ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিশেষ দিবসে বর্ণাঢ্য উদ্যাপন

জাদুঘর নয় শুধু, বহু সংস্কৃতির মিলনকেন্দ্র

প্রকাশিত: ১০:২২, ১৯ মে ২০১৯

জাদুঘর নয় শুধু,  বহু সংস্কৃতির মিলনকেন্দ্র

মোরসালিন মিজান ॥ জাদুঘর ঘিরে উৎসবমুখর একটি দিন। অন্যরকম মিলনমেলা। শনিবারের মিলমেলায় জাদুঘর সংশ্লিষ্টরা যেমন অংশগ্রহণ করলেন, তেমনি যোগ দিয়েছিলেন সাধারণ দর্শনার্থীরা। ইতিহাসবিদ শিল্পী সাহিত্যিকরাও বাদ যাননি। আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস এই আনন্দ আয়োজনের সুযোগ করে দিয়েছিল। অবশ্য শুধুই আনন্দ আয়োজন বললে ভুল বলা হবে। সভ্যতার ইতিহাস তুলে ধরার ক্ষেত্রে জাদুঘরের গুরুত্ব, দায় ইত্যাদি বিষয় নতুন করে সামনে আসে এদিন। আয়োজন করা হয় সেমিনারের। আগামী প্রজন্মকে জাদুঘরমুখী করার প্রয়াসে কিছু কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। সব মিলিয়ে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যাপন বলা চলে। হ্যাঁ, গতকাল ১৮ মে ছিল আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস। ১৯৭৭ সালে দিবসটির সূচনা করে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব মিউজিয়াম বা আইকম। পৃথিবীর বহু দেশের ন্যায় বর্তমানে বাংলাদেশেও দিবসটি উদ্যাপিত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় শনিবার সকাল থেকেই সরব হয়ে ওঠে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণ। এ সময় জাতীয় জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি শিল্পী হাশেম খানসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অংশগ্রহণে শোভাযাত্রা বের করা হয়। সকলকে সঙ্গে নিয়ে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে দেন তিনি। পরে জাদুঘর ভবনের তৃতীয় তলায় নবসজ্জিত অস্ত্রশস্ত্র গ্যালারি উদ্বোধন করা হয়। ২৩ নম্বর গ্যালারিটিতে ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রের একটি ভাল সংগ্রহ। মোট ১৮০টি নিদর্শন। বেশিরভাগ নিদর্শনই পাওয়া হয়েছিল বলধা গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর কাছ থেকে। তার অমূল্য সংগ্রহে জাতীয় জাদুঘরে স্থানান্তরিত হয়েছে। জাদুঘর দিবসে আয়োজন করা হয় বিশেষ সেমিনারের। সেমিনারের বিষয় ছিল ‘নলিনীকান্ত ভট্টশালী: বাংলার প্রত্নগবেষণায় একনিষ্ঠ সাধক।’ এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনেওয়াজ। আলোচনা করেন ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক ড. সোনিয়া নিশাত আমিন প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি শিল্পী হাশেম খান। মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনেওয়াজ বলেন, নলিনীকান্ত ভট্টশালী ছিলেন একজন ইতিহাসবেত্তা, প্রত্নতত্ত্ববিদ, মুদ্রাবিজ্ঞানী, লিপিবিশারদ ও প্রাচীন বিষয়াবলী সম্পর্কে বিখ্যাত পন্ডিত। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির বহু অস্পষ্টতা অপসারণে বিশাল অবদান রয়েছে তার। আজকের জাতীয় জাদুঘরের ভ্রণশিশু ছিল ঢাকা জাদুঘর। আর ওই জাদুঘরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য নাম নলিনীকান্ত। অসাধারণ নিষ্ঠা ও কর্মশক্তি বলে তিনি একটি সংগ্রহশালাকে খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করেছিলেন। প্রত্নবস্তু সংগ্রহ, শ্রেণীকরণ, এসবের ঐতিহাসিক বিবরণ খুঁজে বের করা ও শৈলী বিচারের গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি উত্তরসূরিদের এগিয়ে চলার সোপান তৈরি করে দিয়েছিলেন। তার রচিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো এরই স্বাক্ষর বহন করছে। প্রত্নগবেষক এই ক্ষণজন্মা মানুষটির জীবন তর্পণ ও কর্ম সংরক্ষণের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে প্রজন্ম প্রণোদিত হবে বলে মন্তব্য করেন প্রাবন্ধিক। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, নলিনীকান্তের দীর্ঘ ৩৩ বছরের কর্মজীবনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল হিসেবে আমরা পেয়েছি জাদুঘরের বিশাল সমৃদ্ধ ভান্ডার। আমাদের উচিত নলিনীকান্ত ভট্টশালীর আদর্শ নীতি অনুসরণ করে জাদুঘর নিয়ে কাজ করা, গবেষণা করা এবং জাদুঘরকে আরও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করা। অধ্যাপক ড. সোনিয়া নিশাত আমিন বলেন, নলিনীকান্ত ভট্টশালী ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। তিনি মনে প্রানে কাজ করতেন প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে, গবেষণা করতেন, প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহ করতেন দূর-দূরান্ত থেকে। তার মত মানুষকেই কেবল প্রত্নতত্ত্বের সাধক বলা সাজে। এর আগে আগামী প্রজন্মকে জাদুঘরের প্রতি আগ্রহী করতে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। ‘আমার দেখা জাদুঘর’ শীর্ষক রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। এদিন জাতীয় জাদুঘরের ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘জাদুঘর সমাচার’ নতুন করে প্রকাশিত হয়। অনেক দিন বন্ধ থাকার পর আসে নতুন সংখ্যা। অনুষ্ঠানে এর আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এশিয়াটিক সোসাইটিতে পৃথক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আইকম বাংলাদেশ কমিটি। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক মাহফুজা খানম। বিশেষ অতিথি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. সাব্বীর আহমেদ। অধ্যাপক ড. শরীফ উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইকম বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারপার্সন জাহাঙ্গীর হোসেন। সেমিনারে Museums as Cultural Hubs: The Future of Tradition’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভারতের রামকৃষ্ণ মিশন সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের ইন্টার্নশিপ স্কলার মিজ সঙ্গীতা লাহড়ী। ‘Numismatic Collection of BNM: Cultural Hub of South Asia’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় জাদুঘরের উপ-কিপার মোহাম্মদ মনিরুল হক। বক্তারা বলেন, আমাদের জাদুঘরগুলোকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। সাধারণ মানুষকে জাদুঘরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘরকে দেশের অন্যতম গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কথাও জানানো হয় অনুষ্ঠানে। একই দিন আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এভাবে জাদুঘর ঘিরে চমৎকার একটি দিন। সাধারণকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা। সভ্যতার ইতিহাস সন্ধান ও বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে এই চেষ্টা অব্যাহত থাকুক।
×