ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ

উচ্চ রক্তচাপ ॥ নীরব ঘাতক

প্রকাশিত: ০৮:৫৫, ১৮ মে ২০১৯

উচ্চ রক্তচাপ ॥ নীরব ঘাতক

১৭ মে ছিল বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- ‘আপনার রক্তচাপ জানুন।’ দেশে উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আগে বয়স্কদের মধ্যে রক্তচাপের প্রবণতা বেশি থাকলে তরুণরাও এই নীরব ঘাতকের শিকার হচ্ছেন। অনেকেই জানেনই না যে, তিনি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকেই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে দেড় শ’ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। এই রোগে প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। মনে রাখা উচিত, উচ্চ রক্তচাপ প্রায়ই একটি স্থায়ী রোগ হিসেবে বিবেচিত, অর্থাৎ একবার আক্রান্ত হলে আর ভাল হয় না, তবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। এর জন্য চিকিৎসা ও প্রতিরোধ দুটোই জরুরী। তা না হলে বিভিন্ন জটিলতা, এমনকি হঠাৎ করে মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে। উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন কী? স্বাভাবিক রক্তচাপ হলো সেই বল বা শক্তি, যার সাহায্যে রক্ত শরীরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছায়। হৃৎপিন্ডের পাম্পিং ক্রিয়ার মাধ্যমে রক্তচাপ তৈরি হয়। রক্তস্রোত রক্তনালীর দেয়ালে যে চাপ সৃষ্টি করে, সেটিই রক্তচাপ। রক্তচাপের কোন একক নির্দিষ্ট মাত্রা নেই। বিভিন্ন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে একেক জন মানুষের শরীরে রক্তচাপের মাত্রা ভিন্ন এবং একই মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে স্বাভাবিক রক্তচাপও বিভিন্ন রকম হতে পারে। উত্তেজনা, দুশ্চিন্তা, অধিক পরিশ্রম ও ব্যায়ামের ফলে রক্তচাপ বাড়তে পারে। ঘুমের সময় এবং বিশ্রাম নিলে রক্তচাপ কমে যায়। রক্তচাপের এই পরিবর্তন স্বাভাবিক। সাধারণত বয়স যত কম, রক্তচাপও তত কম হয়। একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তচাপ গড়ে ১২০-৮০ ধরা হয়। ওপরেরটাকে বলা হয় সিস্টোলিক এবং নিচেরটাকে বলা হয় ডায়াস্টলিক। যদি কারও রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রার চাইতে বেশি হয় এবং অধিকাংশ সময় এমনকি বিশ্রামকালীনও বেশি থাকে, তবে ধরে নিতে হবে তিনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী। সাধারণত ওপরের চাপ ১৪০ এর বেশি এবং নিচের চাপ ৯০ এর বেশি হলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলা হয়। উচ্চ রক্তচাপ কি আসলেই কোন জটিল ব্যাধি? আসলেই উচ্চ রক্তচাপ এক জটিল ব্যাধি, যা ভয়ঙ্কর পরিণতি, এমনকি এর জটিলতায় হঠাৎ মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে। অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের কোন প্রাথমিক লক্ষণ বা উপসর্গও দেখা যায় না। এটাই উচ্চ রক্তচাপের সবচেয়ে মারাত্মক দিক। যদিও অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের রোগীর কোন লক্ষণ থাকে না, তবুও নীরবে উচ্চ রক্তচাপ শরীরের বিভিন্ন অংশ বা অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ জন্যই উচ্চ রক্তচাপকে ‘নীরব ঘাতক’ বলা যেতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত এবং চিকিৎসাবিহীন উচ্চ রক্তচাপ থেকে মারাত্মক শারীরিক জটিলতাও দেখা দিতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ হলে কী কী জটিলতা হতে পারে? রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ ৪টি অঙ্গে মারাত্মক ধরনের জটিলতা হতে পারে। যেমন- হৃৎপিন্ড, কিডনি, মস্তিষ্ক ও চোখ। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি, হৃদযন্ত্রের মাংশপেশী দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দুর্বল হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করতে পারে না এবং এই অবস্থাকে বলা হয় হার্ট ফেইলিওর। রক্তনালীর গাত্র সঙ্কুচিত হয়ে হার্ট এ্যাটাক বা করোনারি আর্টারি ডিজিজ হয়ে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এক পর্যায়ে দুটো কিডনি বিকল হয়ে ক্রনিক রেনাল ফেইলিউর হতে পারে, যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় থাকে না। পরবর্তী সময়ে ডায়ালাইসিস এমনকি কিডনি সংযোজনের প্রয়োজন হয়। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপে মস্তিষ্কে স্ট্রোক বা পক্ষাঘাত, স্মৃতিশক্তি নষ্ট হওয়া এমনকি রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। এ ছাড়া চোখের রেটিনা আক্রান্ত হয়ে অন্ধত্বের ঝুঁকিও থাকে। কী কী কারণে উচ্চ রক্তচাপ হয়? ৯০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোন নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না, একে প্রাইমারি বা এ্যাসেন্সিয়াল রক্তচাপ বলে। সাধারণত বয়স্ক মানুষের উচ্চ রক্তচাপ বেশি হয়ে থাকে। কিছু কিছু বিষয় উচ্চ রক্তচাপের সম্ভাবনা বাড়ায়, যেমন : বংশানুক্রমিক : উচ্চ রক্তচাপের বংশগত ধারাবাহিকতা আছে, যদি বাবা-মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তবে সন্তানেরও উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি নিকটাত্মীয়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও অন্যদের রক্তচাপের ঝুঁকি থাকে। ধূমপান : ধূমপায়ীদের শরীরে তামাকের নানা রকম বিষাক্ত পদার্থের প্রতিক্রিয়ায় উচ্চ রক্তচাপসহ ধমনী, শিরার নানা রকম রোগ ও হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ : খাবার লবণে সোডিয়াম থাকে, যা রক্তের জলীয় অংশ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তের আয়তন বেড়ে যায় এবং রক্তচাপও বেড়ে যায়। ক্স অধিক ওজন এবং অলস জীবনযাত্রা : রীতিমতো ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম না করলে শরীরে ওজন বেড়ে যেতে পারে। এতে হৃদযন্ত্রকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় এবং ফলে অধিক ওজনসম্পন্ন লোকদের উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস : অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার, যেমন মাংস, মাখন এবং ডুবা তেলে ভাজা খাবার খেলে ওজন বাড়বে। কলিজা, গুর্দা, মগজ এসব খেলে রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল হলে রক্তনালীর দেয়াল মোটা ও শক্ত হয়ে যায়। এর ফলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত মদ্যপান : যারা অত্যধিক পরিমাণে মদ্যপান করেন, তাদের উচ্চ রক্তচাপ বেশি হয়। এ্যালকোহলে অতিরিক্ত ক্যালরি থাকে, এর ফলে ওজন বেড়ে যায় এবং রক্তচাপ বেড়ে যায়। ডায়াবেটিস : ডায়াবেটিস রোগীদের এ্যাথারোস্ক্লেরোসিস বেশি হয়। ফলে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ডায়াবেটিস রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। এ ছাড়া তাদের অন্ধত্ব ও কিডনির নানা রকম রোগ হতে পারে। অতিরিক্ত উৎকণ্ঠা : অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা, ভীতি এবং মানসিক চাপের কারণেও রক্তচাপ সাময়িকভাবে বেড়ে যেতে পারে। যদি এই মানসিক চাপ অব্যাহত থাকে এবং রোগী ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারেন, তবে এই উচ্চ রক্তচাপ স্থায়ী রূপ নিতে পারে। কিছু কিছু রোগের কারণেও উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া গেলে একে বলা হয় সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন। এই কারণগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো : কিডনির রোগ। এ্যাড্রেনাল গ্রন্থি ও পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার। ধমনীর বংশগত রোগ। গর্ভধারণ অবস্থায় এ্যাকলাম্পসিয়া ও প্রি-এ্যাকলাম্পসিয়া। অনেকদিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ির ব্যবহার, স্টেরয়েড জাতীয় হরমোন গ্রহণ এবং ব্যথা নিরামক কিছু কিছু ওষুধ খেলে। জন্মগত ধমনীর রোগ যেমন কোয়ার্কটেশন অফ এওর্টা। উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমাতে কি করা উচিত? জীবনযাত্রার পরিবর্তন এনে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। বংশগতভাবে উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা কমানো সম্ভব নয়। তবে এ রকম ক্ষেত্রে যে সব উপাদান নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেগুলোর ব্যাপারে বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত। ক্স অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। খাওয়া দাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। সীমিত আহার করা উচিত এবং ব্যায়াম অব্যাহত রাখতে হবে। ওষুধ খেয়ে ওজন কমানো বিপজ্জনক। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওজন কমানোর ওষুধ না খাওয়াই ভাল। নিয়মিত ব্যায়াম : সকাল-সন্ধ্যা হাঁটাচলা, সম্ভব হলে দৌড়ানো, হাল্কা ব্যায়াম, লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার ইত্যাদি নিয়মিত চালিয়ে যেতে হবে। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা : কম চর্বি ও কম কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন খাশি বা গরুর গোশত, কলিজা, মগজ, গিলা, গুর্দা কম খেতে হবে। কম তেলে রান্না করা খাবার এবং ননী তোলা দুধ, অসম্পৃক্ত চর্বি যেমন সয়াবিন, ক্যানোলা, ভুট্টার তেল অথবা সূর্যমুখীর তেল খাওয়া যাবে। বেশি আশযুক্ত খাবার গ্রহণ করা ভাল। ভাত কম খেয়ে আটার রুটি এবং সুজী জাতীয় খাবার পরিমাণ মতো খাওয়া ভাল। বেশি বেশি শাক-সব্জি ও ফলমূল খেতে হবে। লবণ নিয়ন্ত্রণ : তরকারিতে প্রয়োজনীয় লবণের বাইরে অতিরিক্ত ও পাতে আলগা লবণ পরিহার করতে হবে। মদ্যপান : অতিরিক্ত মদ্যপান পরিহার করতে হবে। ধূমপান বর্জন : ধূমপান অবশ্যই বর্জনীয়। ধূমপায়ীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন। তামাক পাতা এবং তামাকজাত দ্রব্য যেমন জর্দা, গুল ইত্যাদিও পরিহার করতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ : যাদের ডায়াবেটিস আছে, তারা অবশ্যই তা নিয়ন্ত্রণ করবেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করবেন। মানসিক ও শারীরিক চাপ সামলাতে হবে : নিয়মিত বিশ্রাম, সময়মতো ঘুমানো, শরীরকে অতিরিক্ত ক্লান্তি থেকে বিশ্রাম দিতে হবে। নিজের শখের কাজ করা, নিজ ধর্মের চর্চা করা ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক শান্তি বেশি হবে। রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা : নিয়মিত চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে গিয়ে রক্তচাপ পরীক্ষা করানো উচিত। যত আগে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে, তত আগে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং জটিল রোগ বা প্রতিক্রিয়া হতে রক্ষা পাওয়া যায়। উচ্চ রক্তচাপ হলে কি চিকিৎসা করাতেই হবে? একবার উচ্চ রক্তচাপ হয়ে গেলে তা আর ভাল হয় না। একে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং অবশ্যই তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধপত্র সেবন করতে হবে। অনেক রোগী কিছুদিন ওষুধ খাবার পর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এলে ওষুধ বন্ধ করে দেন। মনে করেন, রক্তচাপ তো ভাল হয়ে গেছে, কাজেই ওষুধ খাওয়ার দরকার কি? এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কোনক্রমেই ডাক্তারের নির্দেশ ছাড়া ওষুধ পরিবর্তন বা সেবন বন্ধ করা যাবে না। অনেকেই আবার উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত জানার পরেও ওষুধ খেতে অনীহা প্রকাশ করেন বা খেতে চান না। কারও কারও ধারণা একবার ওষুধ খেলে তা আর বন্ধ করা যাবে না, তাই ওষুধ নিতে অনীহা প্রকাশ করেন। আবার কেউ কেউ এমনও ভাবেন যে, উচ্চ রক্তচাপ তার দৈনন্দিন জীবন প্রবাহে কোন সমস্যা করছে না বা রোগের কোন লক্ষণ নেই, তাই উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেতে চান না বা প্রয়োজন মনে করেন না। মনে করেন, ভালই তো আছি, ওষুধের কি দরকার? বলা বাহুল্য, এই ধারণাগুলো সম্পূর্ণ ভুল এবং অযৌক্তিক। এই ধরনের রোগীরাই হঠাৎ করে হৃদরোগ বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, এমনকি তাদের মৃত্যুর ঝুঁকিও অমূলক নয়। তাদের অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে, নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে এবং নিয়মিত চেক আপ করাতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রতিরোধই সর্বোত্তম। উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের শৃঙ্খলা মেনে চলাই সবচেয়ে জরুরী। লেখক : সাবেক ডিন ও চেয়ারম্যান, মেডিসিন অনুষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×