ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিমান বলছে সময় লাগবে, ’২১ সালের আগে ফ্লাইট চালু সম্ভব নয়

প্রেস্টিজিয়াস নিউইয়র্ক রুটে কবে চালু হবে ফ্লাইট

প্রকাশিত: ০৯:৫২, ১৯ মে ২০১৯

 প্রেস্টিজিয়াস নিউইয়র্ক রুটে কবে চালু হবে ফ্লাইট

আজাদ সুলায়মান ॥ কোন পরিকল্পনা ছাড়াই ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে হঠকারী এক সিদ্ধান্তে বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিমানের নিউইয়র্ক ফ্লাইট। আজও চালু করা যায়নি ওই রুট। বন্ধ রুট চালু করা যে কতটা জটিল ও কঠিন, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সিভিল এভিয়েশন। এ নিয়ে এক যুগ ধরেই চলছে কাঠখড় পোড়ানো। অথচ একের পর এক শর্ত দিচ্ছে এফএএ। বেবিচক রবিবারই সব শর্ত পূরণ করে চলছে। সর্বশেষ গত মাসেও আরও একটি অডিট হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফএএ) একটি টিম ঢাকায় এসে সিভিল এভিয়েশনের সর্বশেষ অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেছে। তারা সন্তোষজনক বলে উল্লেখ করেছে। অথচ অবস্থা তথৈবচ। এখন আরও অগ্রগতি প্রতিবেদন নিয়ে বেবিচক টিম যাবে নিউইয়র্ক। ওই প্রতিবেদন ইতিবাচক হলে তারা আবার চূড়ান্ত অডিটের তারিখ ঘোষণা করবে। ওই অডিটে উতরে গেলেই মার্কিন এভিয়েশন এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফএএ) সব শর্ত পূরণ হয়েছে বলে দাবি করতে পারবে সিভিল এভিয়েশন। এমন দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ায় আটকে আছে নিউইয়র্ক ফ্লাইট। কবে নাগাদ এই প্রতীক্ষার অবসান ঘটবে- এই প্রশ্ন যখন ঘুরপাক খাচ্ছে তখন বিমান বলছে আগামী ’২১ সালের আগে নিউইয়র্ক যাওয়া হবে না। নিউইয়র্ক ফ্লাইটের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে সংসদীয় কমিটির কাছে দাখিলকৃত এক প্রতিবেদনে বিমান বলেছে, ’২১ সালের আগে বিমানের ফ্লাইট চালু করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। এ জন্য অনেক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে, যা রাতারাতি সম্ভব নয়। জানা গেছে, বিমান বরাবরই বলছে বেবিচক এখনও ক্যাটাগরি-১-এ উন্নীত না হওয়ায় নিউইয়র্ক ফ্লাইট এখনই চালু হচ্ছে না। এর জন্য ’২১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। গত সপ্তাহে সংসদ ভবনে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তৃতীয় বৈঠকে এ তথ্য জানায় বিমান। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ বিমান ডিসি ১০ উড়োজাহাজ দিয়ে নিউইয়র্কে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে। ২০০৬ সালে লোকসানের অজুহাতে সেটা বন্ধ করা হয়। ওই কমিটির সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফএএ) সেফটি অডিট অনুযায়ী বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বর্তমানে ক্যাটাগরি-টু-এর আওতাভুক্ত হওয়ায় নিউইয়র্কে এই মুহূর্তে বিমানের ফ্লাইট পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। বেবিচক সূত্র জানিয়েছে, নিউইয়র্ক ফ্লাইট কতটা বাণিজ্য নির্ভর হবে এ নিয়ে বিমান বরাবরই সন্দিহান। মূলত এ রুটের প্রতিটি ফ্লাইটে লোকসান হতো বলেই ২০০৬ সালে সেটা বন্ধ করে দেয়া হয়। সর্বশেষ ফ্লাইটে ৩২ লাখ টাকা লোকসান হয়েছিল বলে জানায় বিমানের একটি সূত্র। এ কারণে এটা চালু করার বিষয়ে বিমান ততটা আগ্রহী নয়। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এ ফ্লাইট নিয়ে বরাবরই আগ্রহ প্রকাশ করে আসছেন। তিনি যতবারই নিউইয়র্ক সফর করেছেন, ততবারই প্রবাসী বাংলাদেশী ও দলীয় নেতাকর্মীদের প্রচন্ড দাবির মুখে পড়েছেন। বারবারই তাদের আশ্বস্ত করতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন বলে ইতিবাচক সাড়াও দিয়েছেন তিনি। এ কারণেই সিভিল এভিয়েশন বেশ তৎপর। সিভিল এভিয়েশনের ফ্লাইট সেফটি বিভাগের পরিচালক উইং কমান্ডার চৌধুরী জিয়াউল কবীর গত কয়েক বছর ধরেই এ নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন। ধাপে ধাপে তিনি বেশ এগিয়েছেনও। মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালুর বিষয়ে এতদিন খুব একটা আগ্রহ ছিল না বিমানের। বেবিচকের তৎপরতাও ছিল ঢিলেঢালা। কিন্তু বার বার সরকারের আগ্রহ ও চাপের ফলে ’১৮ সাল থেকে নব উদ্যমে সক্রিয় হয়ে ওঠে বেবিচক। যে কোন মূল্যে নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালু করতে হবে- এমন প্রত্যয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন এ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) দেয়া একের পর এক শর্ত পূরণে কার্যকর পদ্েক্ষপ নিতে শুরু করে। এজন্য প্রথমেই বেসামরিক বিমান চলাচল আইন প্রণয়ন করা হয়। এরপর বেবিচকের জন্য সময়োপযোগী অর্গানোগ্রাম চূড়ান্ত করা হয়, যা এখন অনুমোদনের অপেক্ষায়। ওই বছর এফএএ অডিট টিম ঢাকায় আসে। তারা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি ও সংস্কার পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় অন্যান্য ইস্যু পর্যালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে ইতিবাচক অভিমত দেয়া হয়। এ সময় আরও কিছু বিষয় পর্যবেক্ষণের জন্য অপেক্ষায় রাখা হয়। গত দু’বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিউইয়র্ক ফ্লাইটের জটিল প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার জন্য সেভাবেই প্রস্তুতি নেন পরিচালক উইং কমান্ডার চৌধুরী জিয়াউল কবীর। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ইতোমধ্যে নেয়া সব পদক্ষেপই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হচেছ। এখন দিন তারিখ পাওয়া গেলেই আমরা ঢাকা থেকে য্ক্তুরাষ্ট্র গিয়ে এফএএকে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করব। এ জন্য ইতোমধ্যে ৩০২ অডিট প্রশ্নের জবাব তৈরি করা হয়েছে। এগুলো গ্রহণযোগ্য হলেই এফএএ হয়ত মাস দুয়েকের মধ্যে ফের ঢাকায় এসে আরেক দফা অডিট করবে। এরপর আরও একটা চূড়ান্ত অডিট হবে। এ পর্যন্ত যে অগ্রগতি হয়েছে এবং সামনের দুটো অডিট যদি সফলতার সঙ্গে উতরানো যায় তাহলে আর কোন বাধা থাকে না। যদিও সর্বশেষে হয়ত এফএএ আমাদের বিমানবন্দর ও বিমানের প্রস্তুতি দেখার মতো রুটিন ভিজিট করতে পারে। এ দিক থেকেও আমাদের সেই প্রস্তুতি রয়েছে। নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালুর সম্ভাবনা সম্পর্কে সামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মহিবুল হক জানান, আমরা শতভাগ আশাবাদী আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই বেবিচক ক্যাটাগরি-১-এ উন্নীত হবে। এটি না হওয়ায় বহরে ড্রিমলাইনারসহ আধুনিক উড়োজাহাজ থাকলেও নিউইয়র্কে ফ্লাইট চালু করতে পারছে না বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। ক্যাটাগরি ‘এ’ না হলে কোন দেশের উড়োজাহাজ যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চলাচল করতে পারে না। আমরা ইতোমধ্যে এ যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছি। ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, বেবিচকের ক্যাটাগরি-১-এ উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে সিগনিফিকেন্ট সেফটি কনসার্নের (এসএসসি) প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠা গেছে। আমরা অবশ্যই সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সরকার প্রধান যেখানে এ বিষয়ে আগ্রহী সেখানে কারোর পক্ষে তো গাফিলতি বা ঔদাসিন্যের কোন সুযোগ নেই। আমি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলতে চাই আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। নিরাপত্তাজনিত সব ধরনের প্রযুক্তিগত ও অবকাঠামোগত সুবিধা আমরা নিশ্চিত করেছি। এখন সবই নির্ভর করছে এফএএ’র সিদ্ধান্তের ওপর। তারা যদি ‘ওকে’ করে তাহলেই হয়ে যাবে। আশা করছি এ বছরে না হলে আগামী বছরের মাঝামাঝি বিমানের ফ্লাইট চালু করা সম্ভব। আগামী সেপ্টেম্বরে যে ড্রিমলাইনার আসবে সেটা দিয়েই নিউইয়র্ক চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী ’২১ সালের আগে নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালু সম্ভব নয় বিমানের প্রতিবেদনের বিষয়ে মন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে এমন একটা বক্তব্য এসেছে। তবে আমি মনে করি নিউইয়র্কে বর্তমানে ৯ লাখ বাংলাদেশীর বসবাস। তাদের প্রচন্ড চাপ ও দাবি রয়েছে- এটা চালু করতেই হবে। সেভাবেই কাজ এগিয়ে চলছে। এদিকে নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালুর অনুমতি পেলেও বিমানের পক্ষে বাণিজ্যিকভাবে কতটা সফল হওয়া সম্ভব- তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান দেশের এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্য মতে, যে লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বিমান এ রুট বন্ধ করেছিল ওই অজুহাত তো এখনও রয়েই গেছে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরীর মতে, সব কিছু লাভ লোকসানের দৃষ্টিতে হিসাব কষে অঙ্ক মেলানো যাবে না। এভিয়েশন বিশ্বে নিউইয়র্ক একটা প্রেস্টিজিয়াস রুট। পৃথিবীর হাতেগোনা কয়েকটা দেশের এয়ারলাইন্স সরাসরি নিউইয়র্ক ফ্লাইট অপারেট করতে সক্ষম। বাংলাদেশেরও সেই গৌরবময় অধ্যায় ছিল। কিন্তু তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত আমলে হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বন্ধ করা হয়, যা ছিল একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এখন সেটা চালু করতে গিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে। আর ব্যবসায়িক সাফল্য বলতে কি শুধু মোটা দাগের লাভ বোঝায়। এয়ারলাইন্সগুলো তো মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে শুধু ব্র্যান্ড ইমেজের জন্য। নিউইয়র্ক যেতে পারাটাইও তো একটা বড় ব্র্যান্ড ইমেজ। বিমান সেটা এক কলমের খোঁচায় ধ্বংস করেছে। বিলম্বে হলেও বিমান এখন তা অনুধাবন করতে পারছে। আমার তো মনে হচ্ছে এমন একটা প্রেস্টিজিয়াস রুট চালু করা কত জরুরী তা একমাত্র প্রধানমন্ত্রীই অনুধাবন করছেন।
×