ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রংপুরে বোরো ধানের বাজার নিয়ে সঙ্কটে কৃষক

প্রকাশিত: ১০:২৪, ১৯ মে ২০১৯

 রংপুরে বোরো ধানের  বাজার নিয়ে  সঙ্কটে কৃষক

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর, ১৮ মে ॥ আমন মৌসুমে কৃষকরা ধানের ন্যায্য দাম পাননি। বেশি দামের আশায় অনেক কৃষক সেই ধান রেখে দিয়েছিলেন ধানের গোলায়। আশা করেছিলেন, বোরো উঠার আগে আগে হয়তোবা ধানের দাম বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু বিধি বাম, দাম বাড়েনি বরং অনেক কমেছে। মৌসুমের চেয়েও কম দামে ধান বিক্রি হওয়ায় তাদের গোলার ধান গোলাতেই রয়ে গেছে। অন্যদিকে বেড়েছে মজুরি এবং উৎপাদন সামগ্রীর দাম। এক মণ ধান ৪২০ টাকা আর একজন মজুরের মজুরি ৫০০-৫৫০ টাকা। এক মণ ধান দিয়েও একজন মজুর পাওয়া যাচ্ছে না। ধান বিক্রি করেই কৃষকদের যাবতীয় খরচ মিটিয়ে আবার নতুন করে ধান চাষ করতে হয়। বর্তমান দামে উৎপাদন খরচই উঠবে না। সামনের দিনগুলো চলবে কিভাবে সেই চিন্তায় হতাশায় দিন কাটছে উত্তরের কৃষকদের। সামনে বড় উৎসব ঈদ। মূল্য কম থাকায় ঈদকে ঘিরেও কৃষকদের দীর্ঘশ্বাস দিনদিন ভারি হচ্ছে। বোরো ধান উৎপাদনে কৃষকদেরকে মোটা অংকের অর্থনৈতিক লোকসান গুণতে হচ্ছে। আর এ লোকসানের মূল কারণ মজুর সঙ্কট, মজুরের শ্রম, সার, কীটনাশক ও সেচের মূল্য বৃদ্ধি। অথচ জমিতে ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচের চেয়ে প্রাপ্ত ধানের বাজার মূল্য অনেক কম। সার্বিক এ পরিস্থিতিতে ধান উৎপাদনের লোকসানের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া কৃষকের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার ধর্মেশ্বর গ্রামের এক আদর্শ কৃষক আলাউদ্দিন ১০ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। ধান প্রায় সবই পেকেছে। কিন্তু শ্রমিক সঙ্কট এবং বেশি মজুরির কারণে মাত্র ১ বিঘা জমির ধান ঘরে তুলেছেন। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, প্রতিমণ ধান উৎপাদন খরচ ৬/৭ শ’ টাকা অথচ বিক্রি করতে হচ্ছে ৫০০ টাকা থেকে ৫৬০ টাকা পর্যন্ত। তিনি বলেন, প্রতিবিঘা জমিতে ধান উৎপাদনে লোকসান হয়েছে ৮ হাজার টাকার বেশি। উৎপাদন খরচের চেয়ে ধানের দাম কম হওয়ায় হতাশায় ভুগছে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার বোরো চাষীরা। বিশেষ করে অন্যের জমি বর্গা ও লিজ নিয়ে বোরো ধানের চাষীদের চোখে কষ্টের ছায়া। প্রতিমণ ধান উৎপাদনের তাদের যে ব্যয় হয় তার থেকে ধানের বাজার মূল্য ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত কম হওয়ায় হতাশায় ভুগছেন এ উপজেলার কৃষকরা। তারাগঞ্জ উপজেলায় বোরো চাষীদের প্রতি ১ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করতে মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার ১৭০ টাকা। ১ বিঘা জমিতে ধান উৎপাদন হয়েছে ২৫ থেকে ২৮ মণ পর্যন্ত। এতে দেখা যায় ১ মণ ধান উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে ৬১৪-৬৮৬ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এ উপজেলায় বর্তমানে ধানের খুচরা মূল্য চলছে ৫৬৫-৫৭৫ টাকা পর্যন্ত। কৃষকরা বলছেন, প্রতিমণ ধান ৬০০ টাকায় বিক্রি করলেও তাদের উৎপাদন খরচ উঠবে না। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অশোক কুমার রায় বলেন, সারাদেশের মতো তারাগঞ্জ উপজেলাতেও একই অবস্থা। তবে আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সরকারীভাবে ধান ক্রয় করা শুরু হবে। তবে বর্তমানে খোলাবাজারে যে বাজার দর চলছে তাতে যারা নিজস্ব জমিতে বোরো চাষ করছে তাদের ততটা লোকসান হবে না। ক্ষতিগ্রস্ত সবচেয়ে বেশি হচ্ছে অন্যের জমি বর্গা ও লিজ নিয়ে বোরো ধান চাষ করা কৃষকরা। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বর্তমানে কৃষকদের ধান বিক্রি করতে হচ্ছে প্রায় ১৪ টাকা কেজি দরে। তবে সরকারী ধান ক্রয় শুরু হলে তা কেনা হবে ২৬ টাকা কেজি দরে। তখন কৃষকরা অবশ্যই লাভবান হবেন। বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউপির ঘাটাবিল এলাকার কৃষক অতুল চন্দ্র বলেন, কৃষকরা বিঘা প্রতি ধান পেয়েছে ৪০-৪২ মণ। বিভিন্ন রোগ-বালাই এর প্রভাবে ফলনও হয়েছে কম। বিষ্ণুপুর ইউপির মোল্লাপাড়ার ওহাব মোল্লা বলেন, যে ধান পেয়েছি সব খরচ দিয়েও লোকসান গুণতে হবে। বর্তমান বাজারে প্রতিমণ ধানের সর্বোচ্চ মূল্য ৪০০-৪২০ টাকা। অথচ একজন কৃষাণকে দিনে ৫০০ টাকা দিতে হয়। কালুপাড়া ইউপির হাজীপাড়ার মাসুদ অনেক ক্ষোপ নিয়ে বলেন, ১ মণ ধানে একজন শ্রমিক পাওয়া যায় পীরগাছা উপজেলার কল্যাণী ইউনিয়নের কৃষক বুলবুল মিয়া দুই বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছিলেন। ৫০০ টাকায় দিন হাজিরার শ্রমিক দিয়ে কিছু ধান কেটেছেন। মঙ্গলবার বড়দরগা হাটে ধান বিক্রি করতে এসেছিলেন। দাম কম থাকায় সে ধান বিক্রি করতে পারেননি। তিনি জানান, বাজারে ব্যাপারীরা ধানের মণ সাড়ে ৫০০ টাকা বলায় তিনি ধান বিক্রি করেননি। রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে ধান ফেরত নিয়ে এসেছেন। এবারও ধানের ন্যায্য দাম পাবেন কিনা এই চিন্তায় সে অস্থির। রংপুর সদরের অমিন মিয়া, মান্নান, হান্নান মিয়া, গঙ্গাচড়ার গজঘণ্টার মিজানুর রহমান। জানা গেছে, হাট বাজারগুলোতে গত আমন মৌসুমে ধান কেনা-বেচা হচ্ছে ৪৮০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা মণ। এবার বোরো মৌসুমেও ধানের দাম নেই। প্রতিমণ বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা মণ। এখন প্রায় তিন থেকে চারগুণ বেশি মজুরি দিতে হচ্ছে। একমণ ধানের বিনিময়েও একজন কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে উৎপদন ব্যয়ও বেড়েছে দ্বিগুণ। তার ওপর ধানের দাম নেই। সামনে ঈদ। এই উৎসব কিভাবে পার করবেন এ নিয়ে চিন্তিত অনেক কৃষক। রংপুর জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোঃ আব্দুল কাদের জানান, আট উপজেলায় চলতি বোরো মৌসুমে ৯ গুদামে প্রতিকেজি ২৬ টাকা দরে ৪ হাজার মেট্রিকটন ধান, প্রতিকেজি ৩৬ টাকা দরে ২৫ হাজার ১শ’ মেট্রিক টনের বেশি চাল ও ৩৫ টাকা কেজি দরে ৭শ’ ২৬ মেট্রিকটন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। এজন্য জেলার ৯শ’ মিল মালিকের সঙ্গে চুক্তি করেছে খাদ্য বিভাগ। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ডক্টর সরোয়ারুল হক জানান, জেলায় বোরো ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৩শ’ ৭৮ হেক্টর জমিতে। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় অর্জন হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার ৮শ’ ৭০ হেক্টর জমিতে। তিনি বলেন, জেলার ৮ উপজেলায় চাষী আছে ৭ লাখ ৮৬ হাজার এবং বর্গাচাষী ৪৩ হাজার ৫শ’। তিনি বোরো ধানের কৃষকের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিয়ে বলেন, উৎপাদন বেশি হলে দাম কম হয় এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া মাড়াই মৌসুমে দাম কম হয়। সরকার ধান কেনা শুরু করছে। এখন দাম বাড়বে। তিনি আরও জানান, শুক্রবার পর্যন্ত ৫০ শতাংশ জমির বোরো ধান কাটা হয়েছে। পুরোপুরি কাটামাড়াই হলে দাম কিছুটা বাড়তে পারে।
×