ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিপন্নের পথে তক্ষক

প্রকাশিত: ০৮:৪৬, ১৮ মে ২০১৯

 বিপন্নের পথে তক্ষক

মানুষের মধ্যেই বাস। আড়ালে থাকে। দেখতে অনেকটা বড় টিকটিকির মতো। তবে টিকটিকি নয়। গায়ের রং সাদাটে ধূসরের মধ্যে হালকা ডোরাকাটা নয়। টিকটিকিটিক করে ডাকেও না। গ্রামে ও শহরে কখনও কখনও কারও দৃষ্টিতে এলে বলা হয় ‘বিলাতি টিকটিকি’। বলার কারণ : ওদের গোটা শরীর সাদাটের মধ্যে লাল ও গোলাপি ফোঁটা। প্রাণীটির নাম ‘তক্ষক’। কাব্য সাহিত্যে এই নামে অনেক উপমা আছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রকৃতির সৌন্দর্যের এই ছোট প্রাণীটি নিধন ও পাচারের থাবায় বিপন্ন হওয়ার পথে। এমন একটি প্রাণী বগুড়া বাংলাদেশ ব্যাংক স্টাফ কোয়ার্টারে উপপরিচালক মাহবুবের ফ্ল্যাটের কোনায় চোখে পড়ে। তিনি খবর দেন সরকারী আজিজুল হক কলেজের পরিবেশবাদী সংগঠন টিম ফর এনার্জি এ্যান্ড ইনভায়রনমেন্ট রিসার্চের (তীর) সভাপতি মোঃ আরাফাত রহমানকে। এরপর খবর দেয়া হয় বন বিভাগকে। তারপর সামাজিক বন বিভাগের ফরেস্টার তোফাজ্জল হোসেন গিয়ে প্রাণীটিকে চিহ্নিত করেন। বিলুপ্তের পথে যাওয়া তক্ষক প্রাণীটি উদ্ধার করে অবমুক্ত করা হয়। প্রাণীটির ইংরেজী নাম টোকাই গেককো। গেক্কো নিডি গোত্রের প্রাণীটির আবাস দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। প্রজাতিটি গিরগিটি নামেও পরিচিতি পেয়েছে। পিঠের ফোঁটাগুলো নানা রঙের। পাশাপাশি কয়েকটি সারিতে বিন্যস্ত। সাদা রঙের বলয়। লেজ কিছুটা নীল। মাথা শরীরের অনুপাতে বড়। নাকের ডগা চোখা ও ভোঁতা। চোখ বড়। মণি ফালি গড়নের। লেজ সামান্য নোয়ানো। শরীরের দৈর্ঘ্য যত লেজের দৈর্ঘ্য প্রায় ততটা। অনেকে ভুল করে প্রাণীটিকে সরিসৃপ মনে করে। অতি উৎসাহীরা মেরেও ফেলে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্পুচিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্সসহ কয়েকটি দেশে ৬শ’ প্রজাতির তক্ষকের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশে দুই প্রজাতির তক্ষক মিলেছে। আরও হয়তো আছে, তবে সেগুলো লুকিয়ে আছে। এরা তক্ক তক তক্কা করে কয়েকবার ডাকে। দূর থেকে শোনা যায়। এদের শ্রবণশক্তি বেশি। কেউ মনে করে এমন তক্কা তক্কা ডাকের জন্য নাম হয়েছে তক্ষক। দেখতে সুন্দর এই প্রাণীটির বাস মানুষেরই সঙ্গে। ছাদের ফাঁকে, কার্নিশে, কোনায়, কোন ফাঁকফোকরে এরা চলাচল করে। দিনে খুব কম দেখা মেলে। জঙ্গলের গাছের শাখায় ও কখনও গর্তেও থাকে। এরা খুবই লাজুক প্রকৃতির। টিকটিকির যেমন অবাধ বিচরণ এদের তেমন নয়। তক্ষক অনেকটা বড় হওয়ায় এরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকে। এদের দৈর্ঘ্য ১৫ থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার (৫ থেকে ১৪ ইঞ্চি)। শরীর গোলবৃত্তীয়। স্ত্রী তক্ষকের চেয়ে পুরুষ তক্ষক বেশি উজ্জ্বল ও সুন্দর। যে কারণে স্ত্রী তক্ষক পুরুষ তক্ষকের পিছনে ঘুরঘুর করে। বায়োলজিক্যালি এরা ডিমরফিক বা দ্বিরুপচারী। এদের চোয়াল খুব শক্ত। কীটপতঙ্গ ছোট পাখি, ছোট সাপ, কখনও ঘরের টিকটিকিও খায়। দূর অতীতে সুন্দর প্রাণী হিসেবেই এদের বাস ছিল। গত শতকের মধ্যভাগে এই প্রাণীর ওপর নির্মম খড়গ নেমে আসে। পাচারকারীরা তক্ষককে চড়া দামে বেচতে শুরু করে। বলা হয় এদের চামড়া ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ওয়াইল্ড লাইফ থেকে জানা যায় ফিলিপাইনে তক্ষক নিধন ও পাচার শুরু হলে ওই দেশের সরকার তা প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন করে। যে আইনে তক্ষক শিকার ও পাচারকারী ধরা পড়লে দশ লাখ ফিলিপিন মুদ্রা জরিমানা ও কারাদ-ের বিধান আছে। ভিয়েতনামে তক্ষক শিকার করলে কারাদন্ড সহ লক্ষ ডলার জরিমানা করা হয়। আন্তঃজাল (ইন্টারনেট) ঘেঁটে জানা যায় চীন এই প্রাণীটি বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) জানায় তক্ষক প্রাণীটিকে রক্ষার জন্য তারা বিশ্বের সকল দেশের কাছে আহ্বান জানিয়েছে। বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা রোধে বিশ্ব এখন সোচ্চার। পরিবেশবিদ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রতিষ্ঠানগুলো যে প্রাণীগুলো খুব কম দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তা রক্ষায় বড় ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকায় এই প্রাণীটির বিচরণ আছে। সহসা কেউ এদের দেখতে পায় না। তক্ষক দৃষ্টিসীমার বাইরেই থাকতে চায়। এদের প্রজননকাল আছে। একটি স্ত্রী তক্ষক প্রতিবার এক থেকে তিনটি ডিম দিতে পারে। এদের সংখ্যা কমে গেলে প্রজননের মাধ্যমে সংরক্ষণের কথাও বলা হচ্ছে। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×