ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালীর ত্যাগ বৃথা যেতে পারে না ॥ ১৮ মে, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ১৮ মে ২০১৯

 বাঙালীর ত্যাগ বৃথা যেতে পারে না ॥ ১৮ মে, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ১৮ মে দিনটি ছিল মঙ্গলবার। বাঙালীর মনোবল ভাঙতে ত্রাস সৃষ্টির জন্য ধ্বংসযজ্ঞের প্রথম ক’দিন মসজিদের ইমাম, গির্জার পাদ্রী, মন্দিরের পুরোহিত সাধারণ থেকে অসাধারণ সকল শ্রেণী-ধর্মের নিরীহ বাঙালীর হাজার হাজার লাশ পথে-ঘাটে ছড়িয়ে রাখল। অমানুষিক বর্বরতা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার? দুষ্কৃতকারী দমনের নামে যারা বাঙালীর কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি লুট করল, জাহাজ ভর্তি নতুন নতুন গাড়ি, টেলিভিশন, রেডিও, রেফ্রিজারেটর, এয়ারকুলার ব্যক্তিগত মালিকানায় পাচার করল, কোটি কোটি টাকার অর্থ, অলঙ্কার প্রকাশ্য মানি অর্ডার, পার্সেল অথবা পিআইএ কার্গো মারফত নিজেদের এলাকায় পাঠিয়ে দিল, হাজার হাজার অবাঙালীর হাতে মারণাস্ত্র তুলে দিয়ে অমানুষিক বর্বরতা চালাল! বিভিন্ন জেলায় লাখ লাখ বাঙালী হিন্দু-মুসলমানদের সম্পত্তি এখন অবাঙালীদের দখলে। আঠারো থেকে তিরিশ বছর বয়সের হাজার হাজার বাঙালী ছাত্র যুবককে ঘাতকরা ধরে নিয়ে গিয়েছে এবং তাদের অধিকাংশকেই মেরে ফেলেছে। জাতীয়তাবাদে উদ্দীপ্ত বাঙালী আজ হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে মুক্তি সংগ্রামের দুর্জয় অঙ্গীকারে। এই দিন গোপালগঞ্জ শহর মুক্ত করার উদ্দেশ্যে ক্যাপ্টেন জামাল ১৫০ জন যোদ্ধা নিয়ে শহরের পশ্চিম দিকে ঘোরেচর গ্রামে, কমান্ডার ওমরের নেতৃত্বে একটি দল শহরের পূর্বদিকে বেদ গ্রামে ও নওশের আলী ৩০ জন যোদ্ধা নিয়ে মানিকদাহ থেকে শহরের দক্ষিণে নবীনবাগে অবস্থান নেয়। কুমিল্লার সিঙ্গারবিল এলাকায় মুক্তিযাদ্ধারা পাক হানাদার বাহিনীর সৈন্যদের অবস্থান আক্রমণ করে। এ অভিযানে পাকবাহিনীর ৬ জন সৈন্য নিহত হয়। গৌরনদীর স্থানীয় রাজাকার মানিক রাঢ়ী ও খাদেম মিলিটারীর সহায়তায় বাটাজোড় ইউনিয়নের হরহর গ্রামের বাড়ৈপাড়ায় চালানো হয় হত্যাযজ্ঞ। শিশু থেকে বৃদ্ধকে পাকসেনারা ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বেতার ভাষণে বলেন, সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বহু বিদেশী রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করবে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেন, মুক্তিফৌজের কঠোর প্রতিরোধ ও তীব্র পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তান বাহিনী হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ ইতোমধ্যে অভাবিত ত্যাগ স্বীকার করেছে। লাখ লাখ লোক ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর গুলিতে প্রাণ দিয়েছে। গৃহহারা হয়ে পথের ভিখারি হয়েছে। সন্তানহারা মায়ের অশ্রুতে বাংলার আকাশ বাতাস আজ ভারাক্রান্ত। শহীদের রক্তে বাংলাদেশের পথ-প্রান্তর আজ রক্তগঙ্গা। তবু জাতি সংগ্রামী মনোবল হারায়নি। তিনি আরও বলেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর ত্যাগ বৃথা যেতে পারে না এবং তা বৃথা যেতে দেয়া হবে না। বাঙালীর এই অশ্রু একদিন তাদের মুখে হাসি ফোটাবেই। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের বৃহত্তম গণহত্যার ঘটনায় মুসলিম রাষ্ট্রবর্গের নীরবতা অবলম্বনে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন। পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর সহযোগী বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে মুক্তিসংগ্রাম বিরোধী ঘৃণ্য কাজ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। ধর্ম, বর্ণ ও মতাদর্শ নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তির লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করার আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, জয় আমাদের সুনিশ্চিত। কোন শক্তিই তা ঠেকাতে পারবে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পূর্ববঙ্গ থেকে ক্রমবর্ধমান উদ্বাস্তু আগমনের মুখে তার জাতীয় স্বার্থে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। আমাদের ওপর কোন পরিস্থিতি চাপিয়ে দেয়া হলে তার মোকাবেলা করতে ভারত পুরোপুরি প্রস্তুত। সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ মার্কিন সিনেটে এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধে সত্যিই যদি নিরপেক্ষ থাকতে হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রদত্ত অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তান তার নিজের জনগণের ওপর ব্যবহার করছে। নির্বাচিত নেতৃবর্গকে হত্যা ও পূর্ব বাংলার জনসাধারণের ওপর অত্যাচার চালানোর ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের বিষয় নয় বলে পাকিস্তান সামরিক সরকার যে যুক্তি দেখিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অবশ্যই উচিত তা বাতিল করে দেয়া। চিফ সেক্রেটারি, বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশের আইজি বেশ কিছু জেলা প্রশাসক ও এসপিসহ প্রাদেশিক সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করে তাদের স্থলে পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হবে মর্মে সামরিক কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পিডিপির মৌলভী ফরিদ আহমদ আওয়ামী লীগ সদস্যদের প্রকাশ্য বিচার দাবি করে বলেন, পাকিস্তানের সংহতির স্বার্থে তা করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য ১৯৪৭ সাল থেকেই চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। এই দিনে পিটিআইয়ের বরাতে ‘দৈনিক যুগান্তর’ ‘কমান্ডোদের চোরাগোপ্তা আক্রমণ বহু পাকসৈন্য খতম’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গতকাল মুক্তিফৌজের কমান্ডোরা রাজশাহীতে আকস্মিকভাবে হানা দিয়ে অন্তত ২৫ পাকিস্তানী সামরিক শিক্ষার্থীকে খতম করেছে। আহত করেছে ৭০ জনকে। ওপার বাংলাদেশ থেকে পাওয়া এক খবরে আজ বলা হয়েছে যে, কমান্ডোর মর্টার ও হালকা মেশিনগান নিয়ে আকস্মিকভাবে রাজশাহী পুলিশ লাইনে হানা দিলে উক্ত সামরিক শিক্ষার্থীদের সেনারা পাল্টা মর্টার ও ভারি কামান দাগালে কমান্ডোরা পালিয়ে যায়। তাদের কোন ক্ষতি হয়নি। আগরতলা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, মুক্তিফৌজের কমান্ডোরা গতকাল ও আজ বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব খন্ডে বিভিন্ন সৈন্য ঘাঁটিতে হানা দিয়ে ৬টি জল ও স্থলচর ট্রাক দখল করেছেন। তাছাড়া, একটি ট্রাক ধ্বংস করে প্রায় ৮০ জন সেনাকে খতম করেছেন। মুক্তিফৌজের সহিত সংশ্লিষ্ট ঘনিষ্ঠ মহলের সূত্র থেকে পাওয়া আরও সংবাদে জানা গিয়েছে যে, কুমিল্লা জেলার কসবায় মুক্তিফৌজ তিনটি পাকিস্তানী সামরিক ট্রাক দখল করে নিয়েছেন। হঠাৎ হানা দিয়ে কমান্ডোরা একজন ক্যাপ্টেন সমেত ২৮ জন সৈন্যকে খতম করেছেন। শ্রীহট্ট সেক্টরে ৬০ জন সৈন্যসহ একটি ট্রাক ধ্বংস হয়েছে এবং ৩টি ট্রাক কমান্ডোদের দখলে এসেছে। তবে শেষোক্ত ক্ষেত্রে কোনও সৈন্যহানি না হলেও পলায়নপর সৈন্যরা প্রচুরসংখ্যক মাঝারি মেশিনগানের বুলেট ও কয়েকটি বন্দুক ফেলে রেখে যায়। ঐ একই সূত্রে জানা যায় যে, মুক্তিযোদ্ধারা লাকসাম-নোয়াখালী রোডে রাখীর কাছে একটি সেতু উড়িয়ে দেন। ইতোমধ্যে আগরতলা থেকে আর একটি খবরে প্রকাশ, পাকিস্তানী সেনারা সীমান্ত পেরিয়ে যাবার সময় দুটি পরিবারের ১৩ ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করেছে। পিটিআইর এক খবরে জানা যায়, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে রংপুর খন্ডে স্বাধীনতা যোদ্ধারা রামনগর এলাকায় একটি পাক টহলদার বাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে একজন পাকিস্তানী মেজরকে সাবাড় করেন। এই আক্রমণে কয়েকজন পাকসৈন্য আহত হয়। লালমনিরহাট এলাকায় মুক্তিফৌজ হাতবান্দা ও বাউরার মধ্যে একটি রেলসেতু উড়িয়ে দেয়। ফেনীর দক্ষিণে পাক-সেনাদের সঙ্গে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। পিটিআইর খবরে আরও জানা যায়, কুমিল্লা খন্ডে মুক্তিফৌজ ফেনীর ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে একটি স্থানে পাকিস্তানী সেনাদলের ওপর আক্রমণ চালালে সেখানে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। গঙ্গাসাগর এলাকাতেও পাক-সেনাদের সঙ্গে মুক্তিফৌজের গুলি বিনিময় হয়। আগরতলা থেকে ইউএনআই জানাচ্ছে: সীমান্তের ওপার থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গিয়েছে যে, মাধবপুর শ্রীহট্ট সড়কে মুক্তিফৌজের গেরিলা বাহিনী গত ক’দিনে পাকসেনাদের দুটি কনভয়ের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ১২০ জন পাকসৈন্যকে খতম করেছেন। প্রথম কনভয়টি আক্রান্ত হয় শ্রীহট্টের নালুয়া গ্রামের কাছে। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান গেরিলা বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। এই আক্রমণের প্রায় ৭০জন পাকসৈন্য নিহত হয়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×