ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতার পর থেকে যারা খেলাপী তারাও সুবিধা পাচ্ছেন;###;খেলাপীদের আগের অনারোপিত সব সুদ মাফ;###;প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী সিদ্ধান্তের জন্য শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের ধন্যবাদ

ঋণ খেলাপী থাকবে না ॥ নীতিমালায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে

প্রকাশিত: ০৯:৫১, ১৯ মে ২০১৯

ঋণ খেলাপী থাকবে না ॥ নীতিমালায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে

রহিম শেখ ॥ গত বছর ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানোর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার ফলে চারটি বিশেষ সুবিধা পেয়েছিলেন দেশে কার্যরত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মালিকরা। এবারও প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বিশেষ সুবিধা দেয়া হলো ঋণখেলাপী ও ভাল ঋণগ্রহীতাদের। যার মধ্যে ছোট, মাঝারি বা বড়- সব ঋণখেলাপীই পুনঃতফসিলের সুযোগ পাবেন। ঋণখেলাপীদের আগের অনারোপিত সব সুদ মাফ করে দেয়া হবে। আগামী ১০ বছর মেয়াদে তারা ৯ শতাংশ সুদে এই ঋণ পরিশোধের সুযোগ পাবেন। এদিকে নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারী ভাল গ্রাহকদের পুরস্কার হিসেবে দেয়া হবে সনদ, প্রকাশ করা হবে তাদের ছবি। পরিশোধিত সুদের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মওকুফ করা হবে। ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়েই গত বৃহস্পতিবার দুটি বিশেষ নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকিং খাতে এ ধরনের ইতিবাচক নীতিমালা জারি করায় দেশের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তাদের মতে, এটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের বিদ্যমান সঙ্কটগুলো সমাধানের পাশাপাশি ঋণখেলাপী মুক্ত হবে ব্যাংকিং খাত। জানা গেছে, ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ঋণ চাহিদা ব্যাপক বেড়ে যাওয়ায় তা নিয়ন্ত্রণে গত বছরের ৩০ জানুয়ারি ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) কমিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন অনেক ব্যাংক ডাবল ডিজিট সুদে আমানত নিতে শুরু করে। এ রকম পরিস্থিতিতে সুদহার কমানোর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর বেশকিছু বিশেষ সুবিধা পান ব্যাংক মালিকরা। যেমন- ব্যাংক ব্যবসার কর্পোরেট কর কমানো হয় ২ দশমিক ৫ শতাংশ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বেসরকারী ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার (সিআরআর) কমানো হয় ১ শতাংশ, টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকা এবং এক পরিবারের চারজনকে ব্যাংকের পর্ষদে থাকার সুযোগ দিয়ে সংশোধন করা হয় ব্যাংক কোম্পানি আইন। এছাড়া ৫০ ভাগ পর্যন্ত সরকারী আমানত গ্রহণের সুযোগও দেয়া হয় বেসরকারী ব্যাংক মালিকদের। এবার প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বিশেষ সুবিধা দেয়া হলো ঋণখেলাপী ও ভাল গ্রহীতাদের। গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দুটি নীতিমালা জারি করে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) কাছে পাঠানো হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী, নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করলে ভাল গ্রাহকরা বছর শেষে মোট সুদের ওপর ১০ শতাংশ ছাড় পাবেন। প্রতি বছর সেরা ১০ গ্রাহকের ছবিসহ বুকলেট বা ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে হবে। ব্যাংকের বার্ষিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের দিতে হবে সম্মাননা সনদ ও ভাল গ্রাহকের স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কার। ভাল গ্রাহকদের এসব সুবিধা পেতে ব্যাংকের কাছে কোন আবেদনের প্রয়োজন নেই। ব্যাংক নিজ উদ্যোগে ভাল গ্রাহকদের শনাক্ত করে মূল্যায়ন করবে। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন নীতিমালার ফলে ভাল গ্রাহকরা যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি তারা ভাল গ্রাহকের মর্যাদা ধরে রাখতে উৎসাহিত হবেন। তেমনি যারা এখন ঋণখেলাপী তারাও ভবিষ্যতে ভাল গ্রাহক হওয়ার চেষ্টা করবেন। এদিকে ঋণখেলাপীরা এ দফায় সুযোগ নিয়ে পরে তাদের ভালভাবে ব্যবসা চালিয়ে নিয়মিত ব্যাংকের দেনা শোধে উৎসাহিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে তাদেরও এক সময় ভাল গ্রাহক হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। এতে খেলাপী ঋণ কমে যাবে। আর্থিক খাতে বাড়বে ভাল ঋণগ্রহীতার সংখ্যা। ফলে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যাংকিং খাতে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি ওসামা তাসীর জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকিং খাতে এ ধরনের ইতিবাচক নীতিমালা জারি করায় ব্যবসায়ী মহলের পক্ষ থেকে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিকে বিচক্ষণতার সঙ্গে শক্তভাবে না ধরলে সবার জন্য কল্যাণমুখী এমন নীতিমালা জারি করা সম্ভব হতো না। তিনি আরও বলেন, এটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের বিদ্যমান সঙ্কটগুলো আর থাকবে না। নীতিমালায় ভাল গ্রাহকদের কিভাবে চিহ্নিত করা হবে সে বিষয়েও একটি দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, ভাল ঋণগ্রহীতাদের প্রণোদনা দেয়ার ক্ষেত্রে নিম্নরূপ নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে- চলমান, তলবি ও মেয়াদী ঋণের ক্ষেত্রে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর শেষে বিগত ১২ মাসে (অর্থাৎ বিগত বছরের ১ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) ভাল গ্রাহকের ঋণের বিপরীতে আদায়কৃত সুদ বা মুনাফার কমপক্ষে ১০ শতাংশ রিবেট বা ছাড় দিতে হবে। পরে প্রতি বছর একই ব্যক্তি ভাল গ্রাহক হিসেবে চিহ্নিত হলে এ সুবিধা অব্যাহত থাকবে। এছাড়াও ভাল গ্রাহককে প্রয়োজন মতো বাড়তি ঋণ সুবিধাও দেয়া যাবে। এ নীতিমালার আলোকে ব্যাংকের পর্ষদ ভাল গ্রাহকদের প্রণোদনা দেয়ার ব্যাপারে একটি নীতিমালা তৈরি করবে। এ নীতিমালা মেয়াদী ঋণগ্রহীতার ঋণ হিসাব বিগত ১ বছরের মধ্যে সব কিস্তি নির্ধারিত তারিখের মধ্যে নিয়মিতভাবে পরিশোধিত হলে এবং সংশ্লিষ্ট বছরের সেপ্টেম্বর ও এর আগের ৪টি ত্রৈমাসিকে ঋণ নিয়মিত থাকলে তিনি ভাল গ্রাহক হিসেবে বিবেচিত হবেন। এ নীতিমালা প্রতিটি শাখায় সহজে দৃষ্টিগোচর হয় এমন স্থানে প্রদর্শন করতে হবে। ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী ভাল গ্রাহকদের বিশেষ সুবিধা (রিওয়ার্ড পয়েন্ট, ডিসকাউন্ট সুবিধা ইত্যাদি) প্রদান করতে হবে। প্রতি বছর ব্যাংক থেকে দিতে হবে বিশেষ সনদ। ব্যাংকের সেরা ১০ জন ভাল গ্রাহকের ছবিসহ তাদের ব্যবসা সফলতার সংক্ষিপ্ত চিত্র প্রকাশ করতে হবে ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে। এছাড়া কোন গ্রাহক দীর্ঘ সময় ধরে ভাল ঋণগ্রহীতা থাকলে সেই গ্রাহকদের ছবি, প্রোফাইল ইত্যাদির সমন্বয়ে ব্যাংক থেকে বিশেষ বুকলেট বা ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে হবে। ব্যাংকগুলো বার্ষিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভাল ঋণগ্রহীতাদের স্বীকৃতি বা পুরস্কার প্রদান করে তাদের সম্মাননা জানানোর ব্যবস্থা করতে পারে। ভাল গ্রাহকদের দেয়া রিবেট সংক্রান্ত তথ্য প্রতি হিসাব বর্ষ শেষে পরবর্তী বছরের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণখেলাপীদের ঋণ নবায়নে বিশেষ নীতিমালায় প্যাকেজ সুবিদা দেয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে যারা ঋণখেলাপী তাদের এককালীন এক্সিট সুবিধা দেয়া হবে। এক্ষেত্রে তাদের খেলাপী ঋণের হিসাব হবে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরের এককালীন হিসাবায়ন ভিত্তিতে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের পর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যত খেলাপী ঋণ আছে তার হিসাব করা হবে। কোন ঋণখেলাপী যদি মনে করে এককালীন ঋণ পরিশোধ করে খেলাপীর তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবেন, তাহলে সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে সার্কুলারে। এতে বলা হয়েছে, ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে ঋণখেলাপীরা ঋণ পরিশোধের জন্য এক বছর পর্যন্ত সময় পাবেন। আগের সব সুদবাবদ পাওনা মওকুফ করা হবে। এককালীন পরিশোধের জন্য সুদহার আরও কম- ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ডের সমান। তবে এক বছরের মধ্যে টাকা পরিশোধ না করলে সুবিধা বাতিল হবে। এই এককালীন এক্সিট সুবিধা ও পুনঃতফসিল সুবিধা কার্যকরের ৯০ দিনের মধ্যে ব্যাংক ও গ্রাহকের মামলা স্থগিত করতে হবে। পরবর্তীতে গ্রাহক কোন শর্ত ভঙ্গ করলে সুবিধা বাতিল করে মামলা পুনরায় চালু হবে। নীতিমালায় বলা হয়, এতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক ঋণখেলাপীরা সুযোগ পাবেন। ছাড় গ্রহণের জন্য আগামী ৯০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ১৬ আগস্টের মধ্যে খেলাপীর আবেদন করতে হবে। ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে আগামী ১০ বছর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের সুযোগ পাবেন। তবে প্রথম এক বছর কোন টাকা পরিশোধ করতে হবে না। পুনঃতফসিলকৃত ঋণের সুদহার হবে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বা ব্যাংকের কস্ট ফান্ডের সঙ্গে ৩ শতাংশ যোগ করে। খেলাপী ঋণের সুদ ব্যাংক আয় দেখাতে পারে না। তাই পৃথক হিসেবে রাখতে হয়। পৃথক হিসেবে রাখা সব সুদ মাফ করে দেয়া হবে। এই সুবিধা গ্রহণকারীরা ব্যাংক থেকে আবার নতুন করে ঋণ নিতে পারবেন। প্রচলিত নিয়ম মেনে সতর্কতার সঙ্গে ঋণ দিতে বলা হয়েছে। নতুন ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলে পুনঃতফসিল সুবিধা বাতিল হবে। সুবিধাগ্রহণের পর নিয়মিত অর্থ পরিশোধ না করলেও তাদের খেলাপী করা যাবে না। ৯টি মাসিক কিস্তির ৩টি এবং ত্রৈমাসিক ৩ কিস্তির ১টি পরিশোধ না করলেও নিয়মিত থাকা যাবে। তবে মাসিক কিস্তির মধ্যে ৬টি ও ত্রৈমাসিক কিস্তির ২টি পরিশোধ না করলে পুনঃতফসিল সুবিধা বাতিল করা হবে।
×