ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অপেশাদারদের হাতে টিভি চ্যানেল, অনুষ্ঠানের মান নিম্নমুখী

প্রকাশিত: ১০:০৯, ১৮ মে ২০১৯

  অপেশাদারদের হাতে টিভি চ্যানেল, অনুষ্ঠানের মান নিম্নমুখী

গৌতম পান্ডে ॥ বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের কিংবদন্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন ছিল ২৫ বৈশাখ ইংরেজী ৮ মে বুধবার। এদিন সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে চোখ রেখে দেখা যায়, কোনটিতে চলছে ধারাবাহিক নাটক ‘শান্তিপুরিতে অশান্তি’, বাংলা সিনেমা ‘জামাই শ্বশুর’ আবার কোনটিতে রান্নার অনুষ্ঠান, যথারীতি টক শো, খবরসহ নানা রকম অনুষ্ঠান। সর্বজনীন কবি রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষা সাহিত্যকে নিয়ে গেছেন বিশ্ব দরবারে, কিন্তু তাকে নিয়ে এদিন তেমন কোন উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান টিভি চ্যানেলে দেখা যায়নি। দেশে ৩০টিরও বেশি টিভি চ্যানেলের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি চ্যানেল নাটক, টেলিফিল্ম, নাচ, গান, আবৃত্তি ও আলোচনায় সীমাবদ্ধ ছিল এদিন। দীপ্ত টিভিতে টান টান উত্তেজনার তুর্কী ধারাবাহিক ‘এইযেল’ দেখছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী রেবেকা আক্তার। তিনি বিদেশী এই সিরিয়ালটি প্রতিদিন নিয়ম করে দেখেন। কেন তিনি বিদেশী এই সিরিয়াল দেখেন- এমন প্রশ্নের জবাবে রেবেকা বলেন, রহস্যে ঘেরা এর কাহিনী আমার ভাল লাগে। বাংলাদেশে বর্তমানে এ ধরনের কিছুই তৈরি হয় না। আর যেগুলো হয় সেগুলো রহস্য বলব নাকি ফানি বলব সেটা আমি বুঝতে পারি না। দর্শকের মতামতের ভিত্তিতে দেখা গেছে, অধিকাংশ দর্শক দেশের টেলিভিশনের অনুষ্ঠানই দেখতে চান। কিন্তু তারা পছন্দের তেমন কোন কিছুই পান না বলে অভিযোগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরমান বলেন, আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো প্রায়ই একই ধারার অনুষ্ঠান প্রচার করে আসছে। সন্ধ্যায় প্রায় একই সময়ে সব টিভি চ্যানেলই সংবাদ প্রচার করে। রাতে প্রায় একই সময়ে টকশো অথবা গানের অনুষ্ঠান প্রচার হয়। দুপুরেও একই সময়ে অধিকাংশ টিভি চ্যানেলে খবর প্রচার হয়। বিকেলে সিনেমা দেখায় প্রতিটি চ্যানেল। এমনকি একই সময়ে নির্ধারিত কোন পণ্যের বিরক্তিকর বিজ্ঞাপনও প্রচার হয় একাধিক টিভি চ্যানেলে। ফলে দর্শক বৈচিত্র্য খুঁজে পায় না। তার মতে, টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য দরকার। টিভি চ্যানেলের এমন নিম্নমুখিতার জন্য মানসম্পন্ন অনুষ্ঠানের অভাব, যোগ্যতা সম্পন্ন নির্মাতার অভাব ও টিভি চ্যানেল মালিকদের পরিকল্পনার অদূরদর্শিতাকেই দায়ী করেছেন অনেকে। মান কেন খারাপ ॥ আমাদের টিভি চ্যানেলের মান নিম্নমুখী হওয়ার কারণ জানতে চাইলে টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব খ ম হারুন বলেন, মানের দিক হিসাব করলে আমাদের দেশের টেলিভিশন চ্যানেলের মান অবশ্যই নিম্নমুখী। সেটা নিউজ বা অন্য কোন প্রোগ্রাম যা-ই হোক না কেন। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, সরকার বিভিন্ন সময়ে টেলিভিশন মালিকদের যে লাইসেন্স দিয়েছে, পরবর্তীতে সেসব লাইসেন্স বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে হস্তান্তর হয়েছে। যাদের অনেকেরই টেলিভিশন মাধ্যম সম্পর্কে ভাল কোন ধারণা নেই। টিভি চ্যানেল একটা অত্যন্ত সেনসিটিভ জায়গা। এখানে কাজ করলে তাকে হাইলি প্রফেশনাল হতে হবে। শুধুমাত্র টিভি মালিকদের অদক্ষতার কারণে চ্যানেলে অদক্ষ লোক ঢুকে পড়েছেন। আলটিমেটলি এতে চ্যানেল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মালিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সে কারণেই আমাদের টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ হওয়ার পথে। টেলিভিশন চ্যানেল চলে গেছে ননপ্রফেশনালদের হাতে। চ্যানেল মালিকরাও টেলিভিশন বোঝেন না। যার জন্য কোন ভাল অনুষ্ঠান হচ্ছে না। আগে এক সময় বলা হতো, বিটিভির খবর সরকারের কথা বলে কিন্তু প্রোগ্রামগুলো ভাল হয়। সেইসব প্রোগ্রাম নিয়ে মানুষ এখনও আলোচনা করে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন বেসরকারী চ্যানেল ভাল একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান তৈরি করতে পারেনি। টেলিভিশন চ্যানেল একটি আরেকটির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে কিন্তু এখন টিভি চ্যানেলকে পাল্লা দিতে হয় সোস্যাল নেটওয়ার্কের সঙ্গে। এই বহুমুখী প্রতিযোগিতার মধ্যে টিভি চ্যানেলকে টিকে থাকতে হবে। যদি ভাল করতে না পারে, বিজ্ঞাপন পাবে না। চ্যানেলের একমাত্র ইনকাম হচ্ছে বিজ্ঞাপন। এমন কিছু অনুষ্ঠান থাকতে হবে যা দর্শককে আকর্ষণ করে। দর্শক কেন টিভির অনুষ্ঠান দেখবে? এখন কি কোন গবেষণামূলক অনুষ্ঠান হয়? দর্শক জরিপ করে কোন প্রোগ্রাম করা হয়? তারা দীর্ঘদিন ধরে একই প্রোগ্রাম করছেতো করছেই। অনলাইন, ইউটিউব, আইফ্লিক্স, বায়োস্কোপসহ বিভিন্ন মাধ্যমের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। যে প্রতিযোগিতা আমাদের টিভি চ্যানেল করতে পারছে না। বাংলাদেশ টেলিভিশন একমাত্র বিজ্ঞাপনের টাকায় চলে না। তাদের আলাদা ইনকাম আছে। তারা কিন্তু ভাল ভাল প্রোগ্রাম করে যেতে পারে। আমি মনে করি আগামীতে বাংলাদেশ টেলিভিশনই টিকে থাকবে, অন্য প্রাইভেট চ্যানেলের টিকে থাকতে খুবই মুশকিলে পড়তে হবে। এর থেকে উত্তরণের পথ কি এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের দেশের টেলিভিশন চ্যানেল এখন আইসিউতে ঢুকে গেছে। এখান থেকে বের হওয়া সহজ কথা নয়। যারা পারছে না তারা চ্যানেল বন্ধ করে দিক। যাদের মেধা আছে এবং প্রফেশনাল লোক তাদের টিভি চ্যানেলে দেয়া হোক। আমার মনে হয় তারা কম পয়সায় ভাল কাজ করতে পারবেন। বাংলাদেশে বেসরকারী কয়েকটি চ্যানেলে প্রচার হয় বিদেশী সিরিয়াল। যেগুলো বাংলায় ডাবিং করে সম্প্রচার হচ্ছে। এসব বিদেশী সিরিয়াল বন্ধের দাবি জানিয়েছেন শিল্পী-কলা-কুশলীরা। একই সঙ্গে বাংলাদেশী বিজ্ঞাপন বিদেশী চ্যানেলে প্রচার না করার প্রতি জোর দিচ্ছেন তারা। একটি স্কুলের শিক্ষিকা মারিয়া আহমেদ বলছিলেন, দর্শকের পছন্দের দিকে যদি নির্মাতারা গুরুত্ব দিয়ে অনুষ্ঠান নির্মাণ করেন, তাহলে বিদেশী সিরিয়াল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে দর্শক। বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান সম্পর্কে দর্শকদের পছন্দ অপছন্দ জানানোর প্রাতিষ্ঠানিক কোন প্ল্যাটফর্ম নেই। গৃহিণী রমা মোস্তফা বলছিলেন, দর্শক মতামতকে বিবেচনায় রেখে অনুষ্ঠান তৈরি না করার কারণেই বিদেশী অনুষ্ঠানের প্রতি ঝুঁকছে দর্শক। কয়েকজন দর্শক বলছিলেন বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোতে আগের থেকে মানসম্মত কিছু অনুষ্ঠান নির্মাণ হচ্ছে। তবে সেগুলোর সংখ্যা হাতেগোনা। দর্শক টিভি চ্যানেল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এ কথা মানতে রাজি নন নাগরিক টিভির অনুষ্ঠান প্রধান কামারুজ্জামান বাবু। তিনি বলেন, দর্শকের বড় একটা অংশ দেখছে বলেই আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো এখন পর্যন্ত রান করছে। এ ক্ষেত্রে পারসেপশন হয় একেক জায়গায় একেক রকম। আগে মানুষের চয়েস ছিল টেলিভিশন এখন চলে এসেছে সোস্যাল মিডিয়ায়। নেটফিলিক্স, আইফ্লিক্স, ইউটিউব দেখছে কিন্তু দিন শেষে টিভি থেকে তার গ্যাপগুলো পূরণ করছে। আমাদের দেশে যখন পলিটিক্যাল সিচুয়েশন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তখন নিউজের প্রতি মানুষের একটা আগ্রহ হয়, যখন এমন সিচুয়েশন থাকে না তখন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে টিভিতেই নাটক, গান, মুভি দেখে। এখন স্পোর্টস টেলিভিশনের বড় বিনোদন মাধ্যম হয়ে গেছে। ফলে টিভি এখন সোস্যাল ও বিনোদনের বড় মাধ্যম। তবে দর্শকের পাল্স বুঝতে হবে, তারা কোন ক্যাটাগরির কি অনুষ্ঠান পছন্দ করে। ঈদ আসছে প্রতিটি চ্যানেল ৭ দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান করবে। নিশ্চয়ই এর পেছনে রিজন আছে। যারা স্পন্সর করছে তারা জানে তাদের টার্গেট দর্শক এ ধরনের অনুষ্ঠান পছন্দ করে। আমাদের দেশের মানুষ বিনোদনপ্রিয়, এখন যে যতটা দিতে পারে। আমাদের নাটক খুবই সমৃদ্ধ। এখন বলতে পারেন দর্শক কতটা নিচ্ছে। কিছুদিন আগে ভারতের স্টার জলসা, জি বাংলার নাটক খুবই পপুলার ছিল, কিন্তু দেখবেন আস্তে আস্তে এই মোহটাও কেটে যাচ্ছে। মানুষ এখন নেটফ্লিক্স, আইফ্লিক্সের ওয়েব সিরিজ দেখছে। যে কোন নতুনের প্রতি মানুষের একটা উন্মাদনা থাকে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের দর্শক কিন্তু মাটির গন্ধ পেতে ভালবাসে। তারা নিজের গল্প পেতে পছন্দ করে। সে কারণেই আঞ্চলিক ভাষার নাটকগুলো পপুলার হচ্ছে। এতে যদিও নাটকের সাহিত্য বজায় থাকছে না। শিল্পকর্ম এখন তেমন নেই এই কারণে, একটি টিভি চ্যানেল পরিচালনা করতে মাসে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা খরচ হয়। এই টাকা আনতে হলে আমাদের বাজারের সঙ্গে থাকতে হবে। টেলিভিশন ভর্তুকি দিয়ে চলা সম্ভব না। বাংলাদেশের টিভি দর্শকের একটা বড় অংশের কাছে ভারতের বাংলা চ্যানেলগুলোর দৈনিক সোপ অপেরাগুলো জনপ্রিয়। বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে দেশী টিভি অনুষ্ঠানের চেয়ে কেন ভারতের চ্যানেল জনপ্রিয় এমন প্রশ্নের জবাবে তমা আশরাফ নামে একজন গৃহিণী বলেন, ভারতীয় চ্যানেলে বিজ্ঞাপন কম। তাছাড়া ওদের প্রতিটা অনুষ্ঠানের পেছনে ওরা প্রচুর খরচ করে, মানে ওদের কাপড় চোপড়, গৃহসজ্জা এসবে অনেক মনোযোগ দেয়, যেটা দেখতে ভাল লাগে। এর বাইরে ওদের বাচনভঙ্গিও আমার কাছে যথার্থ মনে হয়। যেমন ওরা আইছস গেছস বলে না, কিন্তু বাংলাদেশের নাটকে দেখবেন কাজের ছেলেও যে ভাষা বলে নাটকের নায়কও একই ভাষায় কথা বলে। টিভি নাটকের মান সম্পর্কে নাট্য ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, বাজেট সঙ্কট এবং বিজ্ঞাপনের দৌরাত্ম্যের কারণে টিভি নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দর্শক। তিনি বলেন, ভালর দিকে যাচ্ছে না আমাদের দেশের টিভি নাটক। নাটকে বাজেট নাই। বাজেট যত কমবে ততো নাটকের মান নিম্নমুখী হবে। এত নাটকের চাপ, ভাল শিল্পী, টেকনিশিয়ান কম যার ফলে ভাল নাটক হচ্ছে না। আবার অন্যদিকে ওয়েব সিরিজ শুরু হয়েছে। ইউটিউবে দর্শক নাটক দেখে। কাজেই মানুষের মনোযোগ ওই দিকে যাচ্ছে। ওটাতে বাজেটও বেশি। টিভির বিশৃঙ্খলাতো আছেই। আর বাংলাদেশের নাটক দর্শক কেন দেখবে? নাটক শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে পরিমাণে বিজ্ঞাপন চলে। ২০ মিনিটের নাটকে যদি ৪০ মিনিট বিজ্ঞাপন দেয়, তাহলে কে দেখবে নাটক? চ্যানেলগুলোর ভাল নাটকের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। তারা শুধু টাইমকে ভরাতে চায়। কন্টেন্ট বা বিষয়বস্তু নিয়ে তাদের ভাবনা নেই। এদিক থেকে বিটিভি এখনও একটা ভাল জায়গায় আছে, কারণ বিটিভিতে বিজ্ঞাপন কম। দেশের টিভি নাটকের উন্নয়নে সরকারের হস্তক্ষেপের বিকল্প নেই। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে আরটিভির সিইও সৈয়দ আশিক বলেন, এখনতো বিজ্ঞাপন নেই বললেই চলে। ওই কথা এখন আর কেউ বলতে পারবে না। আমরা দেখেছি যে ভাল নাটকে বিজ্ঞাপন থাকলেও দর্শক সরে যায় না। টিভি নাটকে দর্শকের আগ্রহ কমে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দর্শকের আগ্রহ কমে আসছে না। যারা ভাল নাটক বানাচ্ছে তাদের নাটক অবশ্যই দেখছে। এখন যদি আপনি নাটক বানানোর নামে আলতু-ফালতু জিনিস তৈরি করেন, তাহলে তো মানুষ দেখবে না। দর্শকের সঙ্গে তো প্রতারণা করা যায় না। দর্শককে ভাল জিনিস দিলে দেখবে, না দিলে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তবে ইদানীং দেখা যাচ্ছে টেলিভিশন নাটক না বানিয়ে তার বাইরে কিছু ব্যবসায়িক নাটক বানানো হচ্ছে। ওই জায়গায় সমস্যা। কারণ কেউ কেউ অতি লাভের জন্যে ওই কোয়ালিটির সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করছে, যার জন্যে ভাল কিছু হচ্ছে না।
×