ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অসমে ভাষা-আন্দোলন

প্রকাশিত: ০৮:১২, ২০ মে ২০১৯

 অসমে ভাষা-আন্দোলন

২১ ফেব্রুয়ারির মতো ১৯ মে ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে আরেকটি গৌরবময় দিন। ১৯৬১ সালের এই দিনে ভারতের অসম রাজ্যের শিলচরে বাংলাকে সরকারী ভাষার মর্যাদা দানের দাবিতে ১১ জন শহীদ হন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল এক রক্তস্নাত অধ্যায়ের মহান দৃষ্টান্ত। ঠিক তেমনি ১১ জন ভাষাশহীদের রক্তের বিনিময়ে অসমে বাংলা সরকারী ভাষা হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছিল ১৯ মে’র রক্তস্নাত অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে। শুধু বাংলাদেশের বাঙালীরা নয়, অসমের বাংলাভাষী বাঙালীরাও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় জীবন দান করেছে। ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে এ এক অমর ইতিহাস। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ১৯ মে বাংলা ভাষার জন্য রক্তদানের ঘটনাটি বাঙালীর ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে একটি উপেক্ষিত এবং বিস্মৃত অধ্যায়। এখনও কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাভাষার জন্য জীবন দানের ঘটনা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও ঘটেনি। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশে যেমন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিক, অহিউল্লাহসহ আরও অনেকে জীবন দান করেছেন ঠিক তেমনি অসমের শিলচরে বাংলা ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন ১১ জন ভাষাবীর। দেশ বিভাগের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে বাঙালীদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সাহিত্য-সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। বিশেষ করে অসমের শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে গড়ে ওঠে বাঙালী জনপদ। তাদের মুখের ভাষা এবং সাহিত্য, সংস্কৃতির বাহন হিসেবে বাংলা ভাষা অসমের সমাজ ও রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৫০ সালে অসমে এক সময় গড়ে ওঠে ‘বাঙাল খেদা’ আন্দোলন। এর নেতৃত্ব প্রদান করেন উগ্রবাদী অসমিয়া সম্প্রদায়। অসমিয়া জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি এবং অসমিয়া ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ও সরকারী ভাষারূপে প্রতিষ্ঠা করার ইন্ধন যোগাতে ব্রিটিশ ও আমেরিকানদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। ১৯৪৮ সালের মে মাসে গোহাটি শহরে তারা বাঙালীদের উপর আগ্রাসন চালায়। ১৯৬০ সালের ৩ মার্চ অসমের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা বিধান সভায় অসমিয়াকে অসম রাজ্যের সরকারী ভাষা ঘোষণা করা হবে বলে জানান। ওই ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৬০ সালের ১৬ এপ্রিল শিলচরে বাংলাভাষা-ভাষী বাঙালীরা এক নাগরিক সভা আহ্বান করেন। ওই সভা শেষে সরকারী ভাষা-প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথ। শিলচরে ২ ও ৩ জুলাই চপলাকান্তের সভাপতিত্বে ‘নিখিল অসম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন’ নামে ভাষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি জানানো হয় এবং কাজী নজরুল ইসলামের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাপার’ গান গেয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয়। এভাবেই বাংলা ভাষার স্বপক্ষে অসমে চলতে থাকে নানা কর্মসূচী। এতদসত্ত্বেও ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর অসম রাজ্যের সর্বত্র অসমিয়া ভাষা প্রয়োগের জন্য বিধান সভায় ভাষা বিল উত্থাপন ও পাস হয়। এভাবে অসমের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ লাখ লাখ বাঙালী এবং সেই সঙ্গে অসমিয়া গোষ্ঠীর বাংলাকে সরকারী ভাষা করার মৌলিক অধিকারের দাবি অগ্রাহ্য করা হয়। এই আইনের প্রতিবাদে বাংলা ভাষার স্বপক্ষ শক্তি আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে। বাংলা ভাষার দাবিতে গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। এই আইনের প্রতিবাদে পন্ডিত রাজমোহন নাথের সভাপতিত্বে ১৮, ১৯ ও ২০ নবেম্বর শিলচরে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল সম্মেলন। সম্মেলনে গৃহীত এক সিদ্ধান্তে বলা হয়, ‘যদি এই আইন করে বাংলা ভাষাকে অসমিয়া ভাষার সমমর্যাদা দেয়া না হয় তবে বাঙালী সমাজের মৌলিক অধিকার ও মাতৃভাষা রক্ষার্থে অসমের বাংলা ভাষা অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর বৃহত্তর অসমের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া অপরিহার্য হয়ে পড়বে।’ পরে শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে ‘কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে সরকারকে চরমপত্র দেয়া হয়। সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয়, ১৯৬১ সালের ১৯ মে থেকে সমগ্র কাছাড়ে বাংলাকে সরকারী ভাষা করার দাবিতে অহিংস অসহযোগ গণ-আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে। পূর্ব সিদ্ধান্ত মতো ১৯৬১ সালের ১৮ মে রাত ১২টার পর থেকে প্রায় ১০ হাজার তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ শিলচর রেলস্টেশনে অহিংস অবস্থান ধর্মঘট করার জন্য সমবেত হতে থাকে। অবশেষে আসে ১৯ মে। শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। উত্তেজিত জনতার প্রতিরোধে সরকারের বাহিনী ট্রেন চালাতে ব্যর্থ হয়। ১৯ মে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পুলিশ এদের অনেককেই গাড়িতে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। বিভিন্ন দফায় লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাসের সঙ্গে যোগ দেয় এবং তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে অনেক রেলকর্মচারীও। বেলা আড়াইটার দিকে রেলস্টেশনে কর্তব্যরত বিএসএফের সদস্যরা হঠাৎ গেরিলার ভঙ্গিতে গুলিবর্ষণ শুরু করলে গুলিবিদ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ শহীদ হন ৯ জন। তাঁরা হলেন- সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দাস, চন্ডীচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, হীতেশ বিশ্বাস, শচীন্দ্র পাল, কমলা ভট্টাচার্য, কানাই নিয়োগী। পরদিন স্টেশনের পুকুর থেকে সত্যেন্দ্রকুমার দেবের বুলেটবিক্ষত দেহ উদ্ধার করা হয়। রাতে হাসপাতালে মারা যান বীরেন্দ্র সূত্রধর। মোট ভাষাশহীদদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ জন। ১৯ মে পুরো দিনটি ছিল উত্তাল ও ঘটনাবহুল। প্রশাসন কার্ফু জারি করে, গ্রেফতার করা হয় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষকে। কিন্তু এতেও ক্ষান্ত হননি আন্দোলনকারীরা। তাঁদের রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে ওই অঞ্চলের সরকারী ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রশাসনিক স্বীকৃতি দিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়। ১১ জন ভাষাশহীদের রক্তের বিনিময়ে অবশেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী প্রদত্ত সূত্রের উপর ভিত্তি করে গৃহীত সংশোধনী আইনে কাছাড় জেলায় বাংলাভাষা ব্যবহারের অধিকার স্বীকার করে নেয়া হয়। এভাবেই অসম রাজ্যে ভাষা-আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে এবং বাংলা ভাষা বিধান সভায় স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশের অহঙ্কার অমর একুশে আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সকল মাতৃভাষাপ্রেমী মানুষ আজ এ দিবসটি নিয়ে অহংকার এবং গর্ব করে। এ গর্বের গর্বিত অংশীদার অসম রাজ্যের ১১ জন ভাষাশহীদ। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের মতোই অসমের ভাষা-আন্দোলন ঘটনাবহুল ও ঐতিহাসিক। কাজেই বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অসমের ভাষাশহীদ ও ভাষা আন্দোলনের ভূমিকাকে কোনক্রমেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। লেখক : নির্বাহী পরিচালক, ভাষা-আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর [email protected]
×