ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রথম শিরোপা জয়ের স্বাদ নিয়ে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১০:০০, ১৯ মে ২০১৯

 প্রথম শিরোপা জয়ের স্বাদ নিয়ে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ

মিথুন আশরাফ ॥ এত অসাধারণ ক্রিকেট ক্যারিয়ার। সবই পেয়েছেন। অথচ মাশরাফি বিন মর্তুজার হাত ধরে শিরোপা জেতা অধরাই থেকে যাবে। তার হাতে কোন টুর্নামেন্টের একটি শিরোপা শোভা পাবে না? তাই কী হয়? ভাগ্য মাশরাফির হাতে অবশেষে লুটিয়ে পড়তে বাধ্য হলো। সপ্তম ফাইনালে গিয়ে জিতল বাংলাদেশ। অবশেষে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে গিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলো মাশরাফিবাহিনী। প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতে ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ। সেই শিরোপা আসল মাশরাফির হাত ধরেই। তার নেতৃত্বেই। এ শিরোপার স্বাদ নিয়েই বিশ্বকাপে খেলতে গেল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রধান কোচ স্টিভ রোডস ত্রিদেশীয় সিরিজ চলার সময় বলেছিলেন, ‘আমরা ভয়ঙ্কর দল।’ সত্যিই বাংলাদেশ কতটা ভয়ঙ্কর দল তা বুঝিয়ে দিল। ত্রিদেশীয় সিরিজে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ। শুক্রবার ফাইনালসহ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তিন ম্যাচে হারাল। আয়ারল্যান্ডকে হারাল এক ম্যাচ। এক ম্যাচ হলো পরিত্যক্ত। বিশ্বকাপের আগে পূর্ণোদ্যম পেলেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হয়ে গেলেন। মানসিকতাও চাঙ্গা হয়ে গেল। বিশ্বকাপের পর যদি মাশরাফি অবসরও নিয়ে ফেলেন এখন আর তার তেমন আফসোসও থাকছে না। তিনি যে অন্তত একটি শিরোপা বাংলাদেশকে দিলেন। এই শিরোপা জেতায় প্রথমবারের মতো নকআউট পর্বে জেতাও হলো বাংলাদেশের। দেশের পাঁচ সিনিয়র ক্রিকেটার মাশরাফি, সাকিব, মুশফিক, তামিম ও মাহমুদুল্লাহ একসঙ্গে থেকে একটি শিরোপাও দেশকে দিলেন। সাকিব আল হাসান না থাকায় ফাইনালে কি হয়, আবার শিরোপা জেতার আক্ষেপ থাকে কিনা সেই শঙ্কা তৈরি হয়। কিন্তু মাশরাফির বিশ্বাস ছিল। যদি যারা একাদশে থাকবেন তারা নিজেদের মেলে ধরতে পারেন তাহলে সাকিব ছাড়াই ফাইনাল জেতার সামর্থ্য বাংলাদেশ দলের আছে। শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচের আগেরদিন অধিনায়ক মাশরাফি বলেছিলেনও, ‘সাকিবের থাকা না থাকাই ম্যাচের ডিসাইডিং ফ্যাক্টর, অধিনায়ক হিসেবে সেটা আমি মনে করি না। সাকিবকে ছাড়াও এই ম্যাচ (ফাইনাল) জয়ের সামর্থ্য আমাদের আছে। এ জন্যই সেরা ১৫ জনকে আনা হয়। আমি অধিনায়ক হিসেবে বলব, সাকিব না খেললে, ওর জায়গায় যে খেলবে সেও পেশাদার ও তারও সামর্থ্য আছে ভালা করার।’ সাকিবের পরিবর্তে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত খেললেন। মাশরাফির বিশ্বাসের প্রতিদানও এমনভাবে দিলেন যা মনে রাখার মতোই হলো। দেশের দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরিয়ান হলেন। ২০ বলে হাফ সেঞ্চুরি করার সঙ্গে ২৪ বলে অপরাজিত ৫২ রান করলেন। ঝড়ো ব্যাটিং করে বাংলাদেশকেও জেতালেন মোসাদ্দেক। সাকিব না থাকায় সুযোগ পেয়ে নিজেকে এমনভাবেই মেলে ধরলেন মোসাদ্দেক, জেতা ফাইনালে সবচেয়ে সেরা নৈপুণ্যটি তার হয়ে থাকল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ শুরুতে ব্যাটিং করে ২০.১ ওভারে কোন উইকেট না হারিয়ে ১৩১ রান করতেই বৃষ্টি পড়তে থাকে। যেন থামতেই চায় না। বৃষ্টি না থেমে ম্যাচ না হলে বাংলাদেশই লীগপর্বে সবচেয়ে ভাল করায় চ্যাম্পিয়ন হতো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফাইনাল খেলা শুরু হলো। ২৪ ওভারের খেলা হলো। তাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ শেষ পর্যন্ত ১ উইকেট হারিয়ে ১৫২ রান করল। কিন্তু তখন কি দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের জিততে হলে বৃষ্টি আইনে ২১০ রানের টার্গেট দাঁড় হলো। কি কঠিন পথ। পাড়ি দেয়া যে সহজ নয় তা সবাই জানত। এরপরও মনে বিশ্বাস ছিল। সামর্থ্যরে প্রতি ছিল পূর্ণ আস্থা। সেই বিশ্বাস আর আস্থা নিয়েই পথ চলতে থাকলেন বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা। তামিম ও সৌম্য মিলে শুরুটা দুর্দান্ত করলেন। মাঝপথে একটু ছন্দপতন হলো। কিন্তু ১৪৩ রানেই যখন ৫ উইকেট পড়ে গেল বাংলাদেশের জিততে তখন ৫০ বলে ৬৮ রান দরকার ছিল। তখন ব্যাট হাতে নামেন মোসাদ্দেক। হিসেবে বল আর রানের পার্থক্য খুব বেশি ছিল না। কিন্তু সমস্যা ছিল মাহমুদুল্লাহ ও মোসাদ্দেক ছিলেন উইকেটে। এই দুইজনের একজন যদি দ্রুত আউট হয়ে যেতেন তাহলে স্পেশালিস্ট বোলারদের ওপর ব্যাটিংয়ের ভরসা করতে হতো। তা কতটা কঠিন তা সবারই জানা ছিল। কিন্তু মোসাদ্দেক যে কী অসাধারণ ব্যাটিং করলেন! যখন জিততে ১৮ বলে ২৭ রান দরকার, ফ্যাবিয়েন এলানের করা ২২তম ওভারেই ২৫ রান নিয়ে ফেলেন মোসাদ্দেক। সেখানেই বাংলাদেশের জেতার পথ তৈরি হয়ে যায়। মোসাদ্দেকও ২০ বলে হাফ সেঞ্চুরি করে রেকর্ড গড়েন। শেষ পর্যন্ত ৭ বল বাকি থাকতে বৃষ্টি আইনে ৫ উইকেটে জিতে বাংলাদেশ। কঠিন পথ সহজ করে শিরোপা জিতে নেয় বাংলাদেশ। ম্যাচের নায়ক মোসাদ্দেকের অসাধারণ ব্যাটিংয়ে তা সম্ভব হয়। এই শিরোপা জেতার আত্মবিশ্বাস নিয়েই এখন বিশ্বকাপে খেলতে গেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ক্রিকেট খেলছে ১৯৮৬ সাল থেকে, ৩৩ বছর ধরে। টেস্ট ক্রিকেট ২০০০ সালের ১০ নবেম্বর থেকে খেলে। ২০০৬ সাল থেকে টি২০ খেলছে। এ ফরমেটে ১৩ বছর চলছে। টেস্ট ক্রিকেটে দ্বিপক্ষীয় কোন সিরিজ ছাড়া টুর্নামেন্ট বা দুইয়ের অধিক দলের সমন্বয়ে হওয়া কোন সিরিজ খেলার সুযোগ নেই। তাই শিরোপা জেতারও সুযোগ নেই। কিন্তু ওয়ানডে ও টি২০ ক্রিকেটে সেই সুযোগ আছে। বাংলাদেশ অনেকগুলো টুর্নামেন্ট বা দুইয়ের অধিক দলের সমন্বয়ে হওয়া সিরিজে খেলেছে। এর মধ্যে ফাইনালেও ছয়বার খেলেছে। কিন্তু একবারও শিরোপা জিততে পারেনি। এবার সেই ক্ষুধা মিটল। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ওয়ানডে ও টি২০ মিলিয়ে ছয়বার ফাইনালে খেলে। চারবার ওয়ানডেতে ও দুইবার টি২০তে ফাইনালে খেলে। কিন্তু প্রতিবার রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। শিরোপার এত কাছে গিয়েও শিরোপা এর আগে ছোঁয়া হয়নি। উপমহাদেশের বাইরের কোন দলের বিপক্ষে প্রথমবার ফাইনালে খেলতে নামে বাংলাদেশ। এর আগে বাংলাদেশ ছয়টি ফাইনালে খেলেছিল। একটিতেও জিততে পারেনি। এর আগের ছয় ফাইনালের তিনটিতে প্রতিপক্ষ ছিল ভারত, দুটিতে শ্রীলঙ্কা ও একটিতে পাকিস্তান। এবার প্রথম উপমহাদেশের বাইরের দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ফাইনালে লড়াই করে বাংলাদেশ। দাপট দেখিয়ে ফাইনালে জিতে শিরোপা নিজেদের করে নেয় বাংলাদেশ। প্রথমবার ২০০৯ সালে ত্রিদেশীয় সিরিজে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে জয়ের আশা তৈরি করেও হারে বাংলাদেশ। এরপর ২০১২ সালের এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে কষ্টের হার হয়। ২০১৬ সালে টি২০’র ফাইনালে খেলে বাংলাদেশ। ভারতের কাছে ৭ বল বাকি থাকতে ৮ উইকেটে হারায় বাংলাদেশের শিরোপা হাতছাড়া হয়। গত বছরই বাংলাদেশ তিনটি শিরোপা জেতার একেবারে কাছে গিয়েও পারেনি। শুরুটা হয় জানুয়ারিতে ত্রিদেশীয় সিরিজ দিয়ে। শ্রীলঙ্কার কাছে ৭৯ রানে হেরে শিরোপা জিততে পারেনি। মার্চে আবার শ্রীলঙ্কায় নিদাহাস ট্রফিতে টি২০’র ফাইনালে ভারতের কাছে হারে বাংলাদেশ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে দুবাইয়ে এশিয়া কাপের ফাইনালেও ওঠে বাংলাদেশ। এবারও সামনে প্রতিপক্ষ থাকে ভারত। এবারও একই দশা হয়। শেষ বলে গিয়ে ভারত ৩ উইকেটে জিতে যায়। শিরোপা জেতার আশা আবারও হতাশায় ডুবিয়ে দেয়। এবার সপ্তমবারের মতো ফাইনালে খেলে বাংলাদেশ। এবার প্রতিপক্ষ থাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দলটির আশায় গুড়েবালি দিয়ে মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতে ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ। মাশরাফি এর আগে তিনবার ফাইনালে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু একবারও শিরোপা জিততে পারেননি। মোহাম্মদ আশরাফুল একবার, মুশফিক একবার ও সাকিব একবার ফাইনালে অধিনায়কত্ব করেন। কিন্তু শিরোপা জিততে পারেননি। ২০০৯ সালে ত্রিদেশীয় সিরিজে মোহাম্মদ আশরাফুল, ২০১২ সালের এশিয়া কাপে মুশফিকুর রহীম, ২০১৬ সালের টি২০ এশিয়া কাপে মাশরাফি বিন মর্তুজা, ২০১৮ সালের ত্রিদেশীয় সিরিজে মাশরাফি, ২০১৮ সালের টি২০ নিদাহাস ট্রফিতে সাকিব এবং ২০১৮ সালের এশিয়া কাপে মাশরাফি নেতৃত্ব দেন। কিন্তু শিরোপা জিততে পারেননি। অবশেষে মাশরাফির হাতেই শিরোপা শোভা পেল। মাশরাফি বিন মর্তুজা ও বিশ্বকাপের দলে না থাকা তাসকিন আহমেদ, ফরহাদ রেজা, ইয়াসির আলী চৌধুরী ও নাঈম হাসান দেশে এসে পড়েছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ত্রিদেশীয় সিরিজের পর বিশ্বকাপের দলে থাকা মাশরাফি, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহীম, তামিম ইকবাল, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, রুবেল হোসেন, মুস্তাফিজুর রহমান, সৌম্য সরকার, মেহেদী হাসান মিরাজ, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, সাব্বির রহমান রুম্মন, মোহাম্মদ মিঠুন, আবু জায়েদ রাহী, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন ও লিটন কুমার দাসকে কয়েকদিন ঐচ্ছিক ছুটি দিয়েছেন। সেই ছুটি পেয়ে মাশরাফি দেশে ফিরেছেন। আবার বুধবারই লন্ডনে যাবেন। সেখান থেকে কার্ডিফে চলে যাবেন। দল যে কার্ডিফে ২৬ ও ২৮ মে যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারতের বিপক্ষে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচ খেলবে। মাশরাফির সঙ্গে তামিমও ছুটি কাটাবেন। তিনি দুবাই যান। সেখানে তামিমের পরিবারের লোকজন আগে থেকেই আছেন। তামিমও বুধবার লন্ডন যাবেন। সেখান থেকে কার্ডিফ যাবেন। বাকি ক্রিকেটাররা সবাই শনিবার আয়ারল্যান্ড থেকে লন্ডন হয়ে লেস্টারে গেছেন। লেস্টার থেকে বৃহস্পতিবার পুরো দল যাবে কার্ডিফে। বৃহস্পতিবার থেকেই বিশ্বকাপে আইসিসির অতিথি তালিকায় ঢুকে যাবে বাংলাদেশ দল। সেই থেকে বিশ্বকাপের মিশনেও নেমে পড়বে বাংলাদেশ। এই বিশ্বকাপ মিশন শুরুর আগেই দেশের সেরা সাফল্য ধরা দিল। প্রথমবারের মতো কোন টুর্নামেন্ট বা দুইয়ের অধিক দলের সমন্বয়ে হওয়া সিরিজের শিরোপা জিতল বাংলাদেশ। এই শিরোপার স্বাদ নিয়ে এখন বিশ্বকাপ খেলবে বাংলাদেশ। কোন বক্তব্য নয়- মাশরাফি ॥ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ডাবলিন থেকে লন্ডন পৌঁছেছে বাংলাদেশ দল। তবে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা দেশে ফিরেছেন ঐতিহাসিক ট্রফি নিয়ে। শনিবার রাত ১১টা ২০ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন মাশরাফিসহ সিরিজ জয়ী দলের চার ক্রিকেটার। তাদের অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে ছিলেন বিসিবির পরিচালক জালাল ইউনুস, ইসমাইল হায়দার মল্লিক, মাহবুবুল আনাম ও প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরী। এছাড়া ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এমপিও ছিলেন। বিমানবন্দরে নেমে খুব বেশি কথা বলেননি মাশরাফি। বরং তিনি জানালেন, ট্রাইনেশন কাপ জয় টিমের সব সদস্যের সাফল্যের ফসল। তাই তাদের ছাড়া অনানুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য নয়। যারা ট্রফি জিততে ভূমিকা রেখেছে, তারাই কথা বলার দাবি রাখে। আমি না।
×