ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মালয়েশিয়া যেতে মরিয়া রোহিঙ্গারা

প্রকাশিত: ১০:২২, ১৯ মে ২০১৯

 মালয়েশিয়া যেতে মরিয়া রোহিঙ্গারা

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া যেতে সমুদ্র সৈকতের কোথায় এবং কয়টি পয়েন্ট আছে, তা রোহিঙ্গারা জেনে গেছে। যেখানে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে, (উখিয়া-টেকনাফ) সেখানে দুই উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী পাহারায় রয়েছে বলে রোহিঙ্গারা ভিন্ন কৌশল বেছে নিয়েছে। জানা গেছে, জেলার মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, গহিরা, হাতিয়া, এমনকি চট্টগ্রাম সমুদ্র পয়েন্টকেও মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য বেছে নিয়েছে রোহিঙ্গারা। দেশব্যাপী প্রচার ছিল সাগরপথে অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার আদমঘাট কক্সবাজারে। ওইসময় কয়েকজন দালালের কারণে কক্সবাজারের মানুষ লজ্জা পেতেন বিভিন্ন স্থানে। তবে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী কক্সবাজারের সেই দুর্নাম মুছে দিয়েছিল। প্রশাসনের তৎপরতায় এলাকাছাড়া হয় দালাল চক্র। ২০১৫ সালে কক্সবাজার থেকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায় সাগরপথে মালয়েশিয়া মানবপাচার। বর্তমানে মালয়েশিয়া মানবপাচার ফের শুরু করেছে রোহিঙ্গারা। সাগর পাড়ি দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা। জানা যায়, কক্সবাজারের দরিয়ানগর, সমিতিপাড়া, উখিয়ার সোনারপাড়া, রামুর লালব্রিজ, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, বাহারছড়া ইত্যাদি ঘাট দিয়ে মানবপাচার হতো মালয়েশিয়া। ২০১২ থেকে ১৪ সাল পর্যন্ত হাজার হাজার বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা সাগর পথে পাচার হয়েছে অবৈধভাবে। তখন ওইসব এলাকার চিহ্নিত কিছু দালাল মালয়েশিয়া মানবপাচার করতে সিন্ডিকেট গঠন করেছিল। যেখানে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় মর্মে তারা মানবপাচার কাজ চাঙ্গা করে তুলেছিল। প্রতি রাতে হাজার হাজার মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পথে নিয়ে গেছে মালয়েশিয়ায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী মানবপাচার ঠেকাতে মাঠে নামে। যৌথ অভিযান চালায় জোরেশোরে। বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় একাধিক দালাল। মামলার ঝুলি মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে চলে যায় কেউ কেউ। গ্রেফতার হয়ে অনেকের স্থান হয় শ্রীঘরে। এভাবে প্রশাসনের জিরো টলারেন্স অবস্থা দেখে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে মানবপাচারকারী চক্র। সূত্র জানায়, সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে দেখে রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তবে পরিবারের সবাই নয়, হয়তো বড় ছেলে বা বিবাহউপযোগী মেয়েকে পাঠানো হচ্ছে। অন্যরা ক্যাম্পে থেকে কিছুদিনের মধ্যে ক্যাম্প ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নেবে। মালয়েশিয়া থেকে অর্থ পাঠানোর পর দেশের কোথাও ভিটা কিনে বসতি শুরু করবে। অর্থ উপার্জন শেষে মালয়েশিয়া থেকে রোহিঙ্গাদের ছেলেমেয়ে ফের ফিরে আসবে বাংলাদেশে। মালয়েশিয়া গিয়ে অর্থ উপার্জন করবে রোহিঙ্গা যুবকরা, আর মেয়েদের বিয়ে দেবে সেখানে। তারাও অর্থ পাঠাবে তাদের পিতা মাতার জন্য। সচেতন মহল জানান, মানবপাচার, মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আনা, অস্ত্র বেচাকেনা, মদসহ চোরাচালান, অস্ত্রের প্রশিক্ষণ, প্রশাসনের ওপর হস্তক্ষেপ ও জঙ্গীপনাসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকা- রোহিঙ্গাদেরই সৃষ্টি করা কাজ। তারাই সর্বপ্রথম টেকনাফ থেকে মানবপাচার শুরু করেছিল। তারাই দেশে ইয়াবার চালান আনছে এখনও। মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়ে রোহিঙ্গারা পেটাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যদের। বর্তমানে প্রতি দিন বা রাতে শত শত রোহিঙ্গা ক্যাম্প ত্যাগ করছে। কেউ বৈধভাবে আবার কেউ অনুমতি নিয়ে ক্যাম্প ছাড়ছে। জানা গেছে, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে চিকিৎসার জন্য, জেলখানায় স্বজনকে দেখতে যাওয়ার জন্য ইত্যাদি বাহানা ধরে ক্যাম্প ইনচার্জের কাছ থেকে অনুমতি নিচ্ছে রোহিঙ্গারা। ক্যাম্প ইনচার্জের নাম ভাঙ্গিয়ে অফিসের এক শ্রেণীর কর্মচারী প্রতিজন রোহিঙ্গার কাছ থেকে এক থেকে দুই হাজার টাকা উৎকোচ নিয়ে অনুমতি পাইয়ে দিচ্ছে। তারা ওই অনুমতিপত্র দেখিয়ে সড়ক পথের চেকপোস্ট অতিক্রম করে পৌঁছে যাচ্ছে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে। সেখান থেকে রোহিঙ্গা দালালের মাধ্যমে সাগরপথে পাড়ি দিচ্ছে মালয়েশিয়া। প্রত্যেহ কক্সবাজার, উখিয়া ও টেকনাফে শত শত রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে পাঠাচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। সচেতন মহল বলেন, ক্যাম্পের বাইরে ধরা পড়া রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে ফেরত নয়, ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দিয়ে কারাভোগ শেষে মিয়ানমারে বন্দী ফেরতের ব্যবস্থা করলে রোহিঙ্গারা সহজে ক্যাম্প ত্যাগ করার সাহস পাবেনা। রোহিঙ্গাদের বেলায় আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইন মানা হচ্ছেনা। যদি তা হতো, তাহলে রোহিঙ্গারা এত বেপরোয়া হওয়ার সাহস পেতনা। ক্যাম্পের বাইরে ঘোরাফেরা, ক্যাম্প ত্যাগ করে যত্রতত্র যাওয়া-আসা এবং দিব্যি ব্যবসা করে রোজগার করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেতনা। রোহিঙ্গারা এসব আইনবহির্ভূত কাজ করছে কতিপয় এনজিওর কারণে। নগদ ৮ লাখ টাকা নিয়ে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প থেকে এক রোহিঙ্গাকে উখিয়া থানায় ধরে আনা হলেও এনজিওর চাপের মুখে ওই রোহিঙ্গাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ। তবে কেন, আইন অনুসারে রোহিঙ্গাদের হাতে বাংলাদেশী টাকা থাকার কথা নয়, সে এত টাকা পেল কোথায়? তদন্ত হওয়ার আগেই তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে এনজিও কর্মকর্তারা। শনিবার মধ্যরাতে পেকুয়া উজানটিয়া জেটিঘাট থেকে নারী ও শিশুসহ ৪৫ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ। দালালচক্রের একটি দল আটক রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে জেটিঘাটে নামিয়ে দিয়ে সটকে পড়ে। শনিবার মধ্যরাতে পেকুয়া থানার এসআই মকবুলের নেতৃত্বে একদল পুলিশ করিমদাদ মিয়ার জেটিঘাট থেকে তাদের আটক করে থানা হেফাজতে নিয়ে আসে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রাতে জেটিঘাটে অনেক মানুষ দেখতে পেয়ে আমরা এগিয়ে যাই। জিজ্ঞেস করে জানতে পারি তারা সবাই রোহিঙ্গা। পরে পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ তাদের আটক করে। পেকুয়া থানা পুলিশ জানায়, ট্রলারযোগে সাগর পথে তারা মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে তারা উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসেছে বলে জানায়। এর আগে মঙ্গলবার রাতে পৃথক অভিযান চালিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচারের লক্ষ্যে জড়ো করা ৬৬ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে সদর, টেকনাফ ও উখিয়া পুলিশ। মঙ্গলবার রাতে শহরের কলাতলীর শুকনাছড়ি দরিয়ানগর সমুদ্র ঘাটে জড়ো করা ২৮ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে সদর থানা পুলিশ। আটকদের মধ্যে ১৩ জন নারী, ৯ জন পুরুষ ও ৬ শিশু রয়েছে। এ সময় পাচারকাজে জড়িত একটি নৌকাও জব্দ করা হয়। স্থানীয়রা জানায়, মালয়েশিয়ায় মানবপাচারকারী একটি চক্র মঙ্গলবার রাতে দরিয়ানগর ও শুকনাছড়ি ঘাটে অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু জড়ো করে। বিষয়টি টের পেয়ে এলাকার শতাধিক মানুষ রাত সাড়ে ১০টার দিকে সমুদ্র সৈকত ও সৈকতে মানবপাচারকারীদের একটি বাড়ি ঘেরাও করে মোট ২৮ জনকে আটকে রাখে। পুলিশে খবর দেয়া হলে সদর থানা পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে ২৮ জনকে থানায় নিয়ে যায়। স্থানীয়রা আরও জানান, মালয়েশিয়ায় আদম পাচারকারী চক্রের সদস্যরা দরিয়ানগর ও শুকনাছড়ি ঘাটকে আবারও মানবপাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার শুরু করছে। সদর থানা পুলিশের ওসি ফরিদউদ্দিন খন্দকার জানান, আটকদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সকলেই রোহিঙ্গা বলে স্বীকার করেছে। দালালদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অভিজ্ঞজনরা বলেন, রমজান মাসে প্রশাসনের লোকজন সেহরি, ইফতার ও তারাবির নামাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা দালাল চক্র মালয়েশিয়া মানবপাচার কাজ চাঙ্গা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ওইসব দালালদের সহযোগিতা করছে উখিয়ার সোনারপাড়ার মালয়েশিয়া ফেরত চিহ্নিত দালাল বাপ্পু।
×