ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আমওয়ালা

প্রকাশিত: ১০:৪৪, ১৭ মে ২০১৯

আমওয়ালা

এত অল্প বয়সে মেয়েটির আচরণ সবার মন জয় করে নিয়েছে। মাত্র দশ বছর বয়স! এখনই যা বুদ্ধি-সুদ্ধি! মাশাল্লাহ! কথাগুলো মেয়েটির মাকে উদ্দেশ করে বলছিলেন তার দাদি মা। মেয়েটির নাম জোছনা। নামটাও দাদি মা-ই রেখেছিলেন। দাদি মার আত্মতৃপ্তি এই ভেবে যে, তার নাম রাখাটা সার্থক। মেয়েটি জোছনার মতোই এ সংসারে সবার মনে আলো ছড়িয়ে আছে। মাঝ উঠোনে খেলছিল জোছনা। হঠাৎ মায়ের ডাক। বাবার জন্য খাবার নিয়ে যেতে হবে আম বাগানে। পীরগঞ্জ উপজেলার ভোমরদহ গ্রামে জোছনাদের বাড়ি। বাবা তার হাসমত আলী। বৈশাখ মাস চলছে। সামনে আমের মৌসুম। হাসমত আলীর এখন ব্যস্ত সময়। সারাক্ষণ আমবাগানে পড়ে থাকে। একমাত্র মেয়ে জোছনা বাবার জন্য দুবেলা খাবার দিয়ে আসে। শহরের মহাজন সকালেও ফোনে হাসমত আলীকে আম দ্রুত বড় করার জন্য বলেছে। শুরুর দিকে বাজারে তুলতে পারলে ভাল দাম পাওয়া যাবে। মহাজনের কাছ থেকে আগেই লাখ টাকা নিয়ে রেখেছে হাসমত আলী। সময়মতো আম না দিতে পারলে কখন আবার টাকা চেয়ে বসে, সে এক দুশ্চিন্তা। এদিকে মহনাজের কাছ থেকে আনা সব টাকা ইতোমধ্যে আম বাগানে বিনিয়োগ করে ফেলেছে সে। সব সময় তাই বাগানে পড়ে থাকে। গাছ আর আমের পরিচর্যা করে। কিন্তু আমের বড় হওয়ার গতিতে সন্তুষ্ট নয় হাসমত আলী। বাগানে পাঁয়চারি করে আর বার বার গাছে ঝুলে থাকা আমের দিকে তাকায়। কখনও কখনও ডাল টেনে আম ধরে দেখে পরিপক্ব হলো কিনা। গাছে মুকুল আসার পর থেকে একটা মুকুলও যেন নষ্ট না হয় তার জন্য নিয়মিত রাসায়নিক প্রয়োগ করেছে। শহরের মহাজনের পরামর্শে মুকুল থেকে আম আসার পরে আরও কী সব ওষুধ ছিটিয়েছে। এ মৌসুমে গাছে যে পরিমাণ আম ধরেছে তা দেখে হাসমত আলী মনে মনে ভীষণ খুশি। হয়ত সব আম ভালয় ভালয় বিক্রি করতে পারলে মোটা অঙ্কের লাভ আসবে। কিন্তু ধৈর্য সইছে না তার। ওদিকে মহাজনের তাড়া তো আছেই। বৈশাখের মাঝামাঝি একদিন কাঁচা আম পেড়ে হাসমত আলী কেটে দেখল আমের বিচি কিছুটা শক্ত হয়েছে। তবে আম এখনও পরিপক্ব হয়নি। শহরের মহাজনকে জানালে সে বলে আম পেড়ে ফেলতে। আরও বলে- সব আম পেড়ে পাকানোর জন্য কার্বাইড আর ফরমালিন দিয়ে ঝুড়ি ভরে রেখে পরদিন আড়তে নিয়ে আসতে। ভাল লাভ পাওয়ার আশায় মহাজনের কথা অনুযায়ী কাজ করল হাসমত আলী। বাগানে হাসমত আলীর সহযোগীরা বোঝানোর চেষ্টা করে আমে বিষ মেশানোটা ঠিক নয়। হাসমত আলীর চোখে-মুখে তখন মোটা অঙ্কের টাকার স্বপ্ন। ধমকের সুরে তাদের শুনিয়ে দেয় অনেক কথা। হাসমত আলীর সে সুর এমন ছিল যে, কত লোকেই তো কার্বাইড দিয়ে আম পাকাচ্ছে। আর মানুষও তো খাচ্ছে। মানুষের পেটে আজকাল এসব সয়ে গেছে। আমের সঙ্গে একটু-আধটু এসব খেলে কিছুই হয় না। উঠোন ভরা আমের ঝুড়ি দেখে জোছনা ভীষণ খুশি। সব আম শহরে পাঠানো হবে। বাবার অনেক টাকা আসবে এবার। মনে মনে ভাবে বাবাকে বলবে একটা নতুন জামা কিনে দিতে। গেলবার আমের মৌসুমে বাবা যে জামাটা দিয়েছিল তা পুরনো হয়ে গেছে। জোছনা ঝুড়ির আম টিপে টিপে দেখল অনেক ঝুড়ির আমই পেকে গেছে। ঝুড়ি থেকে দুটো পাক আম নিয়ে খেতে খেতে আম বাগানের দিকে হাঁটে। দুপুরের দিকে বিশাল একা ট্রাক আসল। আমের ঝুড়িগুলো সেই ট্রাকে তোলা হলো। সন্ধ্যার দিকে আম নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল হাসমত আলী। দু’দিন পরের কথা। হাসমত আলী মহাজনকে আম বুঝিয়ে দিয়ে টাকার হিসাব-নিকাশ করছে। এমন সময় বউয়ের ফোন। ফোনের ওপারে বউ কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল-জোছনার যেন কী হয়েছে! সকাল থেকে পেটে ব্যথায় উঠোনে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অনেক কিছু খাওয়ানো হয়েছে। গ্যাসের ওষুধও দেয়া হয়েছে। কোন কিছুতেই থামছে না। হাসমত আলী বউয়ের কথা শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এখনই রওনা দিচ্ছি বলে জোছনাকে নিয়ে যেতে বলে এলাকার বড় হাসপাতালে। রাতে এসে পৌঁছায় হাসমত আলী। হাসপাতালে যাবতীয় পরীক্ষা শেষে রিপোর্ট এলো জোছনার লিভার আর কিডনির অনেকাংশই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। ডাক্তার আরও জানাল কার্বাইড আর ফরমালিন মিশ্রিত খাবারের কারণেই এ ধরনের সমস্যা হয়। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা মেয়ের চিৎকার আর ডাক্তারের সব কথা শুনে হাসমত আলী হাঁটু ভেঙ্গে মেঝেতে বসে পড়ে। হাউমাউ করে কাঁদে আর বলে-ডাক্তার আমার মেয়ের এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী! ডাক্তার! আপনি আমার কিডনি আর লিভার নিয়ে নিন। আমার মেয়েকে বাঁচান!
×