ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাচারকারী চক্রের ফাঁদে এক দশকে লাখ তরুণ প্রতারিত

প্রকাশিত: ১০:৩৭, ১৮ মে ২০১৯

 পাচারকারী চক্রের ফাঁদে এক দশকে  লাখ তরুণ প্রতারিত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ইউরোপে বিকশিত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েই তরুণ বেকারদের টার্গেট করছে মানবপাচারকারীরা। কোনক্রমে দেশের সীমানা পার করতে পারলেই শুরু হয় প্রতারণা, মুক্তিপণ আদায় আর চাঁদাবাজির কৌশল। এক দশকে অন্তত এক লাখ তরুণ প্রতারণার শিকার হয়েছে মানবপাচারকারীদের চক্রের পাতা ফাঁদে। এর মধ্যে শুধু ভূমধ্যসাগরেই সলিল সমাধি ঘটেছে অন্তত ২ হাজার যুবকের। ঢাকা থেকে শ্রীলঙ্কা ও লিবিয়া হয়ে ইউরোপে পাঠানোর নামে একেক জনের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে অন্তত ৭/৮ লাখ টাকা করে। অনেক যুবক ভূমধ্যসাগরের নীলাভ শীতল জলে হারিয়ে গেলেও সে কথা জানতে পারেনি স্বজনরা। এমন সব ভয়ঙ্কর তথ্য বেরিয়ে এসেছে র‌্যাবের অভিযানে ধরা পড়া তিন মানবপাচারকারীর কাছ থেকে। বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুটি পাচারকারী চক্রের তিন সদস্যকে আটক করে র‌্যাব-১। এরা হলো আক্কাস মাতুব্বর (৩৯), এনামুল হক তালুকদার (৪৬) ও আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া (৩৪)। র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে শুক্রবার এসব তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান। তিনি জানান- সম্প্রতি লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে অভিবাসীবাহী একটি নৌকা ডুবে অন্তত ৩৯ বাংলাদেশী নিখোঁজ হন এবং জীবিত উদ্ধার হন ১৪ জন। এ ঘটনার পর নতুন করে সমালোচনায় আসে বাংলাদেশ বিশেষ করে নৌপথে মানবপাচারের বিষয়টি। ঘটনা তদন্তে নামে র‌্যাব। তদন্তে ইউরোপে মানবপাচারের সঙ্গে দেশজুড়ে অন্তত ১০-১৫ চক্রের তথ্য পায় র‌্যাব-১ ব্যাটালিয়ন। এর মধ্যে ৫/৬ চক্রের মাধ্যমে পাচার হওয়া বাংলাদেশীরা সেদিন নৌ দুর্ঘটনায় পতিত হন। এ চক্রের সদস্যরা ইউরোপে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রথমে দেশজুড়ে লোক সংগ্রহ করে। তারপর সেসব লোককে সড়ক, বিমান মিলিয়ে তিনটি রুটে লিবিয়ায় পাঠায়। সর্বশেষ লিবিয়া থেকে নৌপথে তিউনিশিয়ার উপকূল হয়ে ইউরোপে পাঠায়। অর্থের বিনিময়ে অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার পুরো প্রক্রিয়ায় নৌপথে ঝুঁকির বিষয়গুলো জানানো হয় না। নৌপথে নেয়ার পর শুরু হয় কালক্ষেপণ। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লাগে দুই মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত। র‌্যাব জানায়, ইউরোপে পাচারে তিনটি ব্যবহৃত রুট হলো বাংলাদেশ-ইস্তানবুল (তুরস্ক)-লিবিয়া, বাংলাদেশ-ভারত-শ্রীলঙ্কা (৪/৫দিন অবস্থান)- ইস্তানবুল (ট্রানজিট)-লিবিয়া এবং বাংলাদেশ-দুবাই (৭-৮ দিন অবস্থান)-আম্মান (জর্দান) (ট্রানজিট)-বেনগাজী (লিবিয়া)-ত্রিপলি (লিবিয়া)। এ ক্ষেত্রে সড়কপথ ও বিমানপথ ব্যবহার করে লিবিয়ায় পৌঁছানো হয়। সর্বশেষ লিবিয়া থেকে নৌপথে তিউনিশিয়ার উপকূল হয়ে ইউরোপে পাচার করা হয়। মুফতি মাহমুদ খান বলেন- গত ৯ মে অবৈধ পন্থায় ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ হন ৮৫-৯০ জন। এদের মধ্যে বাংলাদেশী ছিলেন ৩৯। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভিকটিমের স্বজনরা শরীয়তপুরের নড়িয়া ও সিলেটের বিশ্বনাথ থানায় দুটি মামলা করেছেন। মামলার ছায়া তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে দুইটি চক্রের তিনজনকে আটক করা হয়। তারা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ এ কর্মকা- চালিয়ে আসছিল। তারা প্রথমে বিদেশে গমনেচ্ছু নির্বাচন করে, পরের ধাপে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া এবং সর্বশেষ ধাপে লিবিয়া থেকে তাদের নৌপথে ইউরোপে পাঠানো হয়। ভিকটিমদের পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকেট ক্রয় সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়। ইউরোপে পৌঁছে দিতে তারা ৭/৮ লাখ টাকা নির্ধারণ করে, যার মধ্যে সাড়ে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা লিবিয়ায় পৌঁছানোর আগে এবং বাকি টাকা লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাত্রার আগে পরিশোধ করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ২ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত সময় লাগে। এর মধ্যে অধিকাংশ টাকা পরিশোধ হয়ে যায়, যার ফলে ইচ্ছা থাকলেও ভুক্তভোগীরা আর ফেরত আসতে পারেন না । তিনি বলেন, ভিকটিমরা ত্রিপোলিতে পৌঁছার পর সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশী কথিত ‘গুডলাক ভাই’সহ আরও কয়েক এজেন্ট তাদের গ্রহণ করে। তাদের ত্রিপোলিতে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করানো হয়। এ সময় ভিকটিমদের স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে থাকে চক্রটি। সেখানকার সিন্ডিকেট সমুদ্রপথে অতিক্রম করার জন্য নৌযান চালনা এবং দিকনির্ণয় যন্ত্র পরিচালনাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ের ওপর নানা প্রশিক্ষণ দেয়। একটি নির্দিষ্ট দিনে ভোরে একসঙ্গে কয়েকটি নৌযান লিবিয়া হয়ে তিউনিশিয়া উপকূলীয় চ্যানেলের হয়ে ইউরোপে রওনা দেয়। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথে ভিকটিমরা ভূমধ্যসাগরে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হন। গত ৯ মে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ বাংলাদেশীরা সিলেট, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, কিশোরগঞ্জ ও নোয়াখালীর বাসিন্দা বলে জানা গেছে। তারা ৫/৬ চক্রের মাধ্যমে ইউরোপে যাচ্ছিলেন। তবে আটক চক্রের ৩ সদস্যের মাধ্যমে কতজন সেখানে গেছেন বিষয়টি এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি র‌্যাব। তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। এ ছাড়া, দেশজুড়ে ১০-১৫ চক্রের খবর রয়েছে র‌্যাবের কাছে। তাদের আইনের আওতায় আনতে র‌্যাব মাঠে সক্রিয়।
×