদের লক্ষ্য।’ এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, আগামী বাজেটে করযোগ্য সবাইকে করের আওতায় নিয়ে আসা হবে। করের হার কমিয়ে আওতা বাড়ানো হবে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ কর দেয়, এই অভিযোগ আর থাকবে না। তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরে ৩ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা কর আহরণ করা হবে। এদেশে মুষ্টিমেয় যারা কর দেন তাদের দুর্ভাগ্য। কিন্তু আরও অনেক মানুষ আছেন যারা কর দেয়ার যোগ্য কিন্তু দিচ্ছেন না, তাদেরও করের আওতায় আনা হবে। এবার বাজেটে ভ্যাট, ট্যাক্স ও কাস্টমসেও সংস্কার আনা হবে বলেও তিনি জানান। এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, এবারের বাজেট হবে সবচেয়ে বড় বাজেট। বাজেটের খরচের ৬৫ শতাংশ রাজস্ব আহরণ করা হবে। এটা উচ্চাবিলাসী বলা হলেও আমরা চেষ্টা করছি বাস্তবায়ন করতে। তিনি বলেন, আগামী অর্থবছর অবশ্যই ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা হবে। এটি বাস্তবায়নে কোন সমস্যা হবে না। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। ফলে, ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে কোন সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, বাজেটের আওতা বাড়ানো আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ নিতে আমরা প্রস্তুত। করের আওতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কোন ক্ষতি হবে না। তবে, দেশীয় শিল্পের সহযোগিতার জন্য বর্তমানে যে সুযোগ সুবিধা চালু আছে তা অব্যাহত রাখা হবে। পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত সাত বছর ধরে বাংলাদেশে ট্যাক্স জিডিপির রেশিও একটুও বাড়েনি। অথচ একই সময়ে ভারতে ট্যাক্স জিডিপির রেশিও বেড়েছে ৪০ শতাংশ। তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা ভ্যাট ট্যাক্স আহরণে পিছিয়ে পড়েছি। তাই এ ক্ষেত্রে করের আওতা বাড়ানোর জন্য বিশেষ নজর দিতে হবে। দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা ৩৬ লাখের কাছাকাছি। এটি মোট জনসংখ্যার এক শতাংশেরও কম। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে দেশে আয়কর দেয়ার যোগ্য মানুষের সংখ্যা রয়েছে ১ কোটির বেশি। এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে আয়করের আওতায় নিয়ে আসা হলে নিয়মিত করদাতাদের ওপর বাড়তি চাপ কমবে। অন্যদিকে, আয়কর দেয়ার যোগ্য মানুষকে করের আওতায় আনতে না পারলে পুরনো করদাতারা কর দেয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে এবং তারা কর ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করবে। আবার নতুন যারা কর দেয়ার সামর্থ অর্জন করেছেন তারাও ভয়ে এর আওতায় আসতে চাইবেন না। ফলে, ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আগামী বাজেটে কর আদায় ব্যবস্থা সহজীকরণ ও আওতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। কর্পোরেট কর ॥ চলতি অর্থবছরে কর্পোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। আগামী অর্থবছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকা বহির্ভূত কর্পোরেট কর আড়াই থেকে ৫ শতাংশ কমানোর জন্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। তবে, আগামী বাজেটে কর্পোরেট কর অপরিবর্তিত থাকছে বলেই জানা গেছে। ব্যক্তি শ্রেণীর আয়কর সীমা ॥ বর্তমানে ব্যক্তি শ্রেণীর আয়কর সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি বছরে এই পরিমাণ অর্থ আয় করলে তাকে আয়কর দিতে হয় না। গত চার বছর ধরে ব্যক্তি আয়কর সীমা একই আছে। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে এটাকে তিন লাখ টাকা উন্নীত করার প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও, বিদ্যমান কর ব্যবস্থায় নারী করদাতারা এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সের ব্যক্তিদের করমুক্ত আয় সীমা ৩ লাখ টাকা, প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়কর সীমা চার লাখ টাকা এবং গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্ত আয়কর সীমা চার লাখ ২৫ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে করমুক্ত আয়কর সীমা উল্লেখিত তিনটি ধাপ বাড়িয়ে যথাক্রমে সাড়ে তিন লাখ, চার লাখ এবং পাঁচ লাখ টাকায় উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। তবে, এবার ব্যক্তি আয়কর সীমা বাড়তে পারে বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, আগামী ১৩ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করা হবে। এবারের বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা। এটি বর্তমান সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট। একই সঙ্গে নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রথম বাজেট।
×